জ্বালানি বিষয়ে সরকারকে স্বচ্ছ থাকতে হবে

বাংলাদেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বেড়েছে ১লা সেপ্টেম্বর থেকে। সরকার বলছে, বৃদ্ধির পরিমাণ সামান্য। কিন্তু বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে যে, অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে এবং তাতে অনেক মানুষকে কষ্টে পড়তে হবে। এটাও বলে রাখা ভালো যে, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ক্রমাগত পড়ছে। এ অবস্থায় অনেকের প্রত্যাশা ছিল যে, আমদানি করা এ পণ্যের দাম কমাবে বাংলাদেশ সরকার; কিন্তু সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।

এ লেখায় আমি প্রথমে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বিষয়ে আলোচনা করব। তারপর আসব পেট্রোল-অকটেন-ডিজেলের মূল্য প্রসঙ্গে।
গ্যাস বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ। মাটির নিচে রয়েছে এ সম্পদ। সমুদ্র থেকেও কিছু উত্তোলন করা হচ্ছে। তবে আমি বলব যে, শিল্প ও বাণিজ্য এবং গৃহস্থালির কাজে এ গ্যাস একেবারেই পানির দরে বিক্রি হচ্ছে। বিশ্ববাজারে এ পণ্যের দামের সঙ্গে যার তুলনা চলে না। বর্তমানে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্য অনেক পড়ে গেছে। তারপরও আমরা যদি এ গ্যাস আমদানি করি তার যে মূল্য সে তুলনায় দেশে উৎপাদিত গ্যাসের দাম খুব কম। প্রকৃতপক্ষে আমরা বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদের দাম শূন্য ধরে এতদিন হিসাব করে আসছি। দাম নির্ধারণে আমরা বিবেচনায় নিই উৎপাদন খরচ এবং বেতন ও প্রশাসনিক ব্যয়। প্রকৃতির দান হলেও গ্যাসের যে দাম রয়েছে সেটা আদৌ গুরুত্ব পায়নি। এর পাশাপাশি এমন একটি ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, বাংলাদেশে এ সম্পদ অফুরন্ত_ কখনও শেষ হবে না। গ্যাস খাতে যে অদক্ষতা, দুর্নীতি ও অপচয়ের অভিযোগ তার মূলে কিন্তু এই স্বল্প দাম। আবার দেশে দাম খুব কম থাকায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। আমাদের উচিত ছিল পর্যায়ক্রমে দাম বাড়িয়ে চলা। অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে, যারা সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করেন তারা সারাদিন চুলা জ্বালিয়ে রাখেন না। পরিমিত ব্যবহার করায় তারা যত্নবান থাকেন। একই ঘটনা দেখি ওয়াসার পানির ক্ষেত্রে। আমরা বাজার থেকে কেনা বোতলজাত পানির প্রতিটি ফোঁটা ব্যবহার করি। কিন্তু ওয়াসার পানি গ্গ্নাসে নিয়ে কিছুটা খাই, বাকিটা ফেলে দিই। প্রধানত রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো সরকারই দাম বাড়ানোর অপরিহার্য কাজটি উপেক্ষা করেছে। সস্তায় জনগণকে কিছু দিলে তাতে জনপ্রিয় থাকা যায় বলে মনে করা হয়। অথচ আমরা এটা ভেবে দেখতে চাইনি যে, রাজধানীতে বসবাস করা লোকের তুলনায় অন্য জেলা শহর এবং বিশাল গ্রামবাংলায় বসবাসকারী বিপুল জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগের আয় তুলনামূলক কম। তাদেরকেই প্রতিদিন রান্নার জন্য জ্বালানি খাতে ব্যয় করতে হচ্ছে অনেক বেশি অর্থ। এর একটিই যুক্তি হতে পারে_ রান্নার জন্য পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ পাওয়া জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ সমাজের প্রভাবশালী মানুষ। তাদের সন্তুষ্ট রাখতে হবে।
গ্যাসের ব্যবহার হয় বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনে। অনেক শিল্পকারখানায় গ্যাসের সরবরাহ দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। যানবাহন চালাতেও সিএনজি পাম্প স্টেশনের মাধ্যমে এর সরবরাহ করা হয়। বাসায় রান্নার জন্যও গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এজন্য রাজধানী ঢাকাসহ নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকায় রয়েছে বিস্তীর্ণ নেটওয়ার্ক। তবে এ খাতে ব্যবহার মোট সরবরাহ করা গ্যাসের মাত্র সাত শতাংশ। রান্নার কাজে বাকি ৯৩ শতাংশ লোক নির্ভর করে এলপিজি (সিলিন্ডার), কেরোসিন ও লাকড়ির ওপর। যেসব পরিবার এলপিজি ব্যবহার করে তাদের মাসে ব্যয় পড়ে কমপক্ষে আড়াই হাজার টাকা। লাকড়ি এবং কেরোসিনের ব্যয়ও এর কাছাকাছি। সে তুলনায় গ্যাস একেবারেই মেলে নামমাত্র মূল্যে।
গ্যাসের ব্যবহার হয় শিল্পে ক্যাপটিভ পাওয়ারের জন্য। জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে যারা শিল্পকারখানার জ্বালানি চাহিদা মেটায়, তাদের তুলনায় ক্যাপটিভ পাওয়ার যথেষ্ট সস্তা। সবাইকে এ সুবিধা সমভাবে প্রদান করা গেলে শিল্প খাতে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ত; কিন্তু এখন একদল পাচ্ছে এবং আরেক দল পাচ্ছে না। যারা এ সুবিধা পাচ্ছেন ১ সেপ্টেম্বর থেকে তাদের ব্যয় এক লাফে দ্বিগুণ করে দেওয়া হয়েছে। এ কাজটি ধাপে ধাপে করলে ভালো হতো। হঠাৎ করে মূল্য এভাবে বৃদ্ধি করায় অনেকের পক্ষে অর্ডার সরবরাহ করায় সমস্যায় পড়তে হবে। গ্যাসের ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়ার জন্যও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আলোচনা দরকার। উদ্যোক্তাদেরও এটা বুঝতে হবে যে, ক্যাপটিভ পাওয়ারে বাংলাদেশের নিজস্ব গ্যাস সম্পদ থেকে যে সুবিধা ভোগ করছেন তার পরিবর্তে যদি আমদানি করা এলএনজি ব্যবহার করতে হয়, তাহলে ব্যয় পড়বে অনেক বেশি।
এখন আসি বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রসঙ্গে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরও কিন্তু সরকারকে এ খাতে ভর্তুকি দিতে হবে। সরকারের উচিত ছিল তেলের দাম কমিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমানো। বিশেষ করে ফার্নেস অয়েলের দাম কমানোর সুযোগ রয়েছে। সরকার বলছে যে, তারা বিদ্যুতের দাম গড়ে মাত্র তিন শতাংশ বাড়িয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এর ফলে রাজস্ব আয় খুব একটা বাড়বে না। বরং বিদ্যুতের দাম বাড়ছে_ এমন প্রচারে সরকারের ভাবমূর্তির ক্ষতি হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ফার্নেস অয়েল ও গ্যাসের ব্যবহার হয়। ডিজেলও ব্যবহার হয়। তবে এ ধরনের জ্বালানিতে ইউনিট প্রতি উৎপাদন ব্যয় পড়ে সবচেয়ে বেশি। কয়লার ব্যবহার হয় খুব কম। জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার হলে সে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ব্যয় হবে অন্য জ্বালানির তুলনায় অনেক কম। সরকার যদি ফার্নেস অয়েলের দাম কমিয়ে দেয়, তাহলে বিদ্যুতের দাম কমে আসবে। ডিজেলের দাম কমাতে কিছু সমস্যা রয়েছে। কারণ, এর অন্য ব্যবহার রয়েছে। বিশেষভাবে যানবাহনে এর ব্যবহার হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ডিজেলের দাম কমানো হলে অন্য খাতে তার ব্যবহার হতে পারে। তবে এটাও মনে রাখা দরকার যে, বিদ্যুৎ, পরিবহন, সেচকাজসহ সব ধরনের ব্যবহারের ক্ষেত্রেই ডিজেলের মূল্য সরকার কমিয়ে আনতে পারে। সরকার সিএনজির দাম বাড়িয়েছে স্বল্প পরিমাণে। সরকার যদি ডিজেলের দাম কমিয়ে এনে সিএনজির কাছাকাছি দাম করে দেয়, তাহলে অনেক যানবাহন মালিক গ্যাসের জন্য লম্বা লাইন না দিয়ে সিএনজির ব্যবহার করবে। আবার এমন প্রশ্নও করা হচ্ছে যে, ডিজেলের দাম কমানো হলে কি বাস-ট্রাকের ভাড়া কমবে? কৃষকের সেচের ব্যয় কমবে? অভিজ্ঞতা বলছে, এ ধরনের ছাড়ে প্রকৃত ভোক্তাদের তেমন লাভ হয় না। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় ডিজেল_ বছরে প্রায় ৪০ লাখ টন। ফার্নেস অয়েলের ব্যবহার মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদনে এবং বছরে এজন্য প্রয়োজন পড়ে ১০ লাখ টনের মতো। পেট্রোল-অকটেন মিলিয়ে ব্যবহার হয় দুই লাখ টনের মতো। সরকার বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারদর বিবেচনায় নিয়ে ডিজেলের দাম প্রতিলিটার ১৮ টাকা পর্যন্ত কমাতে পারে। ফার্নেস অয়েলের দাম কমলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমবে এবং তার ফলে শিল্প, বাণিজ্য ও গৃহস্থালি কাজে সুবিধা হবে। কৃষি খাতে সেচ যন্ত্র চালানোর জন্য ডিজেলের ব্যবহার হয়। তবে বাংলাদেশে খুব কম সংখ্যক কৃষকই সেচ যন্ত্রের মালিক। প্রকৃতপক্ষে এ যন্ত্র কেনে সচ্ছল একটি গোষ্ঠী এবং তারা কৃষকদের কাছে পানি বিক্রি করে। ডিজেলের দাম কমিয়ে দিলে কৃষকরা কম দামে পানি পাবে, এমন নিশ্চয়তা কি কেউ দিতে পারবেন?
পেট্রোল-অকটেনের ব্যবহার হয় দামি প্রাইভেটকারে। এর লিটারপ্রতি দাম প্রায় ১০০ টাকা। যখন গাড়ির জন্য সিএনজি গ্যাস সরবরাহ করা হতো না, তখন মালিকরা পেট্রোল-অকটেন দিয়েই গাড়ি চালাত। এ খাত থেকে পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বরাবরই লাভ করছে। এর একটি কারণ বড় লোকেরাই এর ক্রেতা। সরকার যদি পেট্রোল-অকটেনের দাম কমায় তাহলে সিএনজির ওপর চাপ কমে আসতে পারে। আমার প্রস্তাব হচ্ছে, বিশ্ববাজারের মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সরকার এ পণ্যের দাম কমিয়ে আনুক। বিশ্ববাজারে যদি ফের দাম বাড়তে থাকে তাহলে সরকার তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দাম বাড়ালে আপত্তির কারণ থাকবে না।
সরকারকে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। এজন্য কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের ওপর জোর দিতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি আদৌ উৎসাহব্যঞ্জক নয়।
সব শেষ কথা_ জ্বালানি আমদানির জন্য প্রতি বছর বিপুল অর্থ ব্যয় হয়ে থাকে। বিশ্ববাজারে দাম কমার পরও ব্যয়ের অঙ্ক যথেষ্ট বড়। অর্থনীতির নানা শাখায় এবং প্রতিটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনে রয়েছে এর ব্যবহার। সঙ্গত কারণেই জ্বালানি সংক্রান্ত যে সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপে সরকারের দিক থেকে থাকা চাই সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা।
লেখক: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম ও মিনারেল রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান