অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণ রোধে উন্নত মানের চুলা

উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত, তা চিহ্নিত করার লক্ষ্যে গবেষণা করছে কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টার। অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি সামাজিক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত উন্নয়নের ওপরও জোর দিচ্ছে সংস্থাটি। বাংলাদেশের জন্য ভিশন ২০২১ অর্জনে এই গবেষণাভিত্তিক কিছু নিবন্ধ প্রকাশ করছে প্রথম আলো। আজ প্রকাশ করা হলো তৃতীয়টি।

বাড়ির ভেতরে খোলা আগুনে রান্নার ফলে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে, তা এক দিনে দুই প্যাকেট সিগারেট ধূমপান করার সমপরিমাণ হতে পারে। বাংলাদেশে প্রতি ১০টি বাড়ির মধ্যে প্রায় ৯টি বাড়ি অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণের শিকার। এসব বাড়িতে রান্নার জন্য কাঠ ও অন্যান্য জৈব জ্বালানি ব্যবহার করা হয়। ঘরের ভেতরে খোলা আগুনে রান্নার ফলে ফুসফুসের ক্যানসার, স্ট্রোক ও হৃদ্রোগের মতো মারাত্মক সব ব্যাধিতে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। এ রকম অভ্যন্তরীণ দূষণ ১০-১৫ শতাংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী।

এ ক্ষেত্রে স্পষ্টতই বলা যায়, বাড়ির ভেতরের বায়ুদূষণ কমানোর বিষয়ে এখন আমাদের মনোযোগ দেওয়া দরকার। এ ব্যাপারে আমাদের করা একটি গবেষণায় বাড়ির ভেতরে মারাত্মক বায়ুদূষণ হ্রাসের ব্যাপারে দুটি প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রথমত, মানুষ হয় একই জৈব জ্বালানি বারবার ব্যবহার করতে পারে। তবে তা করতে হবে আরও উন্নত মানের রান্নার চুলা ব্যবহার করে, যা অনেক কম ধোঁয়া নিঃসরণ করে অথবা তারা জৈব জ্বালানির পরিবর্তে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহার করতে পারে, যা অনেক বেশি পরিচ্ছন্নভাবে রান্নার কাজটি করে।
ঘরের ভেতরে বায়ুদূষণ রোধ করার সবচেয়ে সস্তা উপায় হলো উন্নত রান্নার চুলা তৈরিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করা। এই চুলায় সাধারণত একটি চিমনি থাকে, যা ঘরের ভেতরে ধোঁয়া উদ্গিরণ না করে বাইরে করে এবং তাপের অপচয় রোধ করে রান্নার হাঁড়িতে তাপ ছড়িয়ে দেয়। গতানুগতিক চুলা বা খোলা আগুনে রান্নার চেয়ে এই চুলায় রান্না করা বেশি আরামদায়ক এবং পরিবেশের জন্য কম ক্ষতিকর। এ ধরনের একটি চিমনিসহ দ্বিমুখী চুলা তিন বছর স্থায়ী হয়। এই চুলা ব্যবহারে পরিবারপিছু বছরে খরচ হবে এক হাজার টাকা। এর উপকারিতা অনেক। যদি বাংলাদেশের তিন কোটি পরিবারের সবগুলোই গতানুগতিক চুলার পরিবর্তে উন্নত রান্নার চুলা ব্যবহার করে, তাহলে প্রতিবছর ৩৩ হাজারেরও বেশি মানুষের জীবন রক্ষা পাবে। প্রতিটি মানুষ গড়ে আরও ২৮ বছর বেশি বেঁচে থাকবে, যার অর্থমূল্য প্রায় ৭ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রতিটি পরিবার অসুস্থতার কয়েকটি দিন কম যাপন করবে, যার অর্থমূল্য আরও ২৬০ টাকা।
এ ছাড়া প্রতিটি পরিবারে রান্নার সময়ও দৈনিক ১৫ মিনিট করে বাঁচবে, কারণ উন্নত রান্নার চুলাগুলো দ্রুত কাজ করে এবং যেহেতু এতে কম জ্বালানির প্রয়োজন হয়, তাই এটা প্রতিদিনের জ্বালানি সংগ্রহ করার সময়কে অর্ধেকে নামিয়ে আনবে। সব মিলিয়ে এই সুবিধার অর্থমূল্য আরও ২০০০ টাকা। ঘরের ভেতরে বায়ুর মান উন্নয়নে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
তবে আমরা আরও বিকল্প চিন্তা করতে পারি। তা হলো ব্যাপকভাবে এলপিজির ব্যবহার। এটি খুব পরিচ্ছন্নভাবে রান্নার কাজটি করে, প্রায় একটি বৈদ্যুতিক চুলার মতোই। এলপিজির ব্যবহার অনেক বেশি সুবিধা দেবে। এটা ৯১০০০ হাজার মানুষের জীবন বাঁচাবে, যার অর্থমূল্য প্রায় ২১ হাজার ৮০০ টাকা বা পরিবারপিছু ৭ হাজার ৩০০ টাকা। এটি পরিবারপিছু প্রায় ৭০০ টাকার অসুস্থতার খরচ কমাবে, রান্নার গতি বৃদ্ধি করবে প্রায় ৪০ মিনিট এবং জ্বালানি সংগ্রহের পুরো সময়টা বাঁচিয়ে দেবে, যার নিট অর্থমূল্য প্রায় ৫ হাজার ২০০ টাকা।
কিন্তু এলপিজির খরচটাও উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এতে বছরে খরচ পড়বে প্রায় ১০,০০০ টাকা, যার সঙ্গে যোগ হবে ২০০০ টাকার জ্বালানি খরচ। তবে সব মিলিয়ে আপনি প্রায় ১২,০০০ টাকা খরচ করে প্রায় ১৩ হাজার ২০০ টাকার সুফল পাবেন। তাই এলপিজি ব্যবহারের জন্য আপনার আর্থিক ক্ষতি হবে না।
তবে এ-ও ঠিক যে সবচেয়ে দামি বিকল্পই সেরা বিকল্প নয়। সস্তা বিকল্পও অনেক সময় বেশি উপকার করে। তবে দীর্ঘ সময়ের জন্য ব্যয়বহুল বিকল্পগুলো সমাধান হতে পারে। বাংলাদেশের মতো আয় রয়েছে এমন অনেক দেশ রান্নার কাজে বেশি অর্থ খরচ করে এলপিজির মতো আধুনিক জ্বালানি ব্যবহার করছে।
কিন্তু উন্নত মানের চুলা চালু করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়ে দেখা গেছে, অনেক পরিবারকে নতুন উন্নত মানের চুলায় অভ্যস্ত করানোটা কঠিন। প্রতিটি পরিবার উন্নত চুলাতে অভ্যস্ত না হতে পারলে স্থানীয় বায়ুদূষণ বৃদ্ধির কারণে খুব কমই সুফল পাওয়া যাবে।
তাই বায়ুদূষণ কম হয় এমন রান্নার চুলা ব্যবহারের সুবিধা জানিয়ে প্রচারণা চালাতে হবে। তবেই এর সুবিধা সম্পর্কে সবাই জানতে পারবে। এ-সংক্রান্ত প্রকল্পগুলোর উচিত হবে ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী চুলাগুলো তৈরি করা। এবং চুলা কেনার জন্য পরিবারগুলোকে একাধিক কিস্তিতে মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থা করে দেওয়া উচিত, যা তাদের জন্য আরও সাশ্রয়ী হবে।

bjorn lombargড. বিয়ন লোমবোর্গ: কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টারের প্রেসিডেন্ট। টাইম ম্যাগাজিনের মূল্যায়নে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির একজন।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: তাসনুভা বাশার

– প্রথমআলো থেকে