আগামী ২০ বছরে ঢাকার তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি বেড়ে যাবে, বলছে আন্তর্জাতিক গবেষণা
ইবি ডেস্ক/বিবিসি বাংলা:
আন্তর্জাতিক এক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে সেই ধারা অব্যাহত থাকলে রাজধানী ঢাকাসহ পাঁচটি বড় শহর আগামী কয়েক বছরে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠবে।
গবেষকরা বলছেন, বর্তমান প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী- এই চারটি জেলা শহরে রাত ও দিনের তাপমাত্রার পার্থক্য বা তারতম্য কমে আসবে, ফলে সবসময় গরম অনুভূত হবে।
গবেষণা বলছে, গত ২০ বছরে রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস যেখানে সারা বিশ্বে তাপমাত্রা-বৃদ্ধিকে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার জন্য লড়াই চলছে।
“এই অত্যধিক গরম হয়ে পড়বে শহরগুলোর জন্য পরিবেশগত বাড়তি সমস্যা। বাংলাদেশের সরকারি নীতিমালা তৈরি হয়েছে মূলত ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগকে কেন্দ্র করে। কারণ এতদিন এই দুটোই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এখন আরো নতুন কিছু চ্যালেঞ্জ যোগ হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে নগরাঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি,” বলেন ড. আশরাফ দেওয়ান, যিনি এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন।
অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। কানাডার ক্যালগভরি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের গবেষকরাও এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
ভূ-উপগ্রহ থেকে পাওয়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও সিলেট- এই পাঁচটি শহরের দিনের ও রাতের তাপমাত্রার ধরন বিশ্লেষণ করে এই গবেষণাটি চালানো হয়। এর মধ্যে ছিল প্রতিদিনের দুটো তথ্য- দুপুরের ও রাতের তাপমাত্রা। এছাড়াও প্রায় আট হাজার স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করা হয়েছে এই গবেষণায়।
নগর বিষয়ক সুপরিচিত এক আন্তর্জাতিক সাময়িকী ‘সাসটেইনেবল সিটিজ এন্ড সোসাইটি’তে এপ্রিল মাসে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে নগরাঞ্চলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। কারণ আগামী ৩০ বছর অর্থাৎ ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষ নগরে বসবাস করবে।
গবেষকরা বলছেন, ততদিনে বাংলাদেশও একটি নগর রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী এবং স্কুল অব আর্থ এন্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক ড. আশরাফ দেওয়ান বলছেন, তাপমাত্রা এভাবে বাড়তে থাকলে আগামী পাঁচ বছরেই শহরগুলো বসবাসের জন্য অযোগ্য হয়ে যাবে।
“শহরগুলোকে ঠাণ্ডা রাখার জন্য প্রচুর পরিমাণে এয়ার কন্ডিশনার বা এসি ও পানি ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে। অর্থাৎ শক্তি-সম্পদ ও পানি সম্পদের ওপরেও চাপ অত্যধিক পরিমাণে বেড়ে যাবে। এর ফলে পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করবে,” বলেন তিনি।
গবেষকরা ধারণা করছেন, এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০ বছর পরে বড় বড় শহরগুলোর তাপমাত্রা গ্রামাঞ্চলের তুলনায় পাঁচ থেকে ছয় ডিগ্রি পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
যে হারে বাড়ছে
গবেষণায় বলা হয়েছে রাজধানী ঢাকা শহরের দিনের তাপমাত্রা ২০০০ সাল থেকে ২০১৯ সালে অর্থাৎ এই ২০ বছরে গ্রামাঞ্চলের তাপমাত্রার তুলনায় ২ দশমিক ৭৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে।
একই অবস্থা হয়েছে আরো তিনটি শহরে- বন্দরনগরী চট্টগ্রামে বেড়েছে ১ দশমিক ৯২ ডিগ্রি, খুলনায় ১ দশমিক ২৭, সিলেটে ১ দশমিক ১, রাজশাহীতে বেড়েছে সবচেয়ে কম শূন্য দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
একেক শহরে একেক হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে কী কারণ থাকতে পারে জানতে চাইলে প্রধান গবেষক মি.দেওয়ান বলেন, এটা বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে।
“জনসংখ্যা কতো, তার ঘনত্ব কেমন, মানুষের কর্মকাণ্ড কী ধরনের- এসবের ওপর নির্ভর করে কোথায় তাপমাত্রা কেমন হবে,” বলেন তিনি।
ঢাকার তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধির পেছনে এর জনসংখ্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলাভূমি ভরাট ও গাছপালা কেটে ফেলাকেই দায়ী করা হয়েছে।
রাতের চট্টগ্রাম ও রাতের খুলনা
গবেষণায় দেখা গেছে, রাতের চট্টগ্রামের তাপমাত্রা রাজধানী ঢাকার রাতের তাপমাত্রার চেয়েও বেড়েছে।
এজন্য বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন গবেষকরা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, রাতের বেলায় বঙ্গোপসাগর থেকে যে বায়ু চট্টগ্রামের শহরের ওপর দিয়ে বয়ে যায় সেটি ক্রমশ উষ্ণ হচ্ছে। ফলে রাতে এই শহরের তাপমাত্রা আগের চেয়ে বেড়েছে।
গবেষকরা বলছেন, এর পেছনে রয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু দুর্বল হয়ে যাওয়া, ফলে আগের মতো বৃষ্টিপাত হচ্ছে না।
পাহাড় কেটে ফেলাও এর পেছনে বড় কারণ বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পাহাড় কমে যাওয়ার ফলে ওই শহরে বৃষ্টিপাতও কমে গেছে।
গবেষণায় আরো দেখা গেছে, রাতের বেলায় খুলনা শহরের তাপমাত্রা আগের তুলনায় কমেছে। বলা হচ্ছে এই শহরে নগরায়ণ কম হওয়া এবং জলাভূমি বেশি থাকায় সেখানে তাপমাত্রা কমেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনই কি প্রধান কারণ
বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে সারা বিশ্বেই বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশেও একই কারণে সেটা বাড়ছে। কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরো কতোগুলো বিষয়।
“বাংলাদেশের নগরগুলোর উপর আমরা যে গবেষণা চালিয়েছি তাতে দেখেছি জলবায়ুর পরিবর্তন যতোটা দায়ী, তার চেয়েও বেশি দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নগরের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং দুর্বল পরিবেশ ব্যবস্থাপনা,” বলেন মি.দেওয়ান।
শহরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য এই গবেষণায় অতিরিক্ত জনসংখ্যাকেও দায়ী করা হয়েছে।
“শহরের মাত্রাতিরিক্ত জনঘনত্বের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের শরীরের একটা নিজস্ব তাপমাত্রা রয়েছে যাকে বলা হয় মেটাবলিক হিটিং। প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ১০০ ওয়াট। একটা জায়গায় যতো বেশি মানুষ থাকবে সেখানে তাপমাত্রাও তত বেশি হবে।”
শহরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে আগের তুলনায় প্রচুর সংখ্যক এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে এখান থেকে যে তাপ তৈরি হচ্ছে সেটা আশেপাশের পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।
এর সঙ্গে রয়েছে বাড়িঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা, পরিবহন নেটওয়ার্ক, সবুজের অভাব।
“ভবনের সঙ্গে এতো বেশি এবং এসব ভবন যেসব সামগ্রী দিয়ে নির্মিত সেগুলো দিনের বেলায় প্রচুর তাপ শুষে নেয়। রাতের বেলায় এই তাপ যে হারে ফিরে যাওয়ার কথা সেই হারে ফিরতে পারে না। কারণ ভবনগুলো জলবায়ু সংবেদনশীল নয়,” বলেন আশরাফ দেওয়ান।
কী করতে হবে
বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঠেকাতে এখনই “স্থানীয় উদ্ভাবন” কাজে লাগাতে হবে। অর্থাৎ যে শহরে যেরকম পরিস্থিতি সে অনুযায়ী সেখানে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সব জায়গায় একই ধরনের পদক্ষেপ নিলে সেটা কার্যকরী হবে না।
“কয়েক দশক আগে ঢাকার শহরের জন্য যে মাস্টার প্ল্যান করা হয়েছিল তাতে আজকের দিনের এতো অধিক সংখ্যক জনসংখ্যার কথা বিবেচনা করা হয়নি। এর ফলে ঢাকায় অপরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন হচ্ছে। তাই শহরের স্থানীয় ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জনমিতিকে মাথায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি,” বলেন মি. দেওয়ান।
তিনি বলেন, এখন যে জায়গাগুলো সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত সেখানে সবার আগে সবুজ পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। গাছপালা লাগানোর পাশাপাশি পরিবেশ-বান্ধব গ্রিন ইটের ব্যবহারও বাড়াতে হবে।
পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. আশরাফ দেওয়ান বলেন, “ছিদ্রওয়ালা ইট দিয়ে বাড়ি ও দালান তৈরির ব্যাপারে লোকজনকে উৎসাহিত করতে হবে। কারণ এধরনের ইট তাপ ধরে রাখে না। কিন্তু সলিড ইট তাপ ধরে রাখে এবং তার ফলেই তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।”