‘দ্রুত এলএনজি’ আমদানির উদ্যোগ

অনেকটা দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের (কুইক রেন্টাল) মতোই সরকারের জ্বালানি মন্ত্রণালয় এবার উদ্যোগ নিয়েছে ‘দ্রুত এলএনজি’ আমদানির।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ছোট ছোট জাহাজে করে এই এলএনজি আমদানি করা হবে। তা খালাসের জন্য ব্যবহার করা হবে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা (সিইউএফএল), কর্ণফুলী সার কারখানা (কাফকো) এবং বর্তমানে পরিত্যক্ত সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই গ্যাস ব্যবহারও করা হবে সিইউএফএল ও কাফকোতে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনের আওতায় এই ‘দ্রুত এলএনজি’ আমদানি করা হবে। শর্ত হচ্ছে, চুক্তি সই করার পর ছয় মাসের মধ্যে আমদানি করা এলএনজি থেকে গ্যাস সরবরাহ শুরু করতে হবে। দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও এই আইনের আওতায় করা হয়।

দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যেমন অনেক বেশি দামে সরকার বিদ্যুৎ কেনে, তেমনি ‘দ্রুত এলএনজি’ থেকে পাওয়া গ্যাসের দামও পড়বে বেশি। পেট্রোবাংলার সূত্র জানায়, বড় জাহাজে করে এলএনজি আমদানির চেয়ে ‘দ্রুত এলএনজি’র দাম প্রতি ইউনিটে প্রায় এক মার্কিন ডলার বেশি পড়বে। সেই হিসাবে দ্রুত এলএনজি আমদানিতে বছরে ব্যয় বেশি হবে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। তাই এই উদ্যোগের যৌক্তিকতা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি মহলে প্রশ্ন উঠেছে।

সরকার ইতিমধ্যে বড় আকারে এলএনজি আমদানির দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর একটি করছে আমেরিকান কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি। অন্যটি শীর্ষস্থানীয় দেশীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপ। তারা প্রত্যেকে প্রতিদিন ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সমপরিমাণ এলএনজি এনে তা পুনরায় গ্যাসে রূপান্তরিত করে পাইপলাইনে সরবরাহ করবে। এর জন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে তৈরি হচ্ছে ভাসমান টার্মিনাল বা এফএসআরইউ (ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট)।

এর মধ্যে এক্সিলারেট এনার্জির ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ শুরু হবে আগামী বছরের এপ্রিলে। অর্থাৎ, এখন থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে। সে অনুযায়ীই সব কাজ যথাযথভাবে এগোচ্ছে। এর পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে, অর্থাৎ আগামী বছরের অক্টোবর-নভেম্বরে সরবরাহ শুরু হবে সামিটের ৫০ কোটি ঘনফুট।

পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, আগামী বছর দেশে গ্যাসের দৈনিক সর্বোচ্চ চাহিদা হবে ৩৮০ কোটি ঘনফুট। দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে কম-বেশি ২৭০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। আর ১০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি হিসেবে আমদানি হবে। ফলে দেশের সর্বোচ্চ চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সামঞ্জস্য আসবে। এইভাবে সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে ২০২৫ সালের মধ্যে দৈনিক ৪০০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সমপরিমাণ এলএনজি আমদানি করা।

এর অংশ হিসেবে ভারতের রিলায়েন্স পাওয়ার লিমিটেড ২০১৯ সালের জুনে দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুটের সমপরিমাণ এবং হংকং সাংহাই-মানজালা নামের একটি যৌথ উদ্যোগের কোম্পানি ২০২০ সালের মধ্যে দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুটের সমপরিমাণ এলএনজি সরবরাহ শুরু করবে। ভারতের পেট্রোনেট এলএনজি লিমিটেড দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট এবং চীনের দুটি কোম্পানির
যৌথ উদ্যোগে দৈনিক আরও ১০০ কোটি ঘনফুটের সমপরিমাণ এলএনজি আমদানির জন্য স্থলভিত্তিক অবকাঠামো তৈরির প্রস্তাবও সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে।

সুতরাং জ্বালানির ঘাটতি পূরণের জন্য এখন ছোট ছোট জাহাজে করে বেশি দামে এলএনজি আমদানির উদ্যোগকে অপ্রয়োজনীয় মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ম. তামিম বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বাড়লে তা দেশের অর্থনীতির জন্য ভবিষ্যতে বড় সমস্যা সৃষ্টি করবে—এই ভাবনাটা বিশদভাবে ভাবা দরকার। কাজেই বাড়তি এলএনজি আমদানির পরিবর্তে দেশের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ওপর জোর দেওয়া উচিত।

২০১৪ সালের জুন মাস থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কম থাকা সত্ত্বেও আমদানি করা এলএনজি প্রতি ইউনিটের (এক হাজার ঘনফুট) দাম পড়বে অন্তত ৫৬০ টাকার (গড়ে ৭ মার্কিন ডলার) মতো। পেট্রোবাংলার হিসাবে, বর্তমানে দেশে প্রতিদিন যে ২৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে, তার সঙ্গে আগামী বছর আমদানি করা এলএনজি থেকে ১০০ কোটি ঘনফুট যুক্ত হলে গ্যাসের দাম এখনকার তুলনায় তিন গুণেরও বেশি পড়বে।

আগামী বছরের মধ্যে প্রতিদিন ১০০ কোটি ঘনফুটের সমপরিমাণ এলএনজি আমদানি শুরু হওয়ার পর গ্যাসের দামের যে হিসাব ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের কাছে সরকার তুলে ধরেছে, সে অনুযায়ী প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম পড়বে ২৭ টাকা, যা বর্তমানে ৮ টাকার মতো।

জানতে চাইলে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, দেশের স্থলভাগে ও সমুদ্রসীমায় জ্বালানি অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাড়ানো হলে এত এলএনজি আমদানির দরকার হতো না। সে ক্ষেত্রে আমদানির তুলনায় দেশের নিজস্ব জ্বালানির পরিমাণ বেশি থাকায় দাম বাড়ত সামান্য। এখন ব্যাপক আমদানির কারণে জ্বালানির দাম বাড়তে থাকলে অর্থনীতি ও জনজীবনের সব ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়বে।

এলএনজি আসলে পাইপলাইনে সরবরাহ করা প্রাকৃতিক গ্যাসই। এই গ্যাস এক দেশ থেকে আরেক দেশে আমদানি-রপ্তানি করতে হলে সাগর, পাহাড়, মরুভূমি প্রভৃতির মধ্য দিয়ে পাইপলাইন করতে হবে, যা কারিগরিভাবে দুরূহ এবং অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক। তাই আমদানি-রপ্তানির জন্য এই প্রাকৃতিক গ্যাস হিমাঙ্কের নিচে ১৬২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তরলীকরণ করা হয়।

এই তরল গ্যাস বিশেষভাবে নির্মিত বড় বড় জাহাজে করে এক দেশ থেকে আরেক দেশে নিয়ে আবার উচ্চ তাপে তা গ্যাসে পরিণত করে পাইপলাইনে সরবরাহ করা হয়। তখন এই পদার্থকে বলা হয় ‘রিগ্যাসিফাইড এলএনজি’ বা আরএলএনজি। কাতার, ইন্দোনেশিয়া এবং আরও কোনো কোনো দেশ থেকে এইভাবে এলএনজি এনে দেশে গ্যাসের চাহিদা মিটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

এলএনজি আমদানি সরকারের ১০টি বড় প্রকল্পের অন্যদম। এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১০ সালে। ২০১৩-১৪ সালে চালু হওয়ার কথা ছিল যা ইতিমধ্যে প্রায় চার বছর পিছিয়েছে।

_
প্রথম আলো