অনেক বাধা ছিল; রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রাকৃতিক- সব ওভারকাম করতে হয়েছে: নসরুল হামিদ
তফসিল ঘোষণার পর নীতি নির্ধারনী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই বর্তমান সরকারের। সেই অর্থে মেয়াদ শেষ। নানা সমালোচনা থাকলেও টানা তিনবার ক্ষমতায় থেকে পুরো দেশে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে এই সরকার। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এখন চাহিদার চেয়ে বেশি। সামনে থেকে শতভাগ বিদ্যুতায়নের সেই নেতৃত্ব দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। গেল দশ বছর তিনি টানা এই দায়িত্ব পালন করেছেন। তার হাত ধরেই শতভাগ বিদ্যুতায়নের মাইলফলক অর্জিত হয়েছে। মাত্র ১৩ বছরে এই অর্জন। সেই পথ চলা আর ভবিষ্যতের কথা জানিয়েছেন তিনি।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রফিকুল বাসার
এনার্জি বাংলা: জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে। নতুন করে আর নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা নেই মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যদের। তারমানে আপনার মেয়াদ আপাতত শেষ। টানা ১০ বছর এই মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। কোন অবস্থায় পেয়েছিলেন আর কেমন রেখে যাচ্ছেন?
নসরুল হামিদ: সবচেয়ে বড় আনন্দের বিষয়-এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উনার সাথে দীর্ঘদিন কাজ করা- এটা আমার জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া। এটা একটা বড় বিষয়। আমি মনে করি যে, সবচেয়ে শ্রেষ্ঠতম সময় কেটেছে আমার। অতুলনীয় অভিজ্ঞতা। যেটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে- আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ কী? আমি বলব এতবছরের আমার এই অভিজ্ঞতা। এখানে খুব ভালো ভালো অভিজ্ঞ লোকজন ছিল। যেটা আমরা কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পেরেছি। বিশেষ করে উপদেষ্টা মহোদয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরীসহ সকল কর্মকর্তা।
এনার্জি বাংলা: এই সময়ে সবচেয়ে বড় অর্জন কোনটা?
নসরুল হামিদ: মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের শতভাগ বাড়িতে আমরা বিদ্যুতায়ন করেছি। এই প্রশংসা তো আর কেউ নিতে পারবে না। এটা একটা বড় প্রশংসার দাবীদার আমরা। এবং আমাদের হাত দিয়েই বাংলাদেশের সবচাইতে বড় Ñ স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছে এই মন্ত্রণালয়। এইটাও একটা বড় অর্জন। এটাও সারাজীবন ইতিহাস হয়ে থাকবে। কারিগরি জ্ঞান থেকে আরম্ভ করে পেশাদারিত্ব না থাকলে এত বড় অর্জন করা যেত না। এটা বিদ্যুতের কথা বলছি।
এনার্জি বাংলা: এই পথ পাড়ি দিতে কোনো চ্যালেঞ্জ ছিল?
নসরুল হামিদ: এই যে একটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিলামÑ এখানে বাধা ছিল। অনেক ধরনের, রাজনৈতিক বলেন, অর্থনৈতিক বলেন, প্রাকৃতিক বলেন- সব ওভারকাম করতে হয়েছে। গত ৫০ বছর কেন, একশ’ বছর – ১৯০১ সালে প্রথম বিদ্যুৎ এসেছে ঢাকায়। যদি ইষ্ট পাকিস্তানের কথা বলিÑ তাও দীর্ঘদিন পার হয়েছে। একশ’ বছরের মধ্যে মাত্র ৪৭ শতাংশ বিদ্যুতায়ন হয়েছে। ২০০৮ থেকে যাত্রা শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগের নের্তৃত্বে। ২০০৮ থেকে যদি আমাদের যাত্রা ধরি। এর পরবর্তীকালে ৬০ থেকে ৬৩ শতাংশ বিদ্যুতায়ন তাও ১৩ বছরের মধ্যেÑ এটা একটা বিশাল বিষয়। এই যাত্রায় বুঝতে পারছেন যে কি রকম চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করেÑ ঐ জায়গা থেকে নিয়ে এসেছি।
প্রিপেইড মিটার, গ্যাস মিটারে যাচ্ছি আস্তে আস্তে। আমার মনে হয়, এই বিষয়গুলো আসলে, একটা হোমজিনিয়াস জায়গা তৈরি হবে বাংলাদেশে। আমরা তো একটা বেসিক জাগা তৈরি করছি এখন। আওয়ামী লীগ যে জাগাটা তৈরি করছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে। সেটা হল, কানেকটিভিটি তৈরি করতে হবে আরও।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এটা দিয়ে বানালে ভাল হতো, ওইটা দিয়ে বানালে ভালো হতো। সবাই তার জায়গা থেকে বলছে ভালো হতো। তারা তো মাঠে নেমে দেখেনি। কথা বলতে কোন সময় লাগে না। কথা বলতে কোন বাধা নেই। তাদের সামনে কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। যা ইচ্ছা সেই কথা বলতে পারে। ওদিকে যদি আমরা কান দিয়ে সারাক্ষণ চলতাম; তাইলে এই কানেক্ট হতো না। বিগত সরকার তার উদাহরণ। বিএনপি-জামাত জোট সরকার এক মেগাওয়াটও যোগ করতে পারেনি। যার কারণে আমি মনে করি; আমরা ঠিক পথে আছি বলেই এত বড় অর্জন হয়েছে।
এনার্জি বাংলা: এই পথ চলায় সবচেয়ে কার সহায়তা বেশি পেয়েছেন?
নসরুল হামিদ: আমি ধন্যবাদ জানাই সর্বোপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি অসম্ভব দুরদৃষ্টি সম্পন্ন। সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র কোন দ্বিধাবোধ ছিল না। মাত্র দুই মিনিটেই সিদ্ধান্ত নিতেন। বিশাল সিদ্ধান্ত। আমরা দিনকে দিন চিন্তা করে তাঁর কাছে গেলাম। তিনি সাথে সাথে ইয়েস আর নো বলে দিতেন। পরে দেখলাম সেটাই ঠিক। যে সিদ্ধান্ত দিলেন সেটাই পারফেক্ট। উনার বিশাল অভিজ্ঞতা। যার কারণে ওইটার প্রতিফল ঘটেছে। বাংলাদেশের এই উন্নয়ন। বিশেষ করে অবকাঠামোÑ তাঁর বাংলাদেশের আনাচে কানাচে প্রত্যেকটা গ্রাম মুখস্ত। এটা সিদ্ধান্ত নিতে ব্যাপকভাবে কাজ করেছে। উনি বলে দিতেন- ‘‘যে এই এলাকায় এরকম হবে। এই এলাকা এই অবস্থা। অমুক গ্রামের এই অবস্থা। এই নদীগুলো তোমাকে মোকাবিলা করতে হবে। এই চ্যালেঞ্জগুলো আছে। এটার ওপর দিয়ে নিয়ে যাবা Ñ ইত্যাদি।
আরেকটা বড় বিষয় ছিলÑ সাংবাদিকদের নিয়ে কাজ করা। আমার মনে হয়, যারা তথ্য নিয়ে, উপাত্ত নিয়ে কাজ করছে তাদেরকে আমরা বিভিন্ন ভাবে পেয়েছি। এই মন্ত্রণালয় কিন্তু খুব ঘনিষ্ঠভাবেই তাদের পেয়েছে। সেটা হল, ঠিক তথ্য পাওয়া। জনগণের কাছে তথ্য পৌঁছানো। জনমত তৈরি করা। এটার ব্যাপারে সাংবাদিকরা একটা বড় উপকার করেছে। আমাদের মধ্যে যে ভুলগুলো আছে, সেগুলো সমালোচনা বলব না, সেগুলোকে দেখিয়ে দিয়েছে, লেখার মধ্যে দিয়ে। এটাও কিন্তু আমাদেরকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য, আরও সতর্ক হয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে সাহায্য করেছে। তো এই কারণেই আমি মনে করি, যাত্রাটা আমাদের সর্বোপরি সকলের বড় অবদান আছে। কারো খাটো করে দেখা যাবে না। অর্জন হয়েছে আমাদের। আমরা অর্জন করেছি। মানুষের প্রশংসাও পেয়েছি। মানুষ এখন তার স্বচক্ষে দেখছে তার বাড়িতে বিদ্যুৎ জ্বলছে। তার স্বীকৃতিও আমরা পেয়েছি। স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছি। এটা অনেক কিছু।
এনার্জি বাংলা: ভবিষ্যতের জন্য কি রেখে যাচ্ছেন?
নসরুল হামিদ: যে জিনিসটা বলতে পারি সেটা হল, আমাদের পরিকল্পনাটা রেখে গেলাম। একটা কাজ করার পরিবেশ সাথে কোন উপায়ে কাজ করতে হবে সেই পরিকল্পনা। পরিকল্পনাটা আমরা তৈরি করেছি।
এনার্জি বাংলা: ভবিষ্যতে যিনি আসবেন তাকে কোন বিষয়টা বেশি গুরুত্ব দিতে হবে?
নসরুল হামিদ: সেটা হলো- প্রযুক্তিকে নিয়ে আসা। এবিষয়টাকে গুরুত্ব দিতে হবে। নতুন প্রযুক্তি। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তি আনতে হবে। এই কারণে এটা দরকার হবে, যে ভবিষ্যতে আপনি আগে বলতে পারবেন না কোন জ্বালানির দাম কেমন হবে। ঐ জ্বালানি খুব সস্তা হবে, ঐ জ্বালানির দাম বেশিÑ এটা বলা যাবে না। অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন, এটাতে বেশি বানালে হবে, ঐটাতে বেশি বানালে হবেÑএসব কথা মূলত কাজ করে না। বিগত দিনগুলোতে আমরা দেখেছি। কিছুই ঠিক থাকে না। এই যে যুদ্ধ লেগে গেল। জ্বালানি বন্ধ হয়ে গেল। আপনি কি করবেন? তেলের দাম বেড়ে গেল। কয়লার দাম বেড়ে গেল। আর আমাদের তো গ্যাস অনেক আছে তা না। গ্যাসের ওপর তো দেশ ভাসছে তাÑনা। গ্যাস আমাদের আছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় তা যথেষ্ট না। চাহিদা বাড়ছেই। শিল্প কারখানা হচ্ছে। তাতে চাহিদা বাড়ছে। ৬৪ ভাগ বিদ্যুৎ হচ্ছে গ্যাস দিয়ে। আমরা কিছু গ্যাস জমা রাখছি। মিক্সড ফুয়েল, বিভিন্ন জ্বালানিতে যাচ্ছি। নতুন প্রযুক্তি আনলে হবে কি, আমাদের অপচয় কমে যাবে। বিদ্যুতের জ্বালানির দাম সাশ্রয় হবে।
এনার্জি বাংলা: গ্রাহকের কাছে কম দামে গ্রহণযোগ্য দামে জ্বালানিটা এখনো পৌঁছানো যায়নি।
নসরুল হামিদ: এটাও ভবিষ্যতের জন্য বড় কাজ। এটা আমাদের বড় বিষয় যে, কিভাবে জনগণের কাছে প্রতিযোগিতামূলক দামে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পৌঁছাতে পারি। এইটা হল আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ। প্রতিযোগিতাপূর্ণ দাম আর নিরবচ্ছিন্ন রাখা। এই নিরবিচ্ছিন্ন রাখার ক্ষেত্রেও আমাদের নতুন প্রযুক্তি বা টেকনোলজি আনতে হবে।
এনার্জি বাংলা: আর কী কী করতে হবে?
নসরুল হামিদ: আমাদের প্রচুর সঞ্চালন লাইন করতে হবে। বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। সঞ্চালন লাইনে লোড বাড়ছে। পুরনো লাইনটা পরিবর্তন করতে হবে। ট্রান্সফরমার পরিবর্তন করতে হবে। হাজার হাজার ট্রন্সফরমান পরিবর্তন করেছি। কিন্তু আরও করতে হবে। তার জন্য অর্থ যোগানো একটা বড় ঝামেলা। বেসরকারিখাতসহ সরকারি উন্নয়ন সহযোগিদেরকে এই জায়গায় বড় ভাবে নিয়ে আসতে হবে। এখন যা করছি তার তিনগুণ বিনিয়োগ আমাদের লাগবে। ডিমান্ড বেড়ে তো উপরের দিকে যাচ্ছে। এটা নামার কোন সুযোগ নেই। মানে নিশ্চিত যে চাহিদা কমবে না। চাহিদা উপরে যেতেই থাকবে। একটা সময় স্থির হবে। সেটা অনেক দূর। উন্নত দেশে পৌঁছতে গেলে আমাদের জনপ্রতি বছরে তেরশ’ থেকে দুই হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এখন আছে মাত্র ৫৬০। বুঝতেই পারছেন, এখন তিন থেকে চারগুণ বেশি বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে গেলে তিন থেকে চারগুণ বেশি ট্রান্সমিশন লাইন, ডিস্টিবিউশন লাইন করতে হবে। বিনিয়োগও সেই পরিমান বাড়াতে হবে। নিরবচ্ছিন্ন করতে হবে। এই হচ্ছে অবস্থা। যখনই আমি নতুন প্রযুক্তিতে যাব- দ্যট মিনস ইনভেষ্টমেন্ড। বিনিয়োগ। তবে বিদ্যুৎ জ্বালানিতে বিনিয়োগ করলে দেশ তিনগুণ অর্থ পায়। নিরবচ্ছিন্ন হবে। রিলায়েবল হবে বিদ্যুৎ-জ্বালানিটা। এটাই হল আগামী দিনের পরিকল্পনা। এটাকে সামনে ধরেই আমরা আগাচ্ছি। এটাই কিন্তু স্মার্ট বাংলাদেশের একটা অংশ।
এনার্জি বাংলা: এখন যে একটা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে দেশ যাচ্ছে, এটা উত্তোরণ কত দিতে কিভাবে হবে?
নসরুল হামিদ: একটা সংসারের খারাপ সময় যায়। ভাল সময় আসে। দেশেরও এরকম অবস্থা। অনেক দেশেই এইটা ফিল করছে। অনেক দেশ খুব খারাপ অবস্থায় চলে গিয়েছিল। তারা সার্ভাইব করে এখন সেই জায়গা থেকে শক্তিশালী অর্থনৈতিক দেশ হয়েছে। আমরাও একটা চলমান ইকোনমিক কান্ট্রি। ফাস্টেট ইকোনমিক ডেভলপমেন্ট কান্ট্রি। সারা বিশ্বের সাথে আমাদের টাই আপ করা। অনেক কিছু নির্ভর করে বিদেশের সাথে। রেমিটেন্স বলেন সেইটাও বাইরের দেশের ওপর নির্ভর করে। এক্সপোর্ট বলেন এটাও বাইরের দেশের ওপর নির্ভর করে। জ্বালানিও নির্ভর করে বাইরের দেশের দামের ওপর। যুদ্ধ, কোভিট, মিলে একটা অপ্রস্তুত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশ না শুধু, সব দেশেই এই অবস্থা। জিনিসপত্রের দাম সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে।
এনার্জি বাংলা: ডলার সংকট বিদ্যুৎ জ্বালানিতে ভালোভাবে প্রভাব ফেলেছে।
নসরুল হামিদ: বিষয়টা হয় কি সময়ের সাথে চলতে হবে। সময়ের আগে না। সময়ের পিছে না। এটা একটা ফর্মুলা। অনেকে সময়ের পেছনের কথা চিন্তা করে। যারা ট্রেডিশনাল ব্যক্তি আছে তারাই পেছনের দিকে যেতে চায়। তাদের চিন্তাভাবনাও সেরকম। সময়ের আগে চিন্তা করে সময়ের সাথেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই জিনিসটা আমরা অনেকে ভুল করি। সুতরাং এখনকার বিশ^ কিন্তু সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জের। আপনার জন্য কেউ বসে থাকবে না। আপনার দেশ নিজেকেই ঠিক করতে হবে। নিজের দেশ সম্পর্কে নিজেকেই বেশি জানতে হবে। অন্য দেশের উদাহরণ দিতে পারেন। কিন্তু তা এখানে নাও মিলতে পারে। নিজের দেশের মত করে নিজের কায়দা অনুযায়ী চিন্তা করতে হবে। ধৈর্য্য ধরতে হবে। আস্থা রাখতে হবে। এই দেশ, এই দল, এই সরকার পরীক্ষিত। তাদের ওপর আস্থা রাখা উচিত। মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে আমরা এই জায়গায় এসেছি। বলা যায় অবকাঠামো এত দ্রুততার সাথে এইভাবে তৈরি করার উদাহরণ নেই সারা বিশে^। মাত্র ৯০০ থেকে এক বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ ছিল ২০০৮ এ। এখন রিজার্ভ, ৩০ বা ২৫ বিলিয়ন, অকল্পনীয় বিষয়। সুতরাং রিজার্ভ বিষয় না। বিষয় হচ্ছে দেশের মানুষ ভালো আছে কিনা? ওইটাই তো আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য। সবদিক দিয়ে মানুষ ভালো আছে কিনা। আর আমরা যতটুকু চেষ্টা করে এসেছি। আমার মনে হয় সেটার ধারাবাহিকতা রাখা উচিত।
এনার্জি বাংলা: বিদ্যুতে পাওনা বাড়ছে। আট মাসের বকেয়া পড়ে গেছে। সরকারি বেসরকারি কেন্দ্রগুলো চলতে পারছে না। বিপপা বলছে, ওরা ২৩ হাজার কোটি টাকা পাবে।
নসরুল হামিদ: গ্রাহকের কাছেও আমাদের অনেক পাওনা রয়ে গেছে, ৫-৬ হাজার কোটি টাকা। আসলে পেমেন্ট কোনো সমস্যা না। সমস্যাটা হল বৈদিশিক মুদ্রা। আর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পাওনা অত টাকা না। নির্বাচনের পর মার্চ এপ্রিলের দিকে এই সমস্যা চলে যাবে আশা করি। ডলারের বিনিময় হারের জন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর যে লোকসান হচ্ছে তা দিয়ে দেওয়া হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই অর্থ দিয়ে দিতে অনুমোতি দিয়েছেন। এবিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটা অত বেশি সমস্যা হবে না।
এনার্জি বাংলা: এই তিন মেয়াদে অনেক অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে বিদ্যুৎ জ্বালানিতে। এতে যে অর্জন হয়েছে তাও দেখতে পাচ্ছি। এখন এরমধ্যে বড় অংশ বেসরকারি বিনিয়োগ। স্থানীয়ভাবে স্থায়ী উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে? আর কোন কোন ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা তৈরির সুযোগ আছে?
নসরুল হামিদ: আমি মনে করি বিদ্যুৎ জ্বালানিতে বেসরকারিখাতের একটা বড় অংশগ্রহণ রাখা উচিত। তাহলে প্রতিযোগিতা আসবে। ট্রান্সমিশনে আসা উচিত। ডিস্ট্রিবিউশনে ভবিষ্যতে আসা উচিত। তেলের ক্ষেত্রে আমরা আস্তে আস্তে ওপেন করে দেখতে চাই। প্রতিযোগিতামূলক দামে তেলের অবস্থানটা ঠিক থাকে কিনা। অনেক দেশ এই নিয়মে চলে গেছে। ভারত থেকে আরম্ভ করে। সবাই এখন মার্কেট ওপেন করে দিয়েছে। আর এই যে হাতে ধরে রাখা সবকিছু এটা করব না। শুধু রেগুলেট করব। নিয়ন্ত্রণ করব। আমাদের কাছেই আসতে হবে। মানুষের এইটা সার্ভিস দেয়ার জায়গা। জনগণ যদি ভালো মনে করে- সে তার কাছে যাবে। ভালো না লাগলে বিকল্প থাকা উচিত। গ্যাস পাচ্ছে না। তিতাস একমাত্র রেসপনসিবল। সে খবর নেয় না। এখানে আরেকটা ডিস্টিবিউশন কোম্পানি থাকলে তার কাছে যেতাম আমরা। ভারত আস্তে আস্তে প্রাইভেটাইজ করে ফেলছে, জায়গা অনুযায়ী। তারা গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশনও প্রাইভেটাইজ করছে। ওখানে নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আসছে। প্রিপেইড মিটার, গ্যাস মিটার নিয়ে আসছে। আমরা সেদিকেও যাচ্ছি।
এনার্জি বাংলা: বিদ্যুতে অনেক উন্নতি হলেও প্রাথমিক জ্বালানি সংকট কিন্তু রয়েই গেছে। গ্যাস সংকট এখনো আছে।
নসরুল হামিদ: আমার মনে হয়, ২০২৭ সালের মধ্যে আমরা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের ক্ষেত্রে পৌঁছে যাব। আমাদের নেটওয়ার্ক যেইভাবে তৈরি হচ্ছে। রংপুর থেকে আরম্ভ করে খুলনা, বরিশাল সব জায়গাতে গ্যাস পাইপলাইন চলে যাবে। এবং সব শিল্প এলাকাগুলোও কানেক্টেড হয়ে যাবে। টুয়েনটি সেভেনথ এর মধ্যে। গ্যাসের যে পরিমাণ চাহিদা থাকবে, স্থানীয় গ্যাস প্রায় ৮০০-৯০০ এমএমসিএফডি বাড়বে। সামনের দুইটা বছর কমবে। আমি মনে করি যে ২০২৭, ২০২৮, ২০২৯ এই সময়ের ভেতর নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবাহের যে চ্যালেঞ্জ আছে সেটা আমরা পূরণ করতে পারব।
এনার্জি বাংলা: আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে কোনো পরিকল্পনা আছে?
নসরুল হামিদ: এটা নির্ভরশীলতা নয়। আমদানি থাকবেই। এটা করতেই হবে। সবকিছু একই বাস্কেটে রাখা যায় না। কিছু আমদানি থাকতেই হবে। নবায়যোগ্য বিদ্যুৎ আমদানি করতে যাচ্ছি। সৌর বিদ্যুৎ আমদানি করব বড় আকারে। নেপাল ভুটান থেকে জল বিদ্যুৎ আমদানি করব। এই বছরই শুরু হয়ে যাবে। আবার নিজের দেশেও ছোট ছোট সৌর বিদ্যুৎ করছি। আমাদের ১০ শতাংশ যে নবায়নযোগ্য করার কথা তা অর্জন করতে যাচ্ছি। আর দুই বছর লাগবে আমাদের।
এনার্জি বাংলা: বেসরকারিভাবে জ্বালানি তেল আমদানি, বিক্রির নীতিমালা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এটা কিভাবে বাস্তবায়ন হবে? উদ্দেশ্য কী?
নসরুল হামিদ: তেলের নীতিমালা করার কারণ হল প্রতিযোগিতা। দামে প্রতিযোগিতা আনা। দামে কমপিটিটিভনেস আসা উচিত। সাপ্লাইতেও কমপিটিটিভনেস আসা উচিত। এখানে একটা বড় চ্যালেঞ্জ আছে। খুব শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে সরকারি তেল কেনাকে। কিন্তু বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাতে যখন চলে যাবে, তখন সরকারকে কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যদি নিয়ন্ত্রণ যথাযথভাবে না হয়। তাহলে ফেল করবে। আমরা এটা নিয়ে আলোচনা করছি। সুতরাং প্রথমবার আমরা টেস্ট বেসিসÑ পরীক্ষামূলক কিছু দেখব। অনুমোতি কিছু দিচ্ছি। ভবিষ্যতেও দেব। সেই তেল কিভাবে মার্কেটিং করা হবে। কোন ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি কিনবে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনাও কিনতে পারবে। পেট্টোবাংলাও সরাসরি কিনতে পারবে। ওখানে আমরা রেগুলেট করব। নিয়ন্ত্রণ করব। তখন আমরা ধরতে পারব, কোন্ পেট্টলপাম্প ভেজাল তেল বিক্রি করে। বেসরকারি কোম্পানিকে ধরব, তুমি তো ডিস্টিবিউট করছো। তোমার তেল সাপ্লাই ঠিক হচ্ছে না। প্রাইসিংয়ে কমপিটিটিভনেস আনতে চাই। একমাত্র বিপিসি’র ওপর ভরসা করলে হবে না। মানুষের অনেক বিতর্ক আছে। সেই ডায়নামিক প্রাইসের দিকে একবারে যাচ্ছি না। ডায়নামিক প্রাইস বা সয়ংক্রিয় দাম নির্ধারণ পদ্ধতি আমরা বাস্তবায়নের দিকে আস্তে আস্তে যাব। সামনের বছর মার্চ এপ্রিলে শুরু হবে সয়ংক্রিয় দাম নির্ধারণ। তেলের দাম বিশ^ বাজারে যেরকম আছে, যদি বাড়ে, এখানে বাড়বে। কমলে কমবে। আমরা সেইভাবে সমন্বয়ে যাব। দামটা বাইরের দেশ অনুযায়ীই থাকবে। বিদ্যুতেও সেরকম করতে হবে। যে জ্বালানি দিয়েই বিদ্যুৎ তৈরি হোক না কেন তার দামও সে রকম হবে। র ম্যাটেরিয়ালের সাথে সেই প্রাইসটাও যোগ হবে।
এনার্জি বাংলা: বেসরকারি তেলের ক্ষেত্রে রেগুলেটরি বডি কে থাকবে মিনিস্ট্রি না বিপিসি? দাম নির্ধারণ কে করবে?
নসরুল হামিদ: আমরা বিপিসিকে সামনে রেখে একটা প্রাইসিং স্ট্রাকচার তৈরি করেছি। দাম নির্ধারণ করার কাঠামো ঠিক করেছি। আপাতত বিপিসি রেগুলেটেট বডি হিসেবে কাজ করবে। পরে দেখা যাবে কি হবে।
এনার্জি বাংলা: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের সাথে আমাদের জ্বালানি তেলের দামের তুলনা করা ঠিক হবে না। কারণ ভারতের নিয়ন্ত্রণ অনেক ভাল। সাথে আমাদের বিপিসি দীর্ঘদিন পরীক্ষিত। পরীক্ষিত জায়গা থেকে বিপিসিকে বের করে আনা এই মুহূর্তে যৌক্তিক হবে?
নসরুল হামিদ: উনারা উনাদের জাগা থেকে বলতে পারেন। কিন্তু উনারাতো কোনদিন চেষ্টাও করেননি। এখন মনে করেন একটা বিজ্ঞাপন দেখালো টেলিভিশনে। সেটা দেখে একজন পাহাড়ে উঠার চেষ্টা করছে। দুই তিনজন পাশ দিয়ে হেঁটে বলছেÑ না আপনি পারবেন না। পিছলে পড়ে যাবেন। পাহাড়ে উঠবেন না। কিন্তু ঐ ভদ্রলোক কিন্তু জীবনেও পাহাড়ের উপরে উঠতে যায়নি। আরেক ভদ্রলোক এসে বলছে, দেখেন আপনি চেষ্টা করছেন, যান উঠেন। না উঠলে বুঝবেন কিভাবে চ্যালেঞ্জ গুলো কি আছে? তো আগে থেকে জুজু দেখালে দেশ আগে বাড়বে না। বিশ্ব তার উদাহরণ। আমি ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলছি না। যে কোন উন্নত দেশেই যান না কেন। আমারাও উন্নত দেশ হচ্ছি। নিয়ন্ত্রণ যত বেশি করবেন তত বেশি মার্কেট লেভেল তৈরি হয় না। এই নিয়ন্ত্রণের জায়গা থেকে বের হতে হবে। সরকারের উচিত রেগুলেট করা। সরকারের কাজ ব্যবসায় করা নয়, নীতি নির্ধারণ করা।
এনার্জি বাংলা: সবমিলিয়ে কিছু বলতে চান?
নসরুল হামিদ: দেখেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বিদ্যুৎখাতকে বেসরকারিকরণ করতে গেলেন, এরকম সবাই বাধা দিয়েছিলেন। বলেছিল, দেশ তো রসাতলে যাবে। তারা ব্ল্যাক মেইল করবে। দেবে না। এখন দেখেন- এই বিদ্যুৎ বেসরকারিতে যাওয়ার কারণে কিন্তু ব্যাপকভাবে বিদ্যুতায়ন হয়েছে। অতি দ্রুত হয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন জায়গা থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কাজ করছে। হিউজ জব অপরচ্যুনিটি তৈরি হয়েছে। সরকার যদি মনে করত, গার্মেন্টস নিজে বানাবে, বেসরকারি কেন গার্মেন্টস কারখানা হবে? নিজেরা গার্মেন্টস বানাব, এক্সপোর্ট করব, ডলারতো বিদেশে পাচার হওয়ার কথা ছিল? কিন্তু তা কি হয়েছে? আমি মনে করি সময়োনুযায়ী সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। এখন ঐ সনাতনি চিন্তাভাবনা নিয়ে থাকলে পরে দেশ আর আগে বাড়বে না।
বহু দেশের মন্ত্রীদের সাথে আমি কথা বলেছি। অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। প্রথম আমরা প্রথমে বিদ্যুতের দাম পুরোপুরি বাণিজ্যিক করে ফেলব। প্রথমে আবাসিক করা হবে। এলাকাভিত্তিক ফ্লাট রেট হবে। নিদির্ষ্ট একটা গোষ্ঠিকে আমরা ভর্তুকি দিচ্ছি। যারা অনেক নিচের আয়ের মানুষ। প্রতি ইউনিট তিন টাকার বেশি। কিন্তু এটা দিতে গিয়ে দেখছি যারা এর থেকে ৩ গুণ দেয়ার ক্ষমতা রাখে তারাও এটা ভোগ করছে। আমার মনে হয় ভবিষ্যতে এখান থেকে সরে আসা উচিত। এই বিষয়গুলো কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে আসছে। আস্তে আস্তে করা হচ্ছে। অনেকেই সমালোচনা করেছে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কেন হল? ঐ সময় অবশ্যই দরকার ছিল বলেই করা হয়েছিল। এটা এখন বোঝা যাচ্ছে। ঐ সময় যদি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো না আনা হতো, যদি বসে থাকতাম। যে গ্যাসভিক্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আনব। ৬-৭ বছর লাগত একটা কেন্দ্র আনতে। তেলভিত্তিক ৬ মাসের মধ্যে চলে এসেছে।। ইঞ্জিন মেশিন। ইমিডিয়েটলী সার্ভাইবেল কোশ্চেইন যে, আমি তাকে পাওয়ার দিতে চাই। তারপর একটা স্টাটিক অবস্থা থেকে আস্তে আস্তে আমরা মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনায় গিয়েছি। এখন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় এসেছি। এখন তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রায় ৮০০ মেগাওয়াটের উপরে বন্ধ হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে আস্তে আস্তে আরও কমে আসবে। একটা ধারাবাহিক অবস্থায় থাকতে হবে পরিকল্পনাটা। রাতদিন শুধু সমালোচনা করলে হবে না। এইটা করলে ভালো হতো, ওইটা করলে ভালো হতো এইগুলো যারা বলেÑ তাদের বাস্তব কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তারা তো চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যায়নি। শতভাগ বিদ্যুতায়ন করার জন্য কারো অভিজ্ঞতা আছে? আমরা গর্বের সাথে বলতে পারি। আমরা করে দেখিয়েছি। শেখ হাসিনা সরকার করে দেখিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিদ্যুৎ বিভাগ, জ্বালানি বিভাগ করে দেখিয়েছে। আমরা জানি যে কোন অভিজ্ঞতায় কি হতে পারে। এবং ভবিষৎ পরিকল্পনা সেইভাবেই আমরা তৈরি করছি। আমরাই তো আগের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে এসেছি।
এনার্জি বাংলা: ধন্যবাদ আপনাকে।
নসরুল হামিদ: ধন্যবাদ আপনাকেও।
তারপর একটা স্টাটিক অবস্থা থেকে আস্তে আস্তে আমরা মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনায় গিয়েছি। এখন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় এসেছি।
জনগণের কাছে প্রতিযোগিতাপূর্ণ দামে বিদ্যুৎ জ্বালানি পৌঁছানোটা আগামীর চ্যালেঞ্জ
ভবিষ্যতে বলা যাবে না কোন জ্বালানির দাম কত হবে
পরিকল্পনাটা রেখে গেলাম
এই অর্জনের কৃতিত্ব তো আর কেউ নিতে পারবে না