অর্থনৈতিক অঞ্চলে সংযোগ থাকলেও গ্যাস সরবরাহ নেই

অর্থনৈতিক অঞ্চলে নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস বিদ্যুৎ সরবরাহ অনিশ্চয়তায় পড়েছে। যদিও প্রথম থেকেই এর নিশ্চয়তা দেয়া হচ্ছে।
উদ্যোগ নেয়ার সাত বছর হয়ে গেলেও সরকারি একটিও অর্থনৈতিক অঞ্চলে উৎপাদন শুরু হয়নি। পাঁচটি বেসরকারি অঞ্চল উন্নয়নের কাজ চলছে। এর মধ্যে মাত্র তিনটিতে শিল্প উৎপাদন চলছে; কিন্তু চাহিদামত গ্যাস না পেয়ে কেউই পুরোদমে উৎপাদন শুরু করতে পারছে না।

সম্প্রতি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় উপস্থিত বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রতিনিধিরা জানান, প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ এবং গ্যাস না পাওয়ায় তারা কাঙ্ক্ষিত গতিতে উৎপাদন করতে পারছেন না। বিনিয়োগ নিয়ে হতাশা তৈরি হচ্ছে। সভায় মেঘনা অর্থনৈতিক জোনের চেয়ারম্যান জানান, তাদের ইকোনমিক জোনে একশ মেগাওয়াট ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনে বিদ্যুতের চাহিদা ৫৫ মেগাওয়াট। তবে সেখানে গ্যাস সংযোগ নিশ্চিত না হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।

বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক অঞ্চলের বাইরের শিল্পে গ্যাস সংযোগ দেয়া হবে না বলে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। আমরা সেভাবেই আগাচ্ছি। আমদানি করা এলএনজি প্রাকৃতিক গ্যাসের সাথে মিশিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহ করা হবে। এ গ্যাস আপাতত শিল্পে সরবরাহ করা হবে। এ বছরের শেষ নাগাদ সংকট থাকবে না।

দেশে ২০৩০ সালের মধ্যে একশ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ইতোমধ্যে ৭৯টির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাস্তবায়িত বা বাস্তবায়নাধীন আছে ২৩টি। চূড়ান্ত লাইসেন্স পেয়ে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শেষ করেও প্রয়োজন অনুযায়ী গ্যাস ও বিদ্যুত্ পাচ্ছে না শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কাজ করতে পারছে না তারা। উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন।

বেজার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ড. মো. এমদাদুল হক বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে কতটুকু গ্যাস-বিদ্যুত্ প্রয়োজন হবে তা এখনো নিরূপণ করা যায়নি। চাহিদা নিরূপণে মহাপরিকল্পনা করা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, যে অঞ্চলগুলো স্থাপন করা হচ্ছে সেগুলোকে এখনো গ্যাসের নিশ্চয়তা দিচ্ছি না। চলতি বছরের মধ্য এবং শেষ ভাগে এলএনজি আমদানি শুরু হবে। তখন গ্যাসের সংকট কেটে যাবে।

এখন পর্যন্ত সরকার চার ধরনের অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ৫০টি, বেসরকারি ২৩টি, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) ২টি এবং দুই দেশের সরকার মিলে ৪টি। আরো দুইটি শিগগিরই অনুমোদন দেয়া হবে। সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো পর্যায়ক্রমে পিপিপি জোনে রূপান্তরিত হবে।

সরকারি অঞ্চলগুলোর মধ্যে বাগেরহাটের মংলা জোনে বিদ্যুৎ এবং গ্যাস সংযোগ থাকলেও গ্যাসের সরবরাহ নেই। চট্টগ্রামের মীরসরাই জোনে অন্তত ১৭টি বিনিয়োগকারীর আবেদন পাওয়া গেলেও এখন পর্যন্ত গ্যাস-বিদ্যুতের অবকাঠামো হয়নি। মৌলভীবাজারের শ্রীহট্ট জোনে গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। জামালপুরে বিদ্যুত্ ও গ্যাস সংযোগের কাজ চলমান। বাকিগুলোতে সংযোগ কিংবা সরবরাহ- কোনোটাই নেই।

বেসরকারি অঞ্চলগুলোর চালচিত্র
অনুমোদিত ১৭টি বেসরকারি অঞ্চলের মধ্যে ৫টিকে চূড়ান্ত লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে তিনটিতে (মেঘনা, বে এবং আমান গ্রুপে) উৎপাদন শুরু হয়েছে। বাকি ১২টি প্রি-কোয়ালিফিকেশন বা প্রাক-যোগ্যতা লাইসেন্স পেয়েছে।  চূড়ান্ত লাইসেন্স পাওয়ার পর নারায়ণগঞ্জে মেঘনা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৬টি শিল্প প্রতিষ্ঠান স্বল্পমাত্রায় উৎপাদন শুরু করেছে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে আমান অর্থনৈতিক অঞ্চলে অন্তত ৪টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করেছে। তারা চাহিদানুযায়ী ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পেলেও গ্যাস পাচ্ছে না। গাজীপুরে বে অঞ্চলে ৩টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করলেও গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। মুন্সীগঞ্জে আবদুল মোনেম অঞ্চলে ৩টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে। এ জোনে শিগগিরই মোটরসাইকেল নির্মাণ শুরুর কথা রয়েছে। তবে গ্যাস না পাওয়া গেলে সেটিও পিছিয়ে যাবে। ঢাকায় আরিশা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২টি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করলেও গ্যাসের অভাবে থমকে আছে উৎপাদন গতি। নরসিংদীর পলাশ উপজেলায় এ কে খান অঞ্চলে গ্যাস সংযোগ দেয়া হলেও সরবরাহ নেই।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী সদস্য ড. মো. এমদাদুল হক বলেন, এখন পর্যন্ত যে অঞ্চলগুলোতে শিল্প উৎপাদন শুরু হয়েছে সেগুলো মূলত বিদ্যুৎনির্ভর । গ্যাসনির্ভর অঞ্চলগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় গ্যাসের জোগানও নিশ্চিত করা যাবে।

এলএনজিতে ভরসা
বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদা রয়েছে অন্তত ৩ হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ঘাটতি ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের। এ অবস্থায় আগামী এপ্রিল মাসে পেট্রোবাংলার উদ্যোগে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের সমপরিমাণ এলএনজি আমদানি শুরুর কথা রয়েছে। এরপর নভেম্বর-ডিসেম্বরে সামিট গ্রুপের আরো ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি শুরু করার কথা। পেট্রোবাংলার পূর্বাভাস অনুযায়ী বছরের শেষ নাগাদ গ্যাসের চাহিদা দাঁড়াবে ৩ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এছাড়া দেশের গ্যাসক্ষেত্র থেকেও আরো বেশি গ্যাস উত্তোলনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।