কয়েকটি ক্ষেত্রে গ্যাসের মজুত দ্রুত কমছে

দেশের অন্তত পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাসের মজুত ধারণার চেয়ে অনেক দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। ফলে এগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলনও কমে গেছে। ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে ফেঞ্চুগঞ্জ, সেমুতাং, সালদা নদী, সুন্দলপুর ও রূপগঞ্জ। এর মধ্যে সুন্দলপুর ও রূপগঞ্জ ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে।

এই পাঁচটি ক্ষেত্রই বাপেক্সের মালিকানাধীন। এগুলো থেকে দৈনিক প্রায় ৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হতো। কমতে কমতে এখন (ডিসেম্বর) তা ২ কোটি ঘনফুটের কমে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই ক্ষেত্রগুলোতে গ্যাসের যে মজুত আছে বলে হিসাব করা হয়েছিল, তাতে এখনই তা ফুরিয়ে আসার কথা নয়।

এর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশিষ্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমত এ ঘটনায় মজুত নির্ধারণে বাপেক্সের অদক্ষতার প্রমাণ মেলে। এ ছাড়া মজুত বেশি দেখিয়ে বেশি হারে বোনাস নেওয়ার বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ দুই কারণ ছাড়া এমন হওয়ার কথা নয়।

বাপেক্স নতুন কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করলে কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বোনাস পেয়ে থাকেন।

এ ছাড়া বিবিয়ানা, তিতাসসহ বড় গ্যাসক্ষেত্রেও গ্যাসের চাপ কমে আসছে, যা মজুত কমে আসার লক্ষণ।

দেশে বর্তমানে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ৩৫০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহ করা হচ্ছে ২৬০ কোটি ঘনফুটের মতো। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুরু না হওয়া পর্যন্ত এ ঘাটতি পূরণের কোনো পথ নেই।

৫ গ্যাসক্ষেত্রের চিত্র
বাপেক্সের সূত্র জানায়, ঢাকার পার্শ্ববর্তী পূর্বাচলে ২০১৪ সালে রূপগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কার করা হয়। ক্ষেত্রটিতে প্রায় ৩৪ বিসিএফ (বিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস মজুত আছে বলে বলা হয়েছিল। কিন্তু এই বছরই ক্ষেত্রটি থেকে দৈনিক ৫০ লাখ ঘনফুট করে গ্যাস তোলা শুরু করার পর এখনই মজুত ফুরিয়ে গেছে। অথচ ক্ষেত্রটি থেকে এখন পর্যন্ত সর্বমোট এক বিসিএফ গ্যাসও তোলা হয়নি।

নোয়াখালীর সুন্দলপুর গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কার করা হয় ২০১২ সালে। এখানে ৫০ বিসিএফ গ্যাস মজুত আছে বলে হিসাব করা হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত সর্বমোট ১০ বিসিএফ গ্যাস তোলার পরই ক্ষেত্রটির একমাত্র কূপটি বন্ধ করে দিতে হয়েছে। কারণ, বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য আর গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না।

খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে অবস্থান সেমুতাং গ্যাসক্ষেত্রের। এই ক্ষেত্রটির মোট মজুত হিসাব করা হয়েছিল ৩১৮ বিসিএফ। একসময় এখান থেকে দৈনিক ৩ কোটি ঘনফুট করেও গ্যাস তোলা হয়েছে। এখন তা নেমে এসেছে দৈনিক ২০ লাখ ঘনফুটে। এখন পর্যন্ত ক্ষেত্রটি থেকে সর্বমোট ১৩ বিসিএফের মতো গ্যাস তোলার পরই এ অবস্থা দাঁড়িয়েছে।

সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ ক্ষেত্রটি অনেক পুরোনো। ১৯৮৪ সালে আবিষ্কৃত এই ক্ষেত্রটির মজুত নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩২৯ বিসিএফ। এখন পর্যন্ত গ্যাস তোলা হয়েছে সর্বমোট ১৫৩ বিসিএফ। এরই মধ্যে ক্ষেত্রটির দৈনিক উত্তোলন ক্ষমতা আড়াই কোটি ঘনফুট থেকে কমে ১ কোটি ২০ লাখ ঘনফুটে দাঁড়িয়েছে।

সালদা নদী গ্যাসক্ষেত্রটির অবস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে। এই ক্ষেত্রের একমাত্র কূপ থেকে দৈনিক ১ কোটি ঘনফুট করে গ্যাস তোলা হতো। কিন্তু এখন তা ৩৫ লাখ ঘনফুটে নেমে এসেছে।

জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলার সূত্রগুলো জানায়, যদিও এই ক্ষেত্রগুলো ছোট এবং মজুত কম, কিন্তু এগুলো থেকে উত্তোলিত মোট গ্যাসের পরিমাণ দৈনিক সরবরাহের হিসাবে নগণ্য নয়।

বড় গ্যাসক্ষেত্রের চিত্র ও এলএনজি আমদানির ঝোঁক
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, দেশের সবচেয়ে বড় দুটি ক্ষেত্রের একটি বিবিয়ানার মজুত এবং উত্তোলনও ২০১৯ সাল থেকে কমতে শুরু করবে। উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তির (পিএসসি) অধীনে এই ক্ষেত্রটির পরিচালক আমেরিকান কোম্পানি শেভরন সম্প্রতি পেট্রোবাংলাকে বিষয়টি জানিয়েছে।

দেশের আরেকটি বড় ক্ষেত্র তিতাসের প্রায় ২৭টি কূপের প্রায় সব কটিতেই গ্যাসের চাপ কমে আসছে। অর্থাৎ ক্ষেত্রটিতে গ্যাসের মজুত কমে আসায় চাপও (রিজার্ভার প্রেশার) কমছে। এ ছাড়া রশীদপুর, হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ প্রভৃতি ক্ষেত্রেও গ্যাসের চাপ কমে আসছে। ইতিমধ্যে দৈনিক গ্যাস সরবরাহের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। দেশের কোথাও কোনো শ্রেণির গ্রাহক সঠিক চাপে গ্যাস পাচ্ছে না। ফলে শিল্প উৎপাদনসহ সব শ্রেণির গ্রাহকের কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে। গ্যাসের অভাবে পেট্রোবাংলা রেশনিং শুরু করেছে। এর আওতায় দুটি সার কারখানা এবং কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়েছে। সিএনজি স্টেশন ও আবাসিক গ্রাহকেরা কম চাপে গ্যাস ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছেন।

অন্যদিকে সরকার পুরোপুরি নির্ভর করে আছে এলএনজি আমদানির ওপর। আগামী বছরের এপ্রিল থেকে প্রতিদিন ৫০ কোটি এবং অক্টোবরে আরও ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সমপরিমাণ এলএনজি আমদানি শুরু হওয়ার কথা। সেই লক্ষ্যে সব কার্যক্রমই চলছে। কিন্তু এলএনজি আমদানি শুরু হলে গ্যাসের দাম প্রায় তিন গুণ বাড়বে। এলএনজি আমদানির উদ্যোগ যেমন এগোচ্ছে, দেশের বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উন্নয়ন এবং নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে তার বিপরীতমুখী প্রবণতা।

জানতে চাইলে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নওশাদ ইসলাম বলেন, তাঁরা ১০৮টি কূপ খননের প্রক্রিয়া নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন। এ ছাড়া ফেঞ্চুগঞ্জ ক্ষেত্রটি সার্ভিসিং করে এবং সুন্দলপুরে দ্বিতীয় একটি কূপ খনন করে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর লক্ষ্যেও তাঁরা কাজ শুরু করেছেন।