বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা জাতীয় কমিটি প্রস্তাবিত খসড়া রূপরেখা

সরকার আবারো বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর আয়োজন করছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম যখন গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমেছে, তখন এই পুরো সময় বাংলাদেশ সরকার এর দাম বাড়িয়েছে। ফলে অর্থনীতির সব খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমছে এবং জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় ক্রমাগত বেড়েছে। সরকারের এই ভূমিকা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। দেশী-বিদেশী কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থে যে মহাপরিকল্পনা নিয়ে সরকার অগ্রসর হচ্ছে, তার অপরিহার্য পরিণতি— নিয়মিতভাবে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি।

এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকার সফল হতে থাকলে শুধু দ্রব্যমূল্য, উত্পাদন ব্যয় বৃদ্ধিতে মানুষের ভোগান্তি বাড়বে তা-ই নয়, দেশ আরো বড় বিপদের সম্মুখীন হবে। ঠিক এ সময়ে দেশ নিপীড়িত রোহিঙ্গা মানুষের অবিরাম প্রবাহে বিপর্যস্ত। কিন্তু সরকারের সুন্দরবনবিনাশী রামপাল প্রকল্প, দেশবিনাশী রূপপুর প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এর চেয়ে বহুগুণ বেশি মানুষ দেশের ভেতরেই উদ্বাস্তু হবে। এর পরিণতি চিন্তা করাও কঠিন।

আমরা যখন বঙ্গোপসাগরের গ্যাস নিয়ে রফতানিমুখী চুক্তির বিরোধিতা করি, তখন সরকারের মন্ত্রী মিয়ানমারের তুলনা টানেন। গ্যাস-তেল প্রচুর রফতানিসহ যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত আর রাশিয়ার সঙ্গে মিলে দেশের ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর স্বার্থে উন্নয়ন মডেল সাজালে পরিণতি কী হয়, বিপুল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি তার প্রমাণ। আমরা বলি, বাংলাদেশ নাইজেরিয়া হবে না, মিয়ানমারও হবে না।

তাই সরকার যখন পশ্চাত্মুখী, লুণ্ঠন ও ধ্বংসমুখী, নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক উন্নয়ন দর্শনের অধীনে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে, তখন প্রায় দুই দশকের জন-আন্দোলনের শক্তি ও আকাঙ্ক্ষার ওপর দাঁড়িয়ে আমরা গত ২২ জুলাই তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে ভবিষ্যত্মুখী, প্রগতি ও সমতামুখী, গণতান্ত্রিক, প্রাণ-প্রকৃতি ও মানুষপন্থী উন্নয়ন চিন্তার কাঠামোতে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছি।

সরকারি মহাপরিকল্পনার (পিএসএমপি ২০১৬) বৈশিষ্ট্য

দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে সরকার জাপানের জাইকার কনসালট্যান্টদের মাধ্যমে, অনেক টাকা খরচ করে ২০৪১ পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতের জন্য একটি মহাপরিকল্পনা (পিএসএমপি ২০১৬) চূড়ান্ত করেছে। এ মহাপরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:

এ ‘মহাপরিকল্পনা’ বিদেশী তহবিল ও বিশেষজ্ঞনির্ভর। দলিলের ‘স্টাডি টিমের’ তালিকা এর প্রমাণ। ইংরেজিতে প্রণীত এ দলিলে জাপানি ব্যবসায়িক সংস্থার যুক্ততাও স্পষ্ট। এ মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে: Japan International Cooperation Agency (JICA), Tokyo Electric Power Services Company Limited, Tokyo Electric Power Company Holding, Inc.

এ ‘মহাপরিকল্পনা’য়  বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি, জনবসতি, সম্পদের আপেক্ষিক অবস্থান, জাতীয় সক্ষমতা, পরিবেশগত ঝুঁকি, আর্থিক সামর্থ্য ও জনস্বার্থের প্রশ্ন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে।

এ ‘মহাপরিকল্পনা’ প্রণয়নের আগেই তার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন নতুন প্রকল্পের তালিকা থেকে এটি নিশ্চিত যে, দেশী-বিদেশী বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর প্রভাব অনুযায়ী তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন শুরু করেছে।

এ ‘মহাপরিকল্পনা’ অনুযায়ী বিদ্যুৎ খাতের প্রতিটি প্রকল্পই হবে বিদেশী কোম্পানিভিত্তিক, আমদানি ও ঋণনির্ভর। এছাড়া বিদ্যুৎ উত্পাদনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরিবেশবিধ্বংসী উচ্চব্যয়বহুল বিদ্যুৎ উত্পাদনকেই অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।

যথাযথ পরিবেশ সমীক্ষা ছাড়া জনসম্মতির বিরুদ্ধে অনিয়ম, বল প্রয়োগ করে সুন্দরবনবিনাশীসহ প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র, ৭ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র এবং সম্পূর্ণ আমদানি করা এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন প্রকল্পকে যৌক্তিকতা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এতে।

এ ‘মহাপরিকল্পনা’য় দেশের স্থলভাগ এবং গভীর ও অগভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। এছাড়া এতে দেশীয় গ্যাস সম্পদের সম্ভাবনা নিয়ে উদ্দেশ্যমূলক নীরবতার পাশাপাশি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য সম্পূর্ণই আমদানিকৃত এলএনজির ওপর নির্ভর করা হয়েছে। একদিকে দেশে গ্যাস সংকটের অজুহাত দিয়ে এলএনজি, কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করা হয়েছে, অন্যদিকে বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে গ্যাস রফতানির বিধান রেখেই একের পর এক চুক্তি করা হচ্ছে।

একই কারণে মহাপরিকল্পনায় নিয়মিতভাবে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে স্পষ্টই উল্লেখ করা আছে, ‘এলএনজি আমদানি ও গ্যাসের আন্তর্জাতিক দাম বিবেচনায় প্রতি বছর ১৯ থেকে ২৯ শতাংশ হারে গ্যাসের  মূল্যবৃদ্ধি করতে হবে।’

সারা বিশ্বে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উত্পাদনের ক্ষতি অভূতপূর্ব হারে বৃদ্ধি পেলেও এ ‘মহাপরিকল্পনা’য় তার কোনো প্রতিফলন নেই। বরং আন্তর্জাতিকভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যয় দ্রুতগতিতে কমে এলেও এ দলিলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যয়ের চিত্রটি অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।

সরকারের মহাপরিকল্পনায় যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, তার অনেকগুলোই দেশের সংবিধান ও আইন পরিপন্থী।

গ্যাস, কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ

বাংলাদেশে জীবাশ্ম জ্বালানি বিপুল পরিমাণে না থাকলেও যতটুকু আছে তার সর্বোত্তম ব্যবহার কখনই সম্ভব হয়নি। আশির দশক থেকে বিভিন্ন ভুল নীতি ও দুর্নীতির অংশ হিসেবে বহুরকম ক্ষতিকর চুক্তি হয়েছে। তার ফলে দেশের সম্পদ বিপদ ও ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছে। যথাযথ নীতি গ্রহণ করলে ২০৪১ সাল পর্যন্ত দেশের গ্যাসের চাহিদা নিজেদের গ্যাস থেকেই মেটানো সম্ভব। কিন্তু সেই লক্ষ্যে (১) গ্যাস নিয়ে রফতানিমুখী চুক্তি বাতিল করতে হবে (২) বাপেক্সকে কাজের সুযোগ দিতে হবে, জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ঘটাতে হবে এবং (৩) স্থলভাগ, গভীর ও অগভীর সমুদ্রে নিয়মিতভাবে অনুসন্ধান চালাতে হবে।

এটি প্রমাণিত যে, বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি, পানিসম্পদ ও জনবসতি বিবেচনায় বিদ্যমান প্রযুক্তি ও নীতিমালা মোটেই দেশের কয়লাসম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের পথ নয়। কেননা কৃষিজমি, পানি ও স্থানীয় মানুষের সর্বনাশ করে কতিপয় গোষ্ঠীর হাতে বাংলাদেশের কয়লাসম্পদ তুলে দেয়া যায় না। তাছাড়া সব তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, বিদ্যুৎ উত্পাদনে কয়লার ব্যবহার আর্থিক, কারিগরি, পরিবেশগত কোনো দিক থেকেই এখন আর অনুকূল নয়। যদি বিকল্প পথে কম ব্যয়ে, কম ঝুঁকিতে ও কম দূষণে বিদ্যুৎ উত্পাদন সম্ভব হয়, তবে সে পথ গ্রহণ করাই দায়িত্বশীল হবে।

পারমাণবিক বিদ্যুতের দিকে যাওয়ার ক্ষেত্রেও আমাদের নীতি পরিবর্তন করতে হবে। এর চেয়ে কম ব্যয়বহুল ও কম ঝুঁকিপূর্ণ বিকল্প পন্থা যেহেতু রয়েছে, এই বিপজ্জনক নীতি গ্রহণ অপ্রয়োজনীয়। তবে পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কে জ্ঞান ও বিজ্ঞানচর্চার জন্য একটি ৫০ বা ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুেকন্দ্র থাকতে পারে, যা প্রধানত গবেষণাগার হিসেবে ব্যবহার হবে। এতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের সক্ষমতা প্রকাশের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতার নজির থাকবে।

বিভিন্ন জ্বালানির তুলনামূলক খরচ

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা ও তথ্য সন্নিবেশ করে দেখা যাচ্ছে যে, নবায়নযোগ্য  উৎস থেকে পুঁজি বিনিয়োগ, বিদ্যুৎ উত্পাদন খরচ ও একক চলতি খরচ দুই ক্ষেত্রেই গত ১০ বছরে দাম কমেছে ৫০ শতাংশের বেশি। জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি ইউনিট সৌরবিদ্যুতের দাম ২০১০ থেকে পাঁচ বছরে কমেছে ৫৮ শতাংশ। ২০২৫ সাল পর্যন্ত এ দাম আরো ৫৯ শতাংশ কমবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে।  সরকারি পিএসএমপিতেও স্বীকার করা হয়েছে যে, ২০৪০ পর্যন্ত সৌরবিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট কমবে ৫০ শতাংশ, বায়ুবিদ্যুৎ কমবে ৩০ শতাংশ এবং ব্যাটারির দাম কমবে ৪৫ শতাংশ। অন্যদিকে জীবাশ্ম  জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুতের দাম বাড়বে ৪৫ শতাংশ। তার পরও যার দাম কমবে সেই পথে না গিয়ে যার দাম বাড়বে সরকার সেই পথেই যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বর্তমান প্রাপ্ত প্রযুক্তিতে শতভাগ সম্ভাবনা বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব ১ লাখ ২০ হাজার মেগাওয়াট, ইনস্টিটিউট অব এনার্জি অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের গবেষণা অনুযায়ী, শতভাগ সম্ভাবনা বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব ২ লাখ ৪০ হাজার মেগাওয়াট। আমেরিকান জার্নাল অব ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ অনুযায়ী, বায়ুবিদ্যুৎ পাওয়া যাবে ২০ হাজার মেগাওয়াট।

বাংলাদেশের জন্য জাতীয় কমিটির রূপরেখা

স্বল্পমেয়াদে (২০২১ সাল পর্যন্ত) আমরা বিদ্যুৎ উত্পাদনের বিদ্যমান কাঠামোতে অল্প পরিবর্তনের সুপারিশই করেছি। তবে এ সময়ে আমাদের মূল প্রস্তাবনা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনসহ জাতীয় কমিটির সাত দফা বাস্তবায়ন। এ সময়ের মধ্যে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ-সংক্রান্ত পরিকল্পনার আমূল পরিবর্তন করে জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে বিপুল গবেষণা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। স্থলভাগ ও সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বাপেক্সকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথে অগ্রসর হতে সামগ্রিক প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ এ সময়ের প্রধান করণীয়। ২০২১ সালের মধ্যে আমাদের প্রস্তাবিত কাঠামোতে মোট বিদ্যুৎ উত্পাদনের মধ্যে গ্যাস থেকে ৫৯ শতাংশ, তেল থেকে ১৯, নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ১০ (৫% সৌর, ৩% বায়ু ও ২% বর্জ্য) এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা থেকে আসবে ৭ শতাংশ বিদ্যুৎ।

মধ্যমেয়াদে (২০৩১ পর্যন্ত) পুরনো গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস পাওয়ার হার হ্রাস পেলেও যথাযথভাবে অনুসন্ধান করলে গভীর ও অগভীর সমুদ্র থেকে নতুন পর্যায়ে গ্যাস সরবরাহ শুরু হবে। এছাড়া তত দিনে নবায়নযোগ্য উৎসগুলো ব্যবহারের সক্ষমতাও অনেক বৃদ্ধি পাবে। এ সময়কালেও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ শীর্ষস্থানে থাকবে— ৪৯ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে থাকবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি— ৩৯ শতাংশ (২৭% সৌর, ৭% বায়ু, ৫% বর্জ্য), তেল ৭ শতাংশ এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা ৫ শতাংশ।

দীর্ঘমেয়াদে গুণগত পরিবর্তন নিশ্চিত করে নবায়নযোগ্য উৎস থেকেই বিদ্যুৎ উত্পাদন শীর্ষস্থানে পৌঁঁছবে। সেজন্য ২০৪১ নাগাদ বিদ্যুৎ উত্পাদনের ৫৫ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আনা সম্ভব হবে (এর মধ্যে সৌর ৪২%, বায়ু ৮%, বর্জ্য  ৫%)। দ্বিতীয় স্থানে থাকবে প্রাকৃতিক গ্যাস— ৩৭ শতাংশ। তেল ও আঞ্চলিক সহযোগিতা ৮ শতাংশ।

বিনিয়োগ/ দাম: তুলনামূলক চিত্র

সরকারি মহাপরিকল্পনায় ২০৪১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন খাতে বিদ্যুৎ উত্পাদনে ১২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এতে প্রাথমিক জ্বালানি খরচ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সর্বশেষ বাজেটে সরকার রূপপুরসহ বিভিন্ন বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করেছে ৩১ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা। জাতীয় কমিটির বিনিয়োগ প্রস্তাবনায় ব্যাটারি খরচসহ আগামী ২৫ বছরে প্রয়োজন হবে সর্বোচ্চ ১১০ বিলিয়ন ডলার।

দেশে ২০০৬-৭ সালে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ছিল গড়ে ইউনিটপ্রতি ২ দশমিক ২৬ টাকা। গত ১০ বছরে কয়েক দফা মূল্যবৃদ্ধির পর সর্বশেষ হিসাবে এই দাম দাঁড়িয়েছে ইউনিটপ্রতি ৬ দশমিক ৭৩ টাকা। পিএসএমপি ২০১৬ অনুযায়ী গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম প্রতি বছর বাড়াতে হবে। ফলে সরকারি পরিকল্পনায় চলতি দামে ২০৪১ সালে বিদ্যুতের যত দাম হবে, জাতীয় কমিটির প্রস্তাবিত পরিকল্পনা অনুযায়ী দাম হবে তার প্রায় অর্ধেক। আবার ২০১৫ সালের দাম স্তর অনুযায়ী, ২০৪১ সালে সরকারি পরিকল্পনায় বিদ্যুতের দাম জাতীয় কমিটির প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় বিদ্যুতের দামের তুলনায় হবে দ্বিগুণেরও বেশি। জাতীয় কমিটির প্রস্তাবিত রূপরেখায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে পিএসএমপিতে ব্যবহূত পদ্ধতিই অনুসরণ করা হয়েছে। সৌর ও বায়ুভিত্তিক বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল রিনিউয়েবল এনার্জি এজেন্সি’ প্রদত্ত প্রাক্কলিত আন্তর্জাতিক দামকে অনুসরণ করা হয়েছে। তেলভিত্তিক বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে ফার্নেস তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ ও ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুতের গড় মূল্য ধরে পিএসএমপিতে ব্যবহূত পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। (সূত্র: সরকারের বিদ্যুতের দামের জন্য পিএসএসপি ২০১৬ পৃ. ২১-৪ এবং summary, tariff policy: electricity tariff. জাতীয় কমিটির প্রস্তাবিত দামের জন্য প্যানেল বিশ্লেষণ।)

অনেক ভালো পথ সম্ভব

উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও বিদ্যুৎ উত্পাদনের নামে সরকার যেসব বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করেছে, তার অধিকাংশই বাংলাদেশের মানুষ ও প্রকৃতির জন্য পরিবেশগত দিক থেকে ভয়াবহ এবং অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। অবিশ্বাস্য একগুঁয়েমি নিয়ে সরকার সুন্দরবনবিনাশী প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে কাজ করছে। ভারত ও চীন নিজ নিজ দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ থেকে দ্রুত সরে আসার নীতিগত, আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তাদের পরিত্যক্ত প্রযুক্তি দিয়ে বাংলাদেশে তৈরি করা হচ্ছে আত্মঘাতী সব প্রকল্প। ভারত, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র আর দেশী কিছু বনগ্রাসী-ভূমিগ্রাসী-কমিশনভোগী গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে বাংলাদেশের জন্য তৈরি হচ্ছে সর্বনাশা পথ। সম্প্রতি সরকার আবারো রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের পথে যাচ্ছে এবং এজন্য পুঁজি জোগান দিতে ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ দেয়া হচ্ছে। গত দুই বছরের গবেষণা ও বিশ্লেষণ থেকে আমরা নিশ্চিত যে, বিদ্যুৎ উত্পাদনের জন্য এসব পথ অপরিহার্য নয়; বিদ্যুতের জন্য রামপাল রূপপুর কোনোভাবেই প্রয়োজনীয় নয়, বরং মহাবিপদের উৎস। শুধু পরিবেশগত বিচারেই নয়, বিনিয়োগ, দামসহ নিরাপত্তা ও স্বাধীন অগ্রগতি বিচারে বহুগুণে উত্কৃষ্ট পথের সন্ধান আমরা ইচ্ছা করলেই পেতে পারি। আমরা সেই রূপরেখাই দেশবাসীর সামনে হাজির করেছি। আমরা চাই, এ খসড়া নিয়ে বিশেষজ্ঞসহ সমাজের সব স্তরের মানুষের আলোচনা ও অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রকৃত উন্নয়ন ধারার পক্ষে অপ্রতিরোধ্য জনমত তৈরি হোক।

(তথ্যসূত্র: জাতীয় কমিটির গবেষণা প্যানেল।)