রাজধানিতে চুলা জ্বলে রাতে

বাবুল সেন থাকেন রাজধানির পূর্ব রাজাবাজার। রান্নার গ্যাস সংকটে দিশাহারা তিনি। দৈনন্দিন জীবন-যাপনই বদলে গেছে তার। রাতে যখন ঘুমানোর কথা তখন অপেক্ষা করতে হয় রান্নার জন্য। আর দিনে চুলায় মাছি। গত কয়দিন এমন অবস্থা যে দিনে চুলা একেবারে জ্বলেই না।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একেবারেই নেই। পড়ন্ত দুপুরে গ্যাস আসা শুরু হয়, মিট মিট করে। এভাবেই চলতে থাকে রাত ১১টা। তারপর পুরো চাপ। শীতের এই রাতই যেন রান্নার জন্য বরাদ্দ। আর দিনের বেলা অনশন।
গ্যাস না থাকার এই অভিযোগ রাজধানির একাধিক এলাকার। ভোগান্তির সর্বোচ্চ সীমায় এসে পৌছেছে বলে অভিযোগ তাদের। গত দুই সপ্তাহ গ্যাসের চাপের এই অবস্থা। দিন দিন এই সংকট বাড়ছেই।
এ অভিযোগ শুধু বাবুল সেনের নয়। বনশ্রী, মালিবাগ, শান্তিনগর, মুগদা, যাত্রাবাড়ি, মিরপুর, মগবাজার, শ্যামলী, মোহাম্মদপুরসহ রাজধানির প্রায় বেশিরভাগ এলাকার মানুষের। অভিযোগ পাওয়া গেল পশ্চিম শেওড়াপাড়া ৪৪২/১ নম্বর বাসার বাসিন্দা গৃহিনী জান্নাত আরা লাজু’র কাছ থেকে। তিনি বললেন, মিরপুর শেওড়াপাড়া এলাকায় দিনে চুলা জ্বলছে না। গ্যাস সংকটের কারণে কাক ডাকা ভোরে স্বল্প সময়ের মধ্যে তড়িঘড়ি করে রান্নার কাজ শেষ করতে হচ্ছে। ভোর সাড়ে সাতটা থেকে বিকেল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত চুলায় গ্যাস থাকে না। এরপর বিকেলের দিকে কিঞ্চিত পরিমাণ গ্যাস আসলেও সন্ধ্যার পর চলে যায়। আবার গভীর রাতে আসে। দিনে গ্যাস না থাকার কারণে সকালেই রান্নার কাজ শেষ করতে হয়। শীতের দিনে গ্যাস না থাকার কারণে রান্নার ভীষণ অসুবিধা হচ্ছে। সময় মতো বাচ্চাদের খাবার তৈরি করা যাচ্ছে না। গ্যাসের অভাবে ছুটির দিনে আত্মীয়-স্বজনকে সমাদর করা সম্ভব হচ্ছে না। একই এলাকার বাসিন্দা মোজ্জামেল হক বলেন, বাসার রান্না বাদ দিয়ে হোটেল থেকে থাকার এনে খেতে হচ্ছে। প্রায় দেড়মাস এই অবস্থা চলছে।
তবে এই সংকটের মধ্যেও মধ্যরাতের পর গ্যাস কোথায় থেকে আসে- এই প্রশু আশকোনাবাসির। ভয়াবহ গ্যাস সংকটে ভুগতে থাকা রাজধানীর দক্ষিনখানের আশকোনার একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, গ্যাসের অভাবে ভোর ৫টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত বাসায় চুলা জ্বলে না। ফলে এলাকাবাসী চরম দুর্ভোগে পড়েছে।
জানা গেছে, দক্ষিনখানের  থানা ও ইউনিয়নের অন্তর্গত আশকোনা, মোল্লারটেক, উচারটেক, গাওয়াই, মেডিকেল রোড, কমিউনিটি সেন্টার, সিরাজ মিয়া রোড, চেয়ারম্যানবাড়ি ও কাওলাসহ বিভিন্ন স্থানের মানুষ গ্যাস সমস্যায় অসহনীয় দূর্ভোগ পোহাচ্ছেন। বিশেষ করে আশকোনাবাসি।
ভুক্তভোগী আশকোনার সখিনা বেওয়া, শিউলি আক্তার, কামরুন নাহার, পুজা রানীসহ কয়েকজন গৃহিনী জানান, দিনের বেলা এলাকার কোথাও একেবারেই গ্যাস থাকে না। কেবল রাত ১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত মাত্র এই চার ঘন্টা পাওয়া যায়। কিন্তু ওই সময় ঘুমিয়ে থাকায় তা আর তেমন কাজে আসে না।
মমতাজ উদ্দিন, শাহ আহমেদ, বাবুল আকতার, ইদ্রিজ আলীসহ কয়েকজন বলেন, গ্যাস সংকটের অভিযোগ তুলে একাধিক মিছিল সমাবেশ করা হয়েছে। কিন্তু এখনও সমাধান হয়নি। তাদের প্রশু গ্যাস না থাকলে মধ্যরাতে তা আসে কোত্থেকে?
এই অবস্থা শুধু আবাসিকে নয় শিল্প, বাণিজ্যসহ সব গ্রাহকের। শীতের শুরুতে সংকট শুরু। এখন তা প্রকট আকার ধারন করেছে।
শুধু রাজধানি নয় সাভার, গাজিপুর, আশুলিয়া, মানিকগঞ্জ, নারায়নগঞ্জ, নরসিংদীসহ আশপাশের প্রতিটি স্থানে গ্যাস সংকট চলছে।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, গ্যাসের মোট উৎপাদন কমেনি। আগের মতই আছে। তবে ব্যবহার বেড়েছে। সার কারখানাগুলো এতদিন বন্ধ ছিল। এখন পর্যায়ক্রমে সারকারখানাগুলো চালু করা হয়েছে। সামনের কৃষি মৌসুমকে বিবেচনা করে সার কারখানায় প্রয়োজনীয় গ্যাস দিতে হচ্ছে। এরফলে গ্যাসের ব্যবহার বেড়ে গেছে। এই সময় সমম্বয় করতে কিছুটা রেশনিং করতে হচ্ছে।  এতে কিছু আবাসিক এলাকায় গ্যাস সংকট তৈরী হয়েছে।
গ্যাসের কিছুটা সংকট চলছে বলে শিকার করেছেন তিতাস কর্তৃপক্ষ। তিতাস গ্যাসের পরিচালক (অপারেশন) আলী আশরাফ বলেন, শুধু আবাসিক বা শিল্পে নয় সব গ্রাহকের সংকট চলছে। যে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে তাতো পুরোটাই দেয়া হচ্ছে। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের জন্য কোন সংকট হচ্ছে না।
তিতাস সূত্র জানায়, আগের মতই গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। রোববার ২৭৪ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। এদিন উৎপাদন করা হয়েছে ২৭১ কোটি ঘনফুট। কিন্তু চাহিদা আছে প্রায় ৩৫০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহ করা গ্যাসের মধ্যে বিদ্যুতে দেয়া হয়েছে ১০০ কোটি এবং সার কারখানায় ২৩ কোটি ঘনফুট গ্যাস। সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ ১০কোটি ঘনফুট বাড়ানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত ছয় বছর গ্যাস উত্তোলন সর্বোচ্চ পরিমান বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু সংকট কাটেনি। সমস্যা যে তীমিরে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে। গত কয়েক বছরে (২০০৯ থেকে ২০১৫) প্রায় ৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রীডে যোগ হয়েছে। একই সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে প্রায় ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন কমেছে। ফলে মুলত যোগ হয়েছে গড়ে ৫০ কোটি ঘনফুট। নতুন গ্যাস যোগ হওয়ার সাথে চাহিদা ও নতুন সংযোগ বেড়েছে। তাই গ্যাসের সংকট কাটেনি। বরং বেড়েছে। সহসা এ সংকট কাটবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।