বিদ্যুৎ লাইন যেন মৃত্যুফাঁদ

বিদ্যুৎ লাইনে মৃত্যু থামছে না। প্রতিনিয়ত এ দুর্ঘটনা ঘটছেই। বিদ্যুতের লাইন যেন মৃত্যুদূত হয়ে দেখা দিয়েছে।
সম্প্রতি রাজধানীর ডেমরার পূর্ব শেখদি এলাকায় একটি নির্মাণাধীন দোতলা বাড়ির ছাদে কাপড় শুকাতে ওঠেন গৃহিনী জাহানার বেগম। সঙ্গে ছিল তার মেয়ে শারমিন (১৩)। ছাদের একটি বাঁকা রড সোজা করতে গেলে ভবনটির পাশ ঘেঁষে যাওয়া ১১ হাজার ভোল্টের (১১ কেভি) বিদ্যুত্ লাইনে স্পর্শ হয়। এতে বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়ে মারা যান মা ও মেয়ে। তাদেরকে রক্ষা করতে এগিয়ে যাওয়া অন্য দুইজনও গুরুতর আহত হয়।
গত ২৮শে ডিসেম্বর রাতে যাত্রাবাড়ীর শেখদি পানির পাম্পের সামনের বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে একটি তার ছিঁড়ে পড়ে। নিচে রাস্তায় ছিল জমে থাকা পানি। কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার পথে ওই পানিতে পা ফেলে বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়ে মারা যান পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম বিপ্লব (৩২)। জিগাতলায় বাসার বারান্দা থেকে একটি পাখি দেখে হাত বাড়ায় ৭ বছরের শিশু রাফসান নূর। কিন্তু পাখিটি বসা ছিল ১১ কেভির একটি বৈদ্যুতিক তারের ওপর। ওই তার থেকে বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়ে গুরুতর আহত রাফসান এখনো সুস্থ হয়ে ওঠেনি। বংশাল এলাকার মোহাম্মদীয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসার পাশে থাকা একটি ট্রান্সফরমার গত ১০ই ফেব্রুয়ারি বিস্ফোরিত হয়। এর তেল ছিটকে পড়ে ছয় ছাত্র দগ্ধ হয়। বিদ্যুত্স্পৃষ্টে এমন হতাহতের ঘটনা সারাদেশে নিয়মিতই ঘটছে। বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থাগুলোর কাছে এর যথাযথ তথ্যও নেই। এ ধরনের দুর্ঘটনার ব্যাপকতা কিছুটা অনুমান করা যায় ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের তথ্যে। এ বিভাগে ২০১৭ সালে চিকিৎসা নেয়া ২৮ শতাংশ রোগীই বাড়ির আশেপাশে টানানো তারে স্পৃষ্ট হয়ে দগ্ধ ও আহত এবং ১৯ শতাংশই বৈদ্যুতিক খুঁটির তার ছিঁড়ে দুর্ঘটনায় পড়েন। ২০১৬ সালে দগ্ধ রোগীদের মধ্যে যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে ৪২ শতাংশ বিদ্যুত্স্পৃষ্ট রোগী। গত ছয় মাসের পত্রিকা ঘেঁটে সাড়ে চারশ’র বেশি বিদ্যুত্স্পর্শে দুর্ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে। এ ধরনের দুর্ঘটনায় ঝরে গেছে দেড়শ’র বেশি প্রাণ। অথচ নিয়ম অনুযায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে এমন দুর্ঘটনাও ঘটতো না, প্রাণহানিও হতো না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, নিরাপত্তা মানদণ্ড না মেনে বিদ্যুৎ লাইন সম্প্রসারণ ও সংযোগ দেয়ার কারণে এমন দুর্ঘটনা ঘটছে। এগুলো নিছক দুর্ঘটনা নয়। বিদ্যুৎ লাইনের সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে বিতরণকারী সংস্থাগুলোর ভুল এবং অবহেলার কারণে এমন দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির শিকার হচ্ছে জনগণ।

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান বলেন, বহুতল ভবন নির্মাণের সময়ও অনেকে উপর দিকে ভবনের আওতা বাড়িয়ে নেন। ফলে ভবনটি বৈদ্যুতিক তার বা ট্রান্সফরমারের কাছাকাছি চলে আসে। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। বসতবাড়ি থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে নতুন লাইন নির্মাণের সময় আমরা চেষ্টা করি। তবে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অনেক সময় এটি শতভাগ বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। এজন্য নতুন সব সংযোগই ইনসুলেটেড (বিদ্যুত্ অপরিবাহী আবরণযুক্ত) তারে দেয়া হচ্ছে। পুরনো সংযোগগুলো ইনসুলেটেড তারে রূপান্তরের চেষ্টা চলছে। ভূগর্ভস্থ বিদ্যুত্ লাইন নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। অর্থসংস্থান সাপেক্ষে সম্প্রসারণ এলাকা বাড়বে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সারাদেশে ১০ হাজার ৬২২ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন এবং চার লাখ ২৯ হাজার কিলোমিটার বিতরণ লাইন রয়েছে। বিদ্যুত্ ব্যবহার করছে প্রায় পৌনে তিন কোটি গ্রাহক। শহরের বিভিন্ন এলাকায় এবং গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুত্ সঞ্চালন লাইনের তার খোলা (অপরিবাহী আচ্ছাদন ছাড়া)। ১১ কেভি বা ৩৩ কেভির এ লাইনগুলো অনেক স্থানে বসতবাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। কোথাও ফসলের ক্ষেত বা হাট-বাজারের ওপর দিয়ে। বড় গাছের ভেজা ডালপালা এসব তারের স্পর্শে এসে বিদ্যুতায়িত হয় এবং দুর্ঘটনা ঘটে। বিতরণকারী অফিসগুলোর কর্মীরা এগুলো রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন খুব কমই। স্থানীয়দেরকে নানাভাবে তদবির করিয়ে ওই ধরনের গাছের ডালপালা ছাঁটতে হয়। রাজশাহীসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাঁশ এমনকি গাছ ব্যবহার করেও বিদ্যুত্ লাইন টানতে দেখা গেছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় বিতরণ লাইনের তার ছিঁড়ে নিচে পড়ে থাকলেও তা মেরামত করতে দেরি করে স্থানীয় বিদ্যুত্কর্মীরা।

পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) সাবেক এক সদস্য বলেন, মাঠ পর্যায়ের অধিকাংশ বিদ্যুত্ কর্মীই বিদ্যুত্ লাইন রক্ষণাবেক্ষণ ও নিয়মিত টহলের গুরুত্ব বুঝেন না। আবার কেউ কেউ টাকা না পেলে নড়তেও চান না। ফলে প্রতিরোধযোগ্য এ দুর্ঘটনা বন্ধ করা যাচ্ছে না। বিদ্যুত্ বিভাগের নীতি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, বিদ্যুত্ সংযোগ বৃদ্ধির সঙ্গে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার করা দরকার। সরকার সেই চেষ্টা করছেও। কিন্তু অনেকক্ষেত্রে জনগণ অসচেতনতা বা অসাবধানতার কারণে দুর্ঘটনায় পড়ে। তাই ব্যবস্থাপনাগত সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জনসচেতনতা বাড়ানোর কাজ চলছে। শিগগিরই এক্ষেত্রে ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যাবে।