উৎপাদন, বিতরণ ও সরবরাহ ব্যবস্থায় সমন্বয় জরুরী

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা এখনও ঝুঁকির মধ্যে আছে। উৎপাদন, বিতরণ ও সরবরাহ ব্যবস্থায় সমন্বিতভাবে পরিবর্তন আনতে হবে। উৎপাদন ব্যবস্থায় যেমন বৈচিত্র আনতে হবে তেমনই বিতরণ ব্যবস্থাতেও নানা মাধ্যম ব্যবহার করতে হবে।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িত প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এস শাহনেওয়াজ আহমেদ তার এক গবেষণা পত্রে এই তথ্য দিয়েছেন। ১লা নভেম্বর ২০১৪ সালে সারাদেশে বিদ্যুতের মহাবিপর্যয়ের উপর পর্যালোচনা করে এই গবেষণা পত্র উপস্থাপন করেন।
সোমবার বিদ্যুৎ ভবনে এই গবেষণা পত্র উপস্থাপন করা হয়। এসময় বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মনোয়ার ইসলাম, অতিরিক্ত সচিব আহমদ কায়কাউস, পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন, পিডিবি চেয়ারম্যান শাহিনুল ইসলাম খান, আরইবি চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মঈনউদ্দিন, পিজিসিবি ব্যবস্থাপনা পরিচালন আল বেরুনী, ডিপিডিসি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) নজরুল হাসানসহ বিদ্যুৎ বিভাগের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীরা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ সচিব বলেন, ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনায় আরও বড় চ্যালেঞ্জ আসবে। বড় বড় কেন্দ্র উৎপাদনে আসছে। বড় কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসলে তা নিয়ন্ত্রণ জটিল হবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এখন থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যবস্থাপনাকে আরও উন্নত করতে হবে। দ্রুত সময়ে সঞ্চালন ব্যবস্থা উন্নত করার উদ্যোগ নেয়া হবে বলে তিনি জানান।
গবেষণা পত্রে বলা হয়, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এখনও সয়ংক্রিয় হয়নি। এজন্য কোন সমস্যা তৈরী হলে তা দ্রুত সমাধান করা সম্ভব হয় না। এখনও টেলিফোনে সমস্যার কথা জানতে হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানো কিম্বা বাড়ানোর বিষয়টি টেলিফোনের মাধ্যমে করা ঝুঁকিপূর্ণ। ১লা নভেম্বর সমস্যা তৈরী হওয়ার পরে দ্রুত প্রতিরোধ করা যায়নি। দ্রুত সময়ে প্রতিরোধ করা গেলে সমস্যা কম হত। এছাড়া সয়ংক্রিয় পদ্ধতি থাকলে বিপর্যয় হলেও পরে দ্রুত সময়ের মধ্যে তা সমাধান করা সম্ভব হয়। ঐ দিন বেশিক্ষণ সমস্যা থাকার এটি একটি কারণ।
ড. শাহনেওয়াজ আহমেদ বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রেও নজর দিতে হবে। সব কেন্দ্র যেন একই ধরণের যন্ত্র দিয়ে স্থাপন করা না হয়। বিদ্যুৎ সঞ্চালনের ক্ষেত্রেও এদিকে খেয়াল রাখতে হবে। একই সঞ্চালন লাইনে ভিন্ন জ্বালানির বিদ্যুৎ পরিবহনের বিষয়েও সর্তক থাকার পরামর্শ দেন তিনি। এছাড়া ভূটান থেকে বিদ্যুৎ আনতে একক সঞ্চালন লাইন করতে হবে। সেই সঞ্চালন লাইনে কয়লা বা তেল চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রর বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা ঠিক হবে না।
গবেষণা পত্রে বলা হয়, ভেড়ামারা উচ্চক্ষমতার আন্তঃদেশীয় উপকেন্দ্রর সমস্যা এবং অন্য কোন বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে ১লা নভেম্বর বিদ্যুতের মহাবিপর্যয় হয়েছিল। তবে অন্য কোন বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়েছিল তা নিদিষ্ট করা সম্ভব হয়নি। আধুনিক জিপিআরএস ব্যবস্থা না থাকার করণে কোন কেন্দ্র প্রথম বন্ধ হয়েছিল তা জানা যায়নি। একসাথে ৭৩৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে সে দিন বিপর্যয় হয়। এরমধ্যে ভেড়ামারার ৪৪৪ মেগাওয়াট
গত বছর নভেম্বরে দেশ জুড়ে বিদ্যুৎ বিপযয়ের সময় ৭৩৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ একসাথে সরবারহ বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ ঘাটতিজনিত বিপর্যয় কাটানোর জন্য সঞ্চালন ব্যবস্থায় স্থাপিত প্রতিরোধ ব্যবস্থাও (রিলে সিস্টেম)  দ্রুত কাজ করেনি।
ফলে সারা দেশে বিপর্যয় ঘটেছিল। সে সময় একই সময়ে দুটো ঘটনা ঘটেছিল। এরমধ্য একটি হলো, কুমিল্লার ভেড়ামারায় অবন্থিত আন্তঃদেশীয় উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন উপকেন্দ্র সফটওয়ার ত্রুটি, এই ত্রুটির কারণে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আসা বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় ভারত থেকে ৪৪৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছিল। একই সময়ে দেশের ভেতরে এক বা একাধিক  বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে ২৯০ মেগাওয়াট সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এই দুই কারণ এক হওয়াতে মহাবিপর্যয় হয়েছিল। চার দশমিক চার সেকেন্ডের মধ্যে যদি লোড ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে সম্বন্বয় করা যেতো তা হলে এ বিপর্যয় ঘটত না।
এ ঘটনার আগে এবং পরেও ভেড়ামারা সাবষ্টেশনটি ট্রিপ করেছে। কিন্তু ওই সময়গুলোতে জাতীয় গ্রিডে কোনো বিপর্যয় হয়নি। ভেড়ামারা উপকেন্দ্রে সফটওয়ারে লো-ভোল্টেজের কথা বলা হলেও বাস্তবে লো- ভোল্টেজ ছিল না। সেদিন শনিবার ছুটির দিন ছিল। ওইদিন কোনো লোডশেডিং ছিল না। এতে এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, যখন গ্রিড বিপর্যয় ঘটে ওই সময় অর্থাৎ সাড়ে ১১টার দিকে বিদ্যুতের চাহিদাও হঠাৎ করে বেড়ে যায়নি। সেসময় মোট চার হাজার ৬৭৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছিল।
কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যেতো; ৭৩৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি তৈরি হওয়ার পর পরই যদি একই পরিমাণ লোডশেড করা যেতো তাহলে এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না। তবে ঘটনা ঘটার চার থেকে ছয় দশমিক ছয় সেকেন্ডের মধ্যেই এই উৎপাদন ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ করতে হতো। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে কার্ভ তা উপরে উঠে যেতো এবং পাওয়ার ফেক্টরও ৪৯ দশমিক ০৬৬ হার্টজ হয়ে যেতো। অথবা ওই সময় ছোট ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে একই পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যেতো এবং পাওয়ার ফেক্টর ৫০ হার্টজ করা সম্ভব হতো তাহলে এই গ্রিড বিপর্যয় ঘটতো না। অর্থাৎ যথা সময়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন ছিল।
প্রতিকার হিসেবে বলা হয়, এই ধরনের ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে একই পরিমাণ লোডশেড যত দ্রুত সম্ভব করতে হবে। উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা এমনভাবে করতে হবে যেন এক সাথে যে কোন দুই ব্যবস্থা বিকল হলেও তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। নেপাল, ভুটান, ভারত ও মিয়ানমার থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে আলাদা বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে আলাদা এক্সপ্রেস ফিডার ব্যবহার করা যেতে পারে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কত উৎপাদন হচ্ছে তার মধ্যে সমন্বয় রাখতে হবে। কোন স্থানে হঠাৎ করে লোডশেডিং করা যাবে না। আগে থেকে বলে নির্ধারণ করে লোডশেডিং করতে হবে। এতে গ্রিড বিপর্যয়ের কারণও সহজে বোঝা যাবে। স¥ার্ট গ্রিড ও স্মাট মিটার সংযোগ করতে হবে।