রফিকুল বাসার:
অর্থ আর জ্বালানি সংকটে লোডশেডিং হচ্ছে। একদিকে দেশে গ্যাস উৎপাদন কমেছে। অন্যদিকে অর্থসংকটে জ্বালানি আমদানি বাড়ানো যাচ্ছে না। সংকট এমন পর্যায়ে যে, এই প্রথম টানা সাড়ে চার মাস বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের বিল দিতে পারছে না বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।
বিদ্যুৎ বিক্রি করা অর্থ পাচ্ছে না বলে বেসরকারি উদ্যোক্তারা তেল আমদানি বন্ধ রেখেছে। তাই তাদের অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন বন্ধ।
পিডিবি ও বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, এখনই এই পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ না করলে আসছে গ্রীষ্মে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। লোডশেডিং তখন আরও বাড়বে।
এদিকে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী উদ্যোক্তাদের ডলার বিনিময় হারের পার্থক্যের লোকসান কমাতে বিদ্যুৎ বিভাগে এক হাজার কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছে পিডিবি।
প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। উৎপাদন ক্ষমতা ২১ হাজার ৭১০ মেগাওয়াট। কিন্তু এখন সর্বোচ্চ চাহিদার সময় উৎপাদন হচ্ছে গড়ে সাড়ে ১২ হাজার থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। জ্বালানির অভাবে বন্ধ আছে চার হাজার মেগাওয়াটের বেশি।
কর্তৃপক্ষ বলছে, গ্যাস উৎপাদন ১৯০ কোটি ঘনফুট থেকে বেড়ে হয়েছিল ২৭০। এখন আবার কমে হয়েছে ২৩০ কোটি ঘনফুট। তাই দেশীয় গ্যাস সংকট তৈরি হয়েছে। দেশের গ্যাস উৎপাদন কম আর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি তাই কেনা যাচ্ছে না। এই দুই মিলে গ্যাসের সংকট।
গ্রিড বিপর্যয়ের পরিস্থিতি সামাল দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে। গরম কমেছে, আবহাওয়া নরম। গ্রামাঞ্চলে সকালে এখন শীতের অনুভূতি। এতে বিদ্যুতের চাহিদা কমেছে। কিন্তু তারপরও এখনও লোডশেডিং হচ্ছে। শহরে তিন থেকে চারবার লোডশেডিং হচ্ছে। প্রতিবার কমপক্ষে একঘণ্টা করে বিদ্যুৎ থাকছে না। গ্রামে পরিস্থিতি আরও খারাপ।
বিদ্যুতের চাহিদা কমার পরও পুরোপুরি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ঘাটতি নিয়েই চলতে হচ্ছে। পরিকল্পিত এই লোডশেডিং এর মূল কারণ অর্থ সংকট।
এখান থেকে বের হয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা।
অর্থ সংকট মেটাতে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
করোনার পরে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানিসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সংকট দেখা দিয়েছে ডলারের। বাংলাদেশও সেই সমস্যায় ভুগছে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ঠরা।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন এনার্জি বাংলাকে বলেন, আর্থিক সংকট সমাধানের চেষ্টা চলছে। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের যে বকেয়া তা কিভাবে দেয়া যায় তা নিয়ে পিডিবির সাথে আলোচনা চলছে। সমাধান সহসাই হবে। এছাড়া উৎপাদন শুরু হওয়ার অপেক্ষায় থাকা বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো একবছরের মধ্যে চালু হবে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসবে। তখন এ সংকট থাকবেনা।
আইপিপির বিল বাকি
বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার পর ৪৫ দিনের মধ্যে পরিশোধ করে পিডিবি। এতে এই দেড় মাসে গড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ৪৫ দিন পার হয়ে সাড়ে চার মাস হয়েছে। আর্থিক সংকটে এই বিল শোধ করতে পারছে না পিডিবি। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার পর থেকে এই প্রথম এমন বিল দিতে না পারার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আগে কখনও বিল বকেয়া থাকেনি। এতে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর পাওনা প্রায় বিশ হাজার কোটি টাকায় ঠেকেছে। বিল না পাওয়ায় ফার্নেস ওয়েল আমদানি করতে পারছে না উদ্যোক্তারা। তাই অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ। এটা চলমান লোডশেডিং এর অন্যতম একটা কারণ।
বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশের ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস এসোসিয়েশনের (বিপপা) সভাপতি ইমরান করিম এনার্জি বাংলাকে বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন করার পরও তারা বিল না পাওয়ায় প্রত্যেক কোম্পানি আর্থিক সংকটে ভুগছে। বিশেষ করে ছোট ছোট কোম্পানিগুলো খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। তেল কিনতে পারছে না। তাই উৎপাদন-ও তাদের বন্ধ। উপরন্ত এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যে অনেক কোম্পানির মূলধন শূন্য হওয়ার পথে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে বিল শোধ করা নিয়ে সমস্যা শুরু হয় পিডিবির। এখন সমস্যা চূড়ান্ত জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে।
তিনি বলেন, আইপিপি থেকে এখন দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু এই বিল বকেয়া না থাকলে চার হাজার মেগাওয়াট হত। তখন আর লোডশেডিং হতো না।
ডলার উঠানাময় লোকসান
হাজার কোটি বরাদ্দের প্রস্তাব
ডলারের দাম উঠা নামায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গত কয়েক মাস ধরে লোকসান দিয়েছে। প্রতি ডলারে পিডিবি ধরেছে ৮৫ টাকা কিন্তু এলসি খুলতে খরচ হয়েছে ১০৮ টাকা। এই পার্থক্যে গত কয়েক মাসে তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে বলে জানিয়েছে আইপিপি উদ্যোক্তারা। আইপিপিদের এই ক্ষতি পোষাতে পিডিবি এক হাজার কোটি টাকা সাহায়তার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগে প্রস্তাব পাঠিয়েছে বলে জানা গেছে।
হাজার হাজার কোটি খরচ
তবু অবস্থা তথৈবচ
গত পাঁচ বছর বিদ্যুৎ জ্বালানিখাতে সরকারিভাবে গড়ে প্রতিবছর ২৭ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করা হয়েছে। পাঁচবছরে খরচ হয়েছে এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও গত ১১ বছরে (২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২) বিভিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারি কোম্পানিকে ৯০ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে। অথচ এখনও সাশ্রয়ী নির্ভরশীল বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা যায়নি। এখনও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রিডের বিদ্যুতে আস্থা রাখতে পারে না।