শর্তসহ রামপাল নিয়ে আপত্তি তুলে নিল ইউনেস্কো

সুন্দরবনের পাশে রামপালে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে ইউনেস্কো যে আপত্তি জানিয়েছিল তা প্রত্যাহার করেছে। একই সাথে বিশ্ব ঐতিহ্যের ঝুঁকিপূর্ণ তালিকা থেকেও সুন্দরবনকে বাদ দেয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রামপালের বর্তমান অবস্থান সুন্দরবনের জন্য কোন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে না বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো)।

পোল্যান্ডে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির ৪১তম অধিবেশন চলছে, সেখানেই এই ঘোষণা দেয়া হয় বলে জানানো হয়েছে। ওই অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন।

প্রতিনিধি দলে অন্যদের মধ্যে ছিলেন বিদ্যুৎ সচিব ড. আহমদ কায়কাউস, ফ্রান্সে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও ইউনেস্কোর স্থায়ী প্রতিনিধি এম শহিদুল ইসলাম, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জিয়াউর রহমান, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রইছ উল আলম মণ্ডল, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালিদ মাহমুদ, পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেইন এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক সুলতান আহমেদ।

তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরী অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভারসাম্য বজায় রাখতে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করার জন্য ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানান তিনি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অধিবেশনে সুন্দরবনের ঐতিহ্য রক্ষায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে বলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কমিটিকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অনেক বিচার বিবেচনা করে কমিটি রামপাল প্রকল্প নিয়ে তাদের আপত্তি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু একই সাথে সুন্দরবন রক্ষায় প্রয়োজনীয় কিছু ব্যবস্থাও নিতে পরামর্শ দেয়।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তুতি হিসেবে ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তারজন্য স্বাগত জানিয়েছে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি। সুন্দরবনের ঐতিহ্য রক্ষায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে বলে আশ্বস্ত করা হয়।

৪ঠা জুলাই থেকে শুরু হওয়া অধিবেশনে সুন্দরবন নিয়ে গত সোমবার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ ম্যানগ্রোভ বন রক্ষায় যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেগুলোও তুলে ধরা হয়। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না, এ বিষয় প্রাধান্য দিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি উপস্থাপন করা হয়।

পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর অভিযোগ, রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ফলে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হবে। এছাড়া বনের ভেতর দিয়ে কয়লা, সার ও জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ চলাচল করে, এগুলোর কারণেও বনের ক্ষতি হচ্ছে। এমনকি বনের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা বিভিন্ন নদীতে প্রায়ই তেল, কয়লা ও সারবাহী ট্যাংকার ডুবে জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি করছে। এগুলো বন্ধের জন্য ইউনেস্কো ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বারবার প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা হলেও আমলে নেয়নি সরকার।

গতবছর সুন্দরবনের পাশে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদৎ প্রকল্প বাতিল করার জন্যবাংলাদেশের কাছে সুপারিশ করে ছিল ইউনেসকো। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হলে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে উলে­খ করে তা নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে বলে তারা।

রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের ক্ষতি করবে- এমন তথ্য দিয়ে এর আগে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কাউন্সিলের ৩৯ ও ৪০তম বার্ষিক সভায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এ প্রকল্প সুন্দরবনের জন্য ‘মারাত্মক হুমকি’ উল্লে­খ করে তা বাতিল বা অন্যত্র সরিয়ে নিতে গেল বছরও সরকারের প্রতি লিখিত আহবান জানায় ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টার। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে জবাব দিলে ইউনেস্কোর একটি বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে। প্রতিনিধিদল রামপাল প্রকল্প স্থান, সুন্দরবন ঘুরে এবং সরকার ও সংশি­ষ্ট ব্যক্তিদের মতামত নিয়ে গত বছরের জুনে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনে রামপালকে সুন্দরবনের জন্য মারাত্মক হুমকি বলে উলে­খ করা হয়। প্রকল্পটি বাতিল করে অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে বলা হয়।  এ নিয়ে বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র ও আইইউসিএন যৌথভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলো। সেখানে বলা হয়েছিলো, সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষিত স্থান থেকে মাত্র ৬৫ কিলোমিটার দূরে কয়লাভিত্তিক এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে, যা সুন্দরবনের জন্য মারাত্মক হুমকি।

ইউনেসকোর এর এই সিদ্ধান্তের পর তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহম্মদ বলেন, লবিং এর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে ইউনেস্কো ।  এর আগে ইউনেস্কোর বিশেষজ্ঞদের ব্যাপক অনুসন্ধান এবং বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্ত বিশ্লে­ষণ থেকেই তাদের সিদ্ধান্ত ছিলো এই প্রকল্প সরিয়ে নেয়ার বিকল্প নেই। আজ আপত্তি প্রত্যাহারের অর্থ হলো ইউনেস্কোর বৈজ্ঞানিক অবস্থান গোষ্ঠী স্বার্থের লবিং এর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে ইউনেস্কো তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা সন্দেহজনক কারণে আপত্তি প্রত্যাহার করতে পারে, বাংলাদেশের মানুষ পারে না। তিনি জানান, আগামী ১১ই জুলাই এই প্রকল্প বাতিলের দাবিতে এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ নিয়ে দুর্নীতির প্রতিবাদে দেশব্যাপী সমাবেশ করবে জাতীয় তেল গ্যাস ও বন্দর রক্ষা কমিটি।