ভোলায় নতুন গ্যাস ও ভূখণ্ডে আরও অনুসন্ধান

ভোলায় শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র এলাকায় খননকৃত নতুন কূপে গ্যাসের খোঁজ মিলেছে। দেশে তীব্র গ্যাস-সংকটের সময় ভোলার শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র এলাকায় খননকৃত নতুন কূপে গ্যাসের সন্ধান একটি শুভ সংবাদ। গ্যাস অনুসন্ধান কাজটির ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানী কোম্পানি বাপেক্স এবং কূপটি খননে নিয়োজিত রাশিয়ার গাজপ্রম কোম্পানি উভয়েই এ জন্য অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। ২৩ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ সভায় মন্ত্রিপরিষদ সচিব আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন যে ভোলার শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে তিন কিলোমিটার দূরে একটি নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এটিতে ৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস মজুত রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। এ ঘোষণাটি ওই সভায় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দেওয়া হয় বিধায় তার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।

কিন্তু দেশের ভূবিজ্ঞানী ও তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অভিজ্ঞ ভূতত্ত্ববিদদের মধ্যে উপরিউক্ত বিষয়ে দুটি প্রশ্ন জেগেছে। প্রথমত, ভূগর্ভের কোনো স্তরে গ্যাসের অস্তিত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়ার আগে কূপের ভেতর থেকে ভূপৃষ্ঠে গ্যাসপ্রবাহ ঘটানোর যে প্রথা রয়েছে, তা করা হয়েছে কি না। দ্বিতীয়ত, যদি ধরে নেওয়া হয় যে এখানে গ্যাসের অস্তিত্ব নিশ্চিত, তবে তা কি নতুন গ্যাসক্ষেত্র, নাকি শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের একটি বর্ধিত অংশ?

প্রথম প্রশ্নটির ব্যাপারে জানা যায় যে গ্যাস নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করার জন্য গ্যাসের প্রবাহ ঘটানোর যে পরীক্ষা, যা কিনা ড্রিল স্টেম টেস্ট বা ডিএসটি নামে পরিচিত, তা এখনো করা হয়নি। তবে এ কাজ করার সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে এবং তা দু-এক সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন হবে। ভোলার নতুন কূপে গ্যাসের অস্তিত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে অয়েল লগের চিহ্ন, অর্থাৎ কূপের ভেতর চালিত যন্ত্রে প্রাপ্ত রেখাচিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে। অধিকাংশ সময়ই এ ধরনের বিশ্লেষণ সঠিকভাবে গ্যাসস্তর নির্ধারণ করতে পারে কিন্তু তা শতভাগ ক্ষেত্রে নয়। অতীতে বাপেক্সের কোনো কোনো কূপে অয়েল লগ বা রেখাচিত্রে গ্যাসের ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও তাতে ডিএসটি পরীক্ষায় গ্যাসপ্রবাহ ঘটাতে সক্ষম হয়নি। ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, আমরা ধরে নিই যে দু-এক সপ্তাহের মধ্যে ভোলার কূপে পরিকল্পিত ডিএসটি বা গ্যাসপ্রবাহ পরীক্ষা সার্থক হবে, সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকেই যায় যে  গ্যাসপ্রাপ্তির ঘোষণাটি তারপর দেওয়া যেত না? ভূতত্ত্ববিদদের মতে, ডিএসটি পরীক্ষার মাধ্যমে গ্যাসের প্রবাহ প্রমাণ করার আগে গ্যাসপ্রাপ্তির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া অপেশাদারির লক্ষণ।

দ্বিতীয় প্রশ্ন যে ভোলার কূপটি একটি নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার কি না, তা নিয়েও প্রদত্ত ঘোষণার বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন দেশের ভূবিজ্ঞানীরা। ঘোষণা অনুযায়ী কূপটির অবস্থান শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের কূপসমূহ থেকে তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রটি ১৯৯৪ সালে বাপেক্স কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়। এখানে সাইসমিক বা ভূকম্পন জরিপের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কূপ খনন করে গ্যাসপ্রাপ্তি সার্থকতা লাভ করে। সাইসমিক জরিপের মাধ্যমে এখানে ভূগর্ভে একটি ভূকাঠামো (শিলাস্তরে ঊর্ধ্বভাঁজ) পাওয়া যায়, যা দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে উভয় দিকেই তিন কিলোমিটারের অনেক বেশি বিস্তৃত। ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, ভোলার নতুন কূপটির অবস্থান উপরিউক্ত কাঠামোর মধ্যেই পড়ে। সুতরাং এটি কোনো নতুন গ্যাসক্ষেত্র নয়, বরং শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের একটি বর্ধিত অংশ। আশার কথা এই যে এই নতুন কূপে গ্যাস আবিষ্কারের মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয় যে শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র যতটা বিস্তৃত ও যতটা গ্যাস মজুত ধারণ করে বলে আগে হিসাব করা হয়েছিল, প্রকৃত অবস্থায় তা তার চেয়ে বেশি।

উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে ভোলায় অবস্থিত শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রটির ওপর নজর পড়েছিল মার্কিন তেল কোম্পানি ইউনিকলের। সে সময় তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ইউনিকল বুঝতে পারে যে এই গ্যাসক্ষেত্রটিতে সে সময় জানামতে গ্যাস মজুতের চেয়ে অনেক বেশি গ্যাস রয়েছে। সে অনুযায়ী পেট্রোবাংলার সঙ্গে ইউনিকল একটি যৌথ সমীক্ষা চালায়, যাতে এটি দেখানো হয় যে গ্যাসক্ষেত্রটিতে বাপেক্স কর্তৃক নির্ধারিত মজুত ৫০০ বিসিএফ সঠিক নয়, বরং তা তার দ্বিগুণের বেশি, অর্থাৎ প্রায় ১ হাজার ২০০ বিসিএফ। ১৯৯৯ সালে ইউনিকল বাংলাদেশ সরকারকে এক বিলিয়ন ডলারের একটি বৃহৎ প্রকল্প প্রস্তাব দেয়, যাতে ইউনিকল শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়ন করা এবং খুলনা-বরিশালসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে পাইপলাইন ও এই গ্যাসভিত্তিক একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার কথা বলে। পরবর্তী সময়ে ইউনিকল নানা কারণে দেশে বিতর্কিত হয়ে উঠলে এ প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়নি। তবে এ থেকে এটি প্রমাণিত হয় যে কেবল বাপেক্স নয়, বরং বিদেশি কোম্পানির জরিপেও শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র বৃহৎ আকারের বলে প্রতীয়মান হয়।

বাংলাদেশের জাতীয় গ্যাস অনুসন্ধানী প্রতিষ্ঠান বাপেক্স একটি সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠান। এখানে চালিকা শক্তির মূলে রয়েছেন তরুণ প্রতিভাবান ভূবিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও অন্যান্য কারিগরি ব্যক্তিরা। তাঁরা যে উপরিউক্ত বিষয়গুলো বোঝেন না, তা নয়। কিন্তু সরকারি উচ্চপর্যায়ে কিছু অতি উত্সাহী ব্যক্তির নিজস্ব অ্যাজেন্ডা তথা সরকারি সর্বোচ্চ পর্যায়ের সুনজর, সরকারদলীয় রাজনীতির ছায়ায় জনগণের জনপ্রিয়তা ও সাধুবাদ অর্জনের চেষ্টা ইত্যাদি কারণে বাপেক্সের প্রকৃত নিষ্ঠাবান কর্মীরা তাঁদের পেশাদারত্ব বজায় রাখতে পারেন না। তাই কখনো বা ওপরমহলের অতি উত্সাহী ব্যক্তির চাপে গ্যাসপ্রবাহ ঘটানোর আগেই গ্যাসপ্রাপ্তির ঘোষণা, গ্যাসক্ষেত্রের দূরবর্তী গ্যাসকূপকে নতুন গ্যাসক্ষেত্র বলে প্রচার ইত্যাদি ঘটে থাকে। তাতে এসব কাজের যে গুরুত্ব ও উচ্চমান তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।

দুই

বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধানের গত ১০ বছরের ধারা লক্ষ করলে এটি বোঝা যায় যে এখানে গ্যাস অনুসন্ধানের মাত্রা বা গতি অতি দুর্বল। গত ১০ বছরে গড়ে প্রতিবছর একটি কূপও খনন করা হয়নি, যা কিনা যেকোনো মানদণ্ডে কেবলই তুচ্ছ বলে বিবেচিত হয়। অথচ বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক গঠন গ্যাস সম্ভাবনার মোক্ষম স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। বিশ্বে সর্বত্র বদ্বীপ অঞ্চল তেল-গ্যাসে সমৃদ্ধ। বাংলাদেশ বিশ্বের সর্ববৃহৎ বদ্বীপ দিয়ে গঠিত। এ দেশে প্রকৃতপক্ষে অনুসন্ধানকাজের স্বল্পতা ও দুর্বল গতিই গ্যাসসম্পদের প্রকৃত সম্ভাবনাকে উন্মুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে।

১৯৬০-এর দশকে শেল অয়েল কোম্পানি কর্তৃক দেশের পূর্বাংশে সহজভাবে শনাক্তকৃত ভূতাত্ত্বিক কাঠামোসমূহে পরপর পাঁচটি বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বের গ্যাস মানচিত্রে তার স্থান করে নেয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অনুসন্ধানকাজের সেই ধারা আর বজায় থাকেনি। যেটুকু অনুসন্ধান করা হয়েছে, তা নেহাতই অল্প। সব অনুসন্ধানকাজ কেবল সহজভাবে শনাক্ত হওয়া দেশের পূর্বাংশে ঊর্ধ্বভাঁজ-জাতীয় ভূতাত্ত্বিক কাঠামোতেই সীমাবদ্ধ থাকে। অথচ তার বাইরেও অবস্থানকারী জটিলতর অথচ সম্ভাবনাময় স্থানসমূহে কোনো কূপ খনন করা হয়নি। তা ছাড়া অসনাতনী কাঠামোসমূহ, যা কিনা বিশ্বের বহু স্থানে প্রচুর গ্যাস-তেল ধারণকারী বলে প্রমাণিত, তার কোনো অংশই অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়নি। এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে বাংলাদেশের মতো বৃহৎ বদ্বীপ অঞ্চলে যথেষ্টভাবে অনুসন্ধানকাজ চালালে আরও অনেক গ্যাস পাওয়া যাবে। বর্তমান আলোচনায় দেশের ভূখণ্ডের কথা প্রাধান্য পেয়েছে। দেশে সমুদ্রবক্ষ তুলনামূলকভাবে আরও সম্ভাবনাময় কিন্তু সেখানে অনুসন্ধান হয়েছে আরও কম (পরবর্তী প্রবন্ধে আলোচ্য)।

অথচ বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণী মহলে দেশ গ্যাসশূন্য হওয়ার স্লোগানটি নতুন গ্যাস সম্ভাবনা উন্মোচনের স্লোগানের চেয়ে বেশি জোরে উচ্চারিত হয়ে থাকে। আর তাই লক্ষ করা যায় যে দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি সরবরাহ পরিকল্পনায় আমদানি করা জ্বালানির ওপর ভর করার উদ্যোগই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এক হিসাব অনুযায়ী ২০৩০ সালে বাংলাদেশ তার জ্বালানি সরবরাহের জন্য ৯০ শতাংশ আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভর করার পরিকল্পনা করেছে। অথচ এই বিপুল পরিমাণ আমদানি করা জ্বালানি ব্যবহার করলে দেশের অর্থনীতির ওপর যে চাপ পড়বে, তার দায় মেটাতে হবে জনগণকে। অন্য কথায় সে ক্ষেত্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের মূল্য হবে বেশি, শিল্পজাত দ্রব্যাদিও বেশি মূল্যে কিনতে হবে। তাই দেশের নিজস্ব জ্বালানি সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর বিকল্প কোনো উত্তম পন্থা নেই।

তবে অতি সম্প্রতি বাপেক্স দেশের ভূখণ্ডে বড় আকারের অনুসন্ধান কার্যক্রম হাতে নেয়। ‘রূপকল্প ২০২১’ নামের এই প্রকল্পের অধীনে অনেকগুলো অনুসন্ধান কূপ খননের পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। বাপেক্সের নিজস্ব লোকবল ও খনন রিগের সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে অতিরিক্ত কূপসমূহ বিদেশি খনন কোম্পানি দিয়ে করানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই প্রকল্পের অধীনে প্রথম কূপ ছিল ভোলায় খননকৃত কূপটি। আর এই প্রথম কূপটিতেই গ্যাসপ্রাপ্তির ঘোষণা গ্যাস-সংকটে নিমজ্জিত বাংলাদেশের জন্য কিছুটা হলেও স্বস্তি আনার প্রয়াস পেয়েছে। বাপেক্সকে সুষ্ঠু ধারায় পর্যাপ্ত ক্ষমতা দিয়ে কাজ করার সুযোগ করে দিলে এটি গতিশীল ও স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করতে সক্ষম হবে বলে সবার বিশ্বাস। ওপরমহলের তথা সরকারি অযাচিত হস্তক্ষেপ ও অনুশাসন বাপেক্সের কর্মযজ্ঞ দলকে পেছনের দিকে টেনে আনবে না, এ আশা সবার।

ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

 

সৌজন্যে : প্রথম আলো