নাইকোর সঙ্গে চুক্তি ‘অবৈধ’, সম্পত্তি জব্দের নির্দেশ

কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর সঙ্গে এক দশকের বেশি সময় আগে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের করা দুটি চুক্তি অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছে হাই কোর্ট।

আদালত বলেছে,  সুনামগঞ্জের টেংরাটিলায় নাইকোর গ্যাসক্ষেত্রে ২০০৫ সালের বিস্ফোরণের ঘটনায় ক্ষতিপূরণ এবং দুর্নীতির অভিযোগ নিম্ন আদালতে বিচারাধীন দুটি মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নাইকোকে কোনো অর্থ পরিশোধ করা যাবে না।

আর ওই দুই চুক্তির আওতায় নাইকো কানাডা ও নাইকো বাংলাদেশের সব সম্পত্তি এবং ৯ নম্বর ব্লকে থাকা নাইকোর সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।

জনস্বার্থে করা এক রিট আবেদনে গতবছর দেওয়া রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি করে বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এই রায় দেয়।
বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহের জন্য ২০০৩ ও ২০০৬ সালে নাইকোর সঙ্গে দুটি চুক্তি করে বাপেক্স ও পেট্রোবাংলা।

এর মধ্যে একটি ছিল বাপেক্সের সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্বের (জয়েন্ট ভেনচার) চুক্তি। গ্যাস সরবরাহ ও কেনাবেচার জন্য পেট্রোবাংলার সঙ্গে অন্য চুক্তি হয়েছিল।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম ওই দুই চুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে গতবছর মে মাসে জনস্বার্থে এক রিট আবেদন করেন।

ওই রিটের ওপর প্রাথমিক শুনানি করে চুক্তির কার্যকারিতা স্থগিত করে দেয় বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের হাই কোর্ট বেঞ্চ।

সেই সঙ্গে ওই চুক্তি কেন বাতিল করা হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান এবং নাইকো কানাডা ও নাইকো বাংলাদেশকে তার জবাব দিতে বলা হয়।

সেই রুলের ওপর শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার রায় দেয় হাই কোর্ট, যাতে চুক্তি অবৈধ ঘোষণা করে নাইকোর সম্পত্তি জব্দের নির্দেশ দেওয়া হয়।

আদালতে রিট আবেদনকারী পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তানজীব-উল আলম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

আর নাইকোর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান খান। আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের আইনজীবী ব্যারিস্টার মঈন গণিও শুনানিতে ছিলেন।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, “এটা স্বীকৃত যে নাইকো দুর্নীতি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২০০৩ সালে যৌথ অংশীদারিত্ব চুক্তি এবং গ্যাস ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত চুক্তি করে। এ কাজে নাইকো বাংলাদেশে তাদের তৎকালীন এজেন্ট কাসেম শরীফের সঙ্গে চার মিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি করেছিল। তাকে পরে নাইকো বাংলাদেশের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

“এটা স্বীকৃতি যে  কাজ পাওয়ার জন্য বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেনকে উৎকোচ দেওয়া হয়েছিল। যদিও নাইকো বলেছে যে উৎকোচ নয়, উপহার হিসেবে তারা তা দিয়েছিল। কিন্তু এ ধরনের উপহার সামগ্রী দেওয়া বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের লঙ্ঘন।”

কানাডীয় কোম্পানি নাইকো রিসোর্সেস ২০০৩ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাপেক্সকে সঙ্গে নিয়ে ফেনী ও ছাতকে গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নের দায়িত্ব পায়। ওই দুই গ্যাসক্ষেত্রে নাইকোর ৮০ শতাংশ এবং বাপেক্সের ২০ শতাংশ মালিকানা ছিল।

দায়িত্ব পাওয়ার পর ফেনী গ্যাসক্ষেত্র থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ করে আসছিল নাইকো। কিন্তু তাদের অদক্ষতা ও অবহেলার কারণে সুনামগঞ্জের টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রে ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি ও ২৪ জুন দুই দফা বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড ঘটে। তাতে বিপুল পরিমাণ গ্যাস পুড়ে যায় এবং পরিবেশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

ওই বিস্ফোরণের জন্য নাইকোকে দায়ী করে আদালতে যায় পেট্রোবাংলা। সেই মামলায় ৭৪৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়। সেইসঙ্গে ফেনী গ্যাসক্ষেত্র থেকে নাইকোর সরবরাহ করা গ্যাসের দাম পরিশোধ করা বন্ধ করে দেয় সরকার।

ওই অর্থ পরিশোধের দাবি নিয়ে নাইকো আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মামলা করলে ২০১৪ সালে নাইকোর পক্ষে রায় আসে। সেখানে বলা হয়, নাইকোর পাওনা ২১৬ কোটি টাকা সুদসহ পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে।

সংবাদমাধ্যমে আসা খবর অনুযায়ী, নাইকো কুমিল্লার বাঙ্গুরা গ্যাসক্ষেত্রে তাদের অংশ বিক্রি করে বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে পেট্রোবাংলা তাতে আপত্তি তোলে।

টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরণের পর তখনকার বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেন নাইকোর কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে।

ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০০৫ সালের ১৮ জুন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব ছাড়তে বাধ্য হন মোশাররফ।

পরে কানাডার আদালতে নাইকো স্বীকার করে যে, ২০০৫ সালের মে মাসে মোশাররফকে প্রায় ২ লাখ ডলার দামের একটি টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার উপঢৌকন দিয়েছিল তারা। এর বাইরেও বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ বাবদ ৫ হাজার ডলার দেওয়া হয়েছিল তাকে।

ঘুষ দেওয়ার কারণে কানাডার আদালতের রায়ে নাইকোকে ৯৫ লাখ ডলার জরিমানা করা হয়।

নাইকোকে কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগে তখনকার প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ২০০৭ সালে একটি মামলা করে দুদক, যাতে রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি করার অভিযোগ আনা হয়।

ওই মামলা বর্তমানে ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে অভিযোগ গঠনের শুনানি পর্যায়ে রয়েছে।

নাইকোকে কাজ দিয়ে রাষ্ট্রের ক্ষতি করার অভিযোগে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও মামলা করেছিল দুদক।

আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর ২০১০ সালের মার্চে হাই কোর্ট ওই মামলা বাতিল করে দেয়।