বিদ্যুৎ নিয়ে বিলাসিতা: এক রাস্তায় দুই বিতরণ লাইন

একই রাস্তা। একই খুঁটি। কিন্তু বিদ্যুতের বিতরণ লাইন দুটো। আবার রাস্তায় যেখানে একটি বিতরণ লাইন হলে হয়, সেখানে সেই রাস্তার দুই পাশে দুই লাইন। এক বাড়ি বা গ্রাহককেই দুই জায়গা থেকে বিদ্যুৎ দেয়া হচ্ছে।
একদিকে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা বিদ্যুৎহীন। বিতরণ লাইন ও ট্রান্সফরমারের অভাবে ঠিকমত বিদ্যুৎ দেয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে এক জায়গাতেই দুটো অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুতের বিতরণ লাইন। দুটো ট্রান্সফরমার। রাস্তার একপাশে বিদ্যুতের বিতরণ লাইন বসানো আছে। তবু অন্যপাশে আরও একটি লাইন বসানো হচ্ছে। কিন্তু এক খুঁটিতে দুই প্রতিষ্ঠান দুটো লাইন টানছে। এক প্রতিষ্ঠান খুঁটির মাথায় তার টেনেছে। অন্যরা খুঁটির মাঝ বরাবর। একজন গ্রাহককে নিতে হচ্ছে দুই মিটার, দুই লাইন। এ ঘটনা দেশের প্রায় সকল জেলায়।
এমন ১২ হাজার কিলোমিটার দ্বৈত বিদ্যুতের লাইন থাকার খবর জানা গেছে। আজানা রয়েগেছে আরও অনেক। শহর এলাকা দেখিয়ে নকল নকশা তৈরী করে পিডিবি সংশিèষ্ঠরা বিতরণ লাইন করার অনুমোদন নিয়ে নিচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন নিয়ে দিনের পর দিন এভাবে কোটি কোটি টাকা অপচয়-দুর্নীতি হলেও দেখার যেন কেউ নেই। আলোচনা হয়। উদ্যোগ নেয়া হয়। আবার তা থেমে যায়। আবার চলতে থাকে দ্বৈত লাইন নির্মান কাজ। এ ঘটনা গোপন নয়। চোখের সামনেই হচ্ছে। উর্দ্ধতন কর্তাব্যক্তিরা সব জানেন। তাদের চোখের সামনেই সব ঘটছে। তারা স্বীকার করেছেন, হ্যাঁ অপচয় হচ্ছে। উচিত হচ্ছে না এমন লাইন করা। তবুও হচ্ছে। তবু এই অনিয়ম-দুর্নীতি-অপচয় বল্পব্দ করছেন না তারা। এক দিকে বিদ্যুৎ নেই। কোন স্থানে বিদ্যুৎ পৌছানোই যাচ্ছে না। আর কোন জায়গাতে একই লাইন দুবার বসানো হচ্ছে।
এতে অপচয় হয়েছে এবং হচ্ছে রাস্ট্রের নগদ অর্থ। প্রতিনিয়ত অপচয় হচ্ছে বিদ্যুৎ। কোন কাজে লাগছে না, অথচ বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছেই। অকারণে অলস পড়ে আছে হাজার হাজার কিলোমিটার বিদ্যুতের লাইন। এমন লাইন আগেও করা হয়েছে। এখনও করা হচ্ছে। যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার হচ্ছে অর্থ।
এই কাজে অর্থের ছাড় দিয়ে যাচ্ছে মন্ত্রনালয়। যাচাই বাছাই না করে যেখানে লাইন আছে সেখানে আরও একটি লাইন করার অনুমোতি দেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। হামেসাই ছাড় হচ্ছে অর্থের। অর্থাৎ পুরো প্রত্রিক্রয়ার মধ্যে মন্ত্রী সচিব, পিডিবি আরইবি উর্ধতন কর্মকর্তা থেকে শুর“ করে বাস্তবায়নকারী সকলেই জড়িত। এই সকলেই জানেন এক রাস্তায় দুটো বিতরণ লাইন অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। তবু থামছে না।
এই অবস্থা তৈরী করেছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) আর বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উল্পæয়ন বোর্ড (বিউবো)। নতুন যোগ হয়েছে পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ওজোপাডিকো)। সরকারের নিদিষ্ট আইন থাকলেও তা মানছে না পিডিবি কিম্বা ওজোপাডিকো। বিদ্যুৎ বিতরণের জন্য বাংলাদেশে পাঁচটি সরকারি প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি আছে। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা আলাদা ভৌগলিক এলাকা নিদিস্ট করে দেয়া আছে। দেশের গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ দিয়ে থাকে আরইবি। জেলা শহর গুলোতে পিডিবি। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিাঞ্চলের শহরগুলোতে ওজোপাডিকো। এবং রাজধানির দুই অংশে ডিপিডিসি ও ডেসকো। সমস্যা তৈরী করে রাখা হয়েছে আরইবি পিডিবি ও ওজোপাডিকো’র মধ্যে।
দেশের প্রায় ২৩টি জেলায় এভাবে ১১ হাজার ৯৫২ কিলোমিটার কিলোমিটার দ্বৈত লাইন স্খাপন করা হয়েছে। এরমধ্যে আরইবি দাবি করছে তাদের লাইন আছে অথচ সেখানে আবার পিডিবি করেছে নয় হাজার ৮৪৮ কিলোমিটার। আর ওজোপাডিকো করেছে দুই হাজার ১০৪ কিলোমিটার।
বর্তমানে গ্রামের জনবসতি হিসাবে এক কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইনে গড়ে ৪৪জন গ্রাহক সংযোগ নিতে পারে। এই হিসাবে ১২ হাজার কিলোমিটার নতুন এলাকায় লাইন করা হলে পাঁচ লাখ ২৮ হাজার নতুন সংযোগ দেয়া যেত। গড়ে পরিবার প্রতি পাঁচজন মানুষ থাকলে ২৬ লাখ ৪০ হাজার মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পেত।
প্রতি কিলোমিটার বিদ্যুতের সরবরাহ লাইন বসাতে গড়ে প্রয়োজন হয় ১০ লাখ টাকা। এই হিসেবে এখন পর্যšø এভাবে দ্বৈত লাইন করার জন্য সরাসরি প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকা অপচয় হয়েছে। সম্পূর্ণ অকারণে, অপ্রয়োজনে এই টাকা খরচ করা হয়েছে।
টাঙ্গাইলে সবচেয়ে বেশি দ্বৈত লাইন আছে। টাঙ্গাইলে একই রাস্তায় অপ্রয়োজনে দুই পাশে বিদ্যুতের লাইন আছে এক হাজার ৮৯ কিলোমিটার। সেখানে কইজুরি পাকা রাস্তা মোড় থেকে আকন্দপাড়া মসজিদ পর্যন্ত, দৌজা চায়নাখোলা পাকা রাস্তা থেকে চায়নাখোলা পর্যন্ত, সমোজার বাড়ি, মঙ্গলহট, মাজার বাড়ি, করতিয়া, নথখোলাসহ বিভিন্ন স্খানে দ্বৈত লাইন আছে। ময়মনসিংহে রহমতপুর বাজার, ফলদা ঘোনারপাড়া, ঢেপাকান্দি, ছয়আনি বকশিয়া, কদিম নিকলা, দিঘর, গুনড়গ্রাম ও ফলবাড়িয়াতে ১৭১ কিলোমিটার এমন লাইন। ঠাকুরগাও এ শাšিøনগর, দণি জগন্নাথপুর, নালন্দর শাহাপাড়া, হরিপরপুর, নিমবাড়ি বাজারে ৮৯ কিলোমিটার দ্বৈত লাইন আছে। নোয়াখালির কিসমত করিমপুর, মিরওয়ারিশপুর, কেন্দুর বাগ, আমানতপুর, নাজিরপুর, আলীপুর, মুজাহিদপুর ও একলাশপুরে ৯৭ কিলোমিটার দ্বৈত লাইন আছে। কুমিল্লার শুভপুর, তিনপাড়া, খামারপদুয়া, বরাইশ, যুগিরহাট, তুলা পুস্করনি একই রাস্তায় দুই লাইন। সাতক্ষীরার মাছখোলা, দহাকুলা-এল্লারচর, কদমতলা বাজার এলাকা, সদর থানার আলপিুর ও খানপুর, বকচরা ও দত্তডাঙ্গা এবং কাশেমপুরে ১২ কিলোমিটার দ্বৈত লাইন করা হয়েছে। এছাড়া ব্রাহ্মমনবাড়িয়াতে ৬৫ কিলোমিটার, চট্টগ্রামে ৩৫২ কিলোমিটার, ফরিদপুরে ৩৭ কিলোমিটার, যশোরে ৯৭ কিলোমিটার, নাটোরে পাঁচ কিলোমিটার, রংপুরে ১১ কিলোমিটার, সিরাজগঞ্জে ৩৭ কিলোমিটার, সুনামগঞ্জে ১০ কিলোমিটার, এবং সিলেটে ১৭ কিলোমিটার দ্বৈত বিদ্যুতের লাইন আছে।
যেসব এলাকায় এমন লাইন সেখানে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে এলাকাবাসী। একই ঝুঁকিতে কাজ করছে বিদ্যুতের লাইন মেরামতকারীরাও। যে কোন সময় বড় ধরণের বিপদ মাথায় নিয়ে চলতে হয়। বিদ্যুৎ বকেয়ার কারণে আরইবি সংযোগ বিচ্ছিল্পæ করে দিয়েছে। সেখানে সেই গ্রাহককে আবার পিডিবি গিয়ে সংযোগ দিয়েছে। একই বাড়িতে একজন গ্রাহক দুই লাইনে দুই মিটার লাগিয়ে নিয়েছে। যখন যে লাইনে লোডশোডিং থাকছে তখন সেই লাইন বল্পব্দ রাখছে। কোন কোন ক্ষেত্রে একজন গ্রাহককে বাধ্য করা হচ্ছে উভয়ের সংযোগ নিতে। তবে বেশিরভাগ গ্রাহক পিডিবির সংযোগ নিতে আগ্রহী। কারণ পিডিবির বিদ্যুতের দাম কম। এবং লোডশেডিংও কম। এছাড়া আরইবি’র সংযোগ পেতে সময় বেশি লাগে বলেও অভিযোগ আছে। আরইবির সংযোগ নিলে পরবর্তীকালে অনেক ধরণের খরচ বহন করতে হয়। যা পিডিবি’র ক্ষেত্রে লাগে না।
তদন্ত কমিটি: বিষয়টি তদন্ত করার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ (মন্ত্রনালয়) থেকে তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। পিডিবি ও আরইবি এর বিষয় দেখার জন্য একটি, আরইবি ও ওজোপাডিকোর বিষয় দেখার জন্য একটি এবং সারাদেশের সামগ্রীক চিত্র দেখার জন্য একটি। এই তিন কমিটির প্রথম দুটো কমিটির আহবায়ক পাওয়ার সেলের পরিচালক আ¦ন্ধুর রউফ মিয়া। পরের কমিটির আহবায়ক পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন। দ্বৈত লাইন থাকার বিষয়টি তদন্ত করে পাওয়া গেছে বলে তিনি জানান।
আব্দুর রউফ মিয়া বলেন, এভাবে দ্বৈত লাইন থাকা অবশ্যই অর্থের অপচয়। একটি বিশৃংখল পরিস্থিতিও বটে। সাথে আছে ঝুঁকি। দেশের এক এক স্থানে এক এক ধরণে এই লাইন করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। আশা করি আগামী এক মাসের মধ্যে সারাদেশের চিত্র তুলে ধরে সুপারিশসহ চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া সম্ভব হবে।
কর্তৃপক্ষের কথা: এবিষয়ে জানতে চাইলে পিডিবি চেয়ারম্যান আবদুহু রুহুল্লা বলেন, বিচ্ছিন্ন কিছু এলাকায় এমন লাইন থাকতে পারে। সেটা আমার জানা নেই। তিনি বলেন, ছোট ছোট অনেক বিতরণ লাইন করা হয় যার অনুমোতি নিতে আমার পর্যন্ত আসা লাগে না। স্থানীয়ভাবে প্রয়োজন অনুযায়ি কর্মকর্তারা সেটা করে থাকে। তিনি বলেন, প্রয়োজন হলে, চাহিদা অনেক বেশি থাকলে এক রাস্তায় দুটো বিতরণ লাইন হতেই পারে। তবে একই এলাকায় আরইবি আর পিডিবি দুটো বিতরণ লাইন যদি করে থাকে তবে তা ঠিক হয়নি। দুই প্রতিষ্ঠান এক এলাকায় কাজ করতে পারে না। পিডিবি শুধু তাদের নিজস্ব এলাকায় কাজ করে।
আরইবি চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারের মঈনউদ্দিন বলেন, রাস্ট্রীয় সম্পদের এই অপচয় বন্ধ হওয়া উচিত। এতে শৃংখলা নস্ট হচ্ছে। অর্থের ক্ষতি হচ্ছে। অনাকাক্ষিত প্রতিযোগিতা হচ্ছে। কারিগরি সমস্যা তৈরী হচ্ছে। সমস্যা এবং মাথায় বিপদ বা ঝুঁকি নিয়ে জীবন যাপন করছে এলাকাবাসী। এতে বৈষম্য বাড়ছে। সামাজিক দলাদলি তৈরী হচ্ছে। একই মন্ত্রনালয়ের অধীনে থেকে এক রাস্তায় দুই প্রতিষ্ঠান একই কাজ করবে এটা এটা ঠিক নয়। এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সদস্য বিতরণ স্বপন কুমার সাহা বলেন, পিডিবি তার নিজের এলাকায় বিতরণ লাইন করছে। অন্য কোন এলাকায় করছে না। আইনের বাইরে গিয়ে লাইন করার কোন সুযোগ নেই। আইনের বাইরে লাইন করারও কথা না। তবু যদি কেউ লাইন করে থাকে আর তার নিদিস্ট অভিযোগ থাকে তবে তা দেখা হবে।
নিয়ম: আইন অনুযায়ি একই এলাকায় দুই সংস্থা কাজ করতে পারেনা। তাদের এলাকা ভাগ করে দেয়া আছে। সরকার আইন করে এলাকা ভাগ করে দিয়েছে। তবুও নানা অজুহাত দেখিয়ে উভয়ের মধ্যে সমস্যা জিইয়ে রাখা হয়েছে। বিদ্যুত মন্ত্রনালয়, পিডিবি ও পবিসের ত্রিপক্ষিয় চুক্তি অনুযায়ী ১৯৮১ সালের ১৪ এপ্রিল পবিসকে আনুষ্ঠানিকভাবে উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে পিডিবির বিদ্যুতাঞ্চল হস্টøাšøর করা হয়। ২০১৩ সালের ৫৭ নম্বর আইনের ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন পল্লী এলাকায় বোর্ড (আরইবি) কর্তৃক বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিচালন বা বিতরণ পদ্ধতি স্থাপনের পর উক্ত পল্লী এলাকা পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশন বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ অন্তর্ভূক্ত হলে অনুরূপ স্থাপিত বোর্ড কর্তৃক বিদ্যুৎ উৎপাদন, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার কার্য এইরূপে চলমান থাকবে যেন ঐ এলাকা পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশন বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষের অর্ন্তভূক্ত হয় নাই। ’
এছাড়া সাধারনত একই নামে একই বাড়িতে বিদ্যুতের দুই লাইন নেয়ার নিয়ম নেই। প্রয়োজনে এক লাইনের মধ্যেমে একাধিক মিটার বা লোড বাড়ানো যেতে পারে। তবে লাইন নয়। লাইন দুটো নেয়া যেতে পারে তবে তা ভিন্ন নামে। দুই ফিডার থেকে একই বাড়িতে বা প্রতিষ্ঠানে সংযোগ নিতে হলেও কর্তৃপরে অনুমোতি নিতে হয়। উল্লেখ্য, কয়েকবছর আগে রমজানে ঢাকা শহরের কিছু মসজিদে বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক রাখতে দুই ফিডার থেকে সংযোগ দেয়া হয়েছিল। যাতে এক জায়গা থেকে বিদ্যুৎ চলে গেলেও অন্য এলাকা থেকে সরবরাহ থাকে। বিদ্যুৎ বিভাগের অনুমোতি সাপেে এই কাজ করা হয়েছিল।