পরমাণু বিদ্যুৎ হবে বাংলাদেশের স্বপ্নের ফসল: একান্ত সাক্ষাৎকারে বিজ্ঞানমন্ত্রী

রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রর অবকাঠামো স্থাপন শুরু হচ্ছে। এর মাধ্যমে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মুল কাজ শুরু হবে। আগামী ৩০শে নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই কাজের উদ্বোধন করবেন। দীর্ঘদিনের স্বপ্নের বাস্তবায়ন শুরু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই পর্যায়ে আসার নানা দিক নিয়ে একান্ত কথা হয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের সাথে। তারই অংশ বিশেষ তুলে ধরা হলো।

শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ রূপপুরে পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে কাজ শুরু করতে যাচ্ছে।

এটা ঐতিহাসিক ঘটনা। গর্ব করার মতো ঘটনা। এই পর্যায়ে আসতে পারবো এটা অনেকের সন্দেহ ছিল। স্থানীয়সহ অনেক বিদেশীদের মধ্যেও। এখন সবাই দেখছে বাংলাদেশের যোগ্যতা আছে। বাংলাদেশ যোগ্য। এখন বাংলাদেশকে অন্যরা মূল্যায়ন করছে। আমাদের কাজের মূল্যায়ন করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে দেশ চালাচ্ছে এটা তারই একটা ফল। সেই আত্মবিশ্বাসেই অন্য সব খাত এগিয়ে যাচ্ছে। এই কাজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানসিক শক্তি দিয়েছেন। আর সেই শক্তির জোরে এই পর্যন্ত এসেছি। বিদ্যুৎকেন্দ্রর অবকাঠামো স্থাপনের কাজ শুরু করতে যাচ্ছি।

অনেক দেশ যখন পরমাণু থেকে বের হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে তখন  আমরা এই প্রযুক্তিতে যাচ্ছি।

ফুকুসিমা দুর্ঘটনার পর অনেক দেশ পরমানু থেকে পিছিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল ফুকুসিমায় পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রর দুর্ঘটনার কারণে একজন মানুষও মারা যায়নি। কিম্বা একজন মানুষেরও কোন ক্ষতি হয়নি। কেউ অসুস্থ পর্যন্ত হয়নি। সেখানে সুনামিতে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ মারা গেছে। কিন্তু পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রর জন্য কোন ক্ষতি হয়নি। এই প্রযুক্তি থেকে পিছিয়ে যাওয়ার  যে আওয়াজ উঠেছিল তা অন্য কারণে। বিশ্ববাজার থেকে কেউ কাউকে সরিয়ে দেয়ার জন্য এই প্রযুক্তি থেকে সরে যাওয়ার কথা বলেছিল। সেটা ব্যবসায়ীক বিষয় ছিল। সত্যিকার অর্থে এই প্রযুক্তি ঝুঁকিপূর্ণ কিম্বা নিরাপত্তা ঝুঁকি বেশি এসব কারণে নয়।

আজকের এই পর্যায়ে আসতে বাংলাদেশকেও কোন প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হয়েছে কিনা?

প্রতিবন্ধকতা তো কত থাকেই। কিন্তু এই প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলায় আমরা পাশে পেয়েছি এমন দুই দেশকে যারা আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাশে ছিল। সেই দুই দেশই এখনও এই বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে আমাদের পাশে আছে। যার কারণে সেই প্রতিবন্ধকতা আমাদের ছুঁতে পারেনি। এই দুই বন্ধু দেশ হল রাশিয়া আর ভারত। ফলে বড় কোন প্রতিবন্ধকতা সামনে এসে দাড়াতে পারেনি। এই দুই দেশের সহযোগিতায় আমরা চলেছি। কেউ তো সহজে তার ব্যবসায়কে ছেড়ে দিতে চায় না। সেই প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলায় তারা সহায়তা করেছে। তাদের কারণে প্রতিবন্ধকতা সহজে আসতে পারেনি। রাশিয়া তাদের প্রযুক্তি দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র করে দিচ্ছে। আমাদের ঋণও দিচ্ছে। আর ভারত যেহেতু প্রতিবেশি দেশ তারা আমাদের চেয়ে পরমাণুতে অভিজ্ঞ। তাই তাদের কাছ থেকে জনবল তৈরি আর কারিগরি সহায়তা নেয়া হচ্ছে। আর তাছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে তারাও রাশিয়ার সরকারি প্রতিষ্ঠান। এজন্যও এই পর্যায়ে দ্রুত আসা গেছে।

পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনায় বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা নেই। জনবলও নেই। সে বিষয়ে কী করছেন?

ইয়াফেস ওসমান: জনবল তৈরিতে কাজ চলছে। প্রকৌশলি তৈরির জন্য ৫০ জন রাশিয়াতে পড়ালেখা করতে গেছে। সেখানে তারা পড়ালেখা শেষ করে দুই বছর ঐখানের কোন পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ করবে। তারপর সেখানের সনদ নিয়ে বাংলাদেশে এসে যোগ দেবে। খুব তাড়াতাড়ি আরও ৫০জনকে পাঠানো হবে। এছাড়া কিছু ছেলে মেয়েকে ভারতে পড়ালেখা করতে পাঠানো হবে। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকবে। যত দিন যাবে ততই বাংলাদেশের ছেলে মেয়েরা অভিজ্ঞ হবে।

বর্তমানে যে কাজ হচ্ছে। যে অবকাঠামোর কাজ শুরু হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের অভিজ্ঞ জনবল আছে কী। এটা কীভাবে হচ্ছে।

এখানে রাশিয়ার জনবল আছে। বাংলাদেশেরও অনেকে আছে। আর তাছাড়া ওখানে মানুষের কাজ কম। বসই তো যন্ত্রে হচ্ছে। কম্পিউটারে হচ্ছে। মানুষ দিয়ে কিছুই হবে না। সিমেন্ট, পানি, বালু এগুলো মেশানো হবে যন্ত্র নিয়ে। কম্পিউটারে পরিমান বা পরিমাপ ঠিক করা আছে। সেই অনুযায়ি মেশানো হবে। ফলে কোন ত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সবই ম্যাকানাইজড। ৬৩টি যন্ত্রে কাজ হবে। সেখানের তাপমাত্রা যে নিয়ন্ত্রন হবে তাও হবে কম্পিউটারে।

পরমণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের রাসায়নিক বর্জ্য নিয়ে অনেকের চিন্তা আছে।

রাসায়নিক বর্জ্যরে নিরাপত্তা বেশি নিশ্চিত করতে দুটো চুক্তি করা হয়েছে। পৃথিবীর কোন দেশ এমন চুক্তি করে না। রাশিয়া এই বর্জ্য নিয়ে যাবে। তারা এটা নিয়ন্ত্রণ করবে। এ নিয়ে কোন সমস্যা তৈরি হবে না। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যা যা দরকার তাই করা হচ্ছে। বিভিন্ন দিক থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। আর নিরাপত্তার বিষয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষার বিষয়ও তো আছে।

আছে। সে অনুযায়ি কাজ করা হচ্ছে। পরিবেশ পর্যালোচনা করা হয়েছে। সেই সুপারিশ অনুযায়ি সব পদক্ষেপ নেয়া হবে। ঐ এলাকার জীব বৈচিত্র, নদীর পানি, মাটি, গাছপালা কোন কিছুতেই বিরূপ প্রভাব পড়বে না। ঐ এলাকা পুরো সবুজই থাকবে। মাছ চাষ হবে আগের মতই।

প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে এই কেন্দ্র করতে খরচ বেশি হচ্ছে।

একশ বছর ধরে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ পাব। শতবছর টানা যার ফল পাব তার প্রাথমিক খরচ একটু আধটু কম বেশি কোন সমস্যা না। সব কিছু দরকষাসকির মাধ্যমে করা হয়েছে। প্রয়োজনের বেশি খরচ করা হয়নি।

বাংলাদেশে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে। এর বর্তমান ভবিষ্যৎ সামগ্রিক বিষয় নিয়ে  কিছু বলেন।

ইয়াফেস ওসমান: দেশের উন্নয়নের জন্য পারমানবিক জ্বালানির বিকল্প নেই। পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে শুধু বিদ্যুতের চাহিদাই পূরণ হবে না, মানুষের সার্বিক মনোভাবও পাল্টে যাবে। পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে আমরা নিজেদের উন্নত চিন্তা চেতনার মধ্যে নিয়ে যেতে পারবো। শান্তিপ‍ূর্ণ উপায়ে পরমাণু শক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশ প্রতিশ্রæতিবদ্ধ। পৃথিবীতে ৩২ তম দেশ হবে বাংলাদেশ, যারা পরমাণু বিদ্যুৎ ব্যবহার করবে। বাংলাদেশের কেউ যখন অন্য দেশে যাবে তখন তারা পরমাণু ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে সম্মান পাবে। বিদ্যুৎ দেশের মানুষের জীবনকে পাল্টে দিয়েছে। গ্রামে যেখানে বিদ্যুৎ ছিল না সেখানে সন্ধ্যার পর মানুষের ঘুমানো ছাড়া কোন কাজ ছিল না। এখন সেই সব জায়গাতে ছোট ছোট শিল্প হয়েছে। জীবন যাপন যেমন পাল্টেছে জীবিকার ধরণও পরিবর্তন হয়েছে। ২০২১ সালে মধ্য আয়ের এবং ২০৪১ সালের উন্নত দেশ হওয়ার যে ¯^প্ন তা বাস্তবায়নে এই কেন্দ্র উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ হবে।

ধন্যবাদ আপনাকে।

তোমাকেও ধন্যবাদ।