দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিণাম হতে পারে ভয়াবহ

কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র বেড়ে যাওয়অর কারণে দক্ষিণ-পূর্ভ এশিয়ার দেশগুলোতে গুরুতর পরিণাম বয়ে আনতে পারে বলে সতর্ক করেছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, বর্তমানে শুধু ভারতেই কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে বছরে মারা যায় এক লাখের মতো মানুষ। কয়লা ব্যবহারের ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ুদূষণের মাত্রা ব্যাপক হারে বাড়বে। এতে মৃত্যুর সংখ্যা তিন গুণ বেড়ে যেতে পারে।
গত শুক্রবার হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি ও পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন গ্রিনপিসের নতুন এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে কয়লা বাদ দিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে ২৩টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার, যার ক্ষমতা ২১ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি কেন্দ্রের কাজ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরবনের কাছে রামপালে কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে তীব্র আপত্তি উঠেছে দেশে-বিদেশে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, এই কেন্দ্র চালু হলে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। ইউনেস্কোও আপত্তি জানিয়েছে। যদিও সরকার দাবি করছে, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না।
পরিবেশের ওপর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে করা ওই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির শ্যানন কোপলিটজ। তিনি বলেছেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উদীয়মান দেশগুলোতে কয়লার ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। বিশেষ করে চীন ও ভারতের বায়ুদূষণ ব্যাপকভাবে বৈজ্ঞানিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এতে এ অঞ্চলে বায়ু ও জনস্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও এশিয়ার বাকি দেশগুলোতে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে কী পরিমাণ প্রভাব পড়বে তাও উঠে এসেছে ওই গবেষণায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মতো উন্নত দেশ তাদের কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন হবে বর্তমানের তিনগুণ। এমন বৃদ্ধি ঘটবে বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম থেকে।
আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা আইইএ বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া, চীন ও ভারতের দৃষ্টান্ত ভালো নয়। ইন্দোনেশিয়ায় যে পরিমাণ কয়লা ব্যবহার করা হয় তার ৪০ গুণ ব্যবহার করা হয় চীনে।
আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ২০১১ থেকে ২০৩৫ সালের মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা শতকরা ৮৩ ভাগ বৃদ্ধি পাবে। শহরাঞ্চলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শহরমুখী মানুষের ছুটে আসার কারণেই মূলত এই চাহিদা দ্রুত বাড়ছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির পরিবর্তে এসব মানুষের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর জন্য নজর দেয়া হচ্ছে কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওপর। ফলে এ অঞ্চলে মারাত্মক স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি দেখা দেবে।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এ অঞ্চলে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যে পরিমাণ কার্বন নির্গমন হচ্ছে তাতে প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। কিন্তু এ অঞ্চলে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সচল হলে ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ৭০ হাজারে। ইন্দোনেশিয়ায় এমন বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে ১৪৭টি। তা এই সময়ে দ্বিগুণ হয়ে হতে পারে ৩২৩টি। মিয়ানমারে বর্তমানে এমন বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে ১৬টি। ওই সময়ের মধ্যে তা পাঁচ গুণেরও বেশি হতে পারে।
তবে গ্রিনপিসের বায়ুদূষণ বিশেষজ্ঞ লাউরি মাইলিভিটরা বলেছেন, কয়লার পাশাপাশি চীন ও ভারত জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনছে। চীন নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন অগ্রদূত। ২০১৩ সাল থেকে বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা মেটাতে তারা প্রায় পুরোটাই নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করছে। ভারতেও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ছে। এর ব্যবহার বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে তারা।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, চীন ও ভারত যদি নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ায় তাহলে বায়ুদূষণ ভয়ঙ্কর মাত্রায় পৌঁছাবে না।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়ুর গুণমানের ওপর সুস্পষ্ট নেতিবাচক প্রভাব সত্ত্বেও কয়লা সস্তা হওয়ায় ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারে এগিয়ে।
আইইএ বিশ্লেষকরা বলেছেন, কয়লার পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ালে বায়ুদূষণ কমবে। পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণেও সহায়ক হবে। এজন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে অগ্রাধিকার দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা দরকার।
প্রতিযোগিতামূলক বাজারে উত্পাদন খরচ কমাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি শিল্পকে একটি নির্দিষ্ট স্কেলে পৌঁছানো দরকার। কিন্তু অধিকাংশ দেশেই তা হয়নি। এ বিষয়ে নজর দেয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।