এলপিজি’র ভর্তূকি মধ্যস্বত্ত্ব’র পকেটে
তরল খনিজ গ্যাস (এলপিজি) বা বোতল গ্যাস নিয়ে চলছে যাচ্ছেতাই অবস্থা। বাজারে কারও কোন নিয়ন্ত্রন নেই। ইচ্ছেমত দামে বিক্রি হচ্ছে। সরকার এতে যে ভর্তূকি দিচ্ছে তা সাধারণ গ্রাহক পাচ্ছে না, যাচ্ছে মধ্যস্বত্ত্বভোগীর পকেটে। শুধু তাই নয় ভূঁই ফোঁড় একাধিক কোম্পানি করছে বোতল। এতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে গ্যাস ব্যবহারে যে বৈষম্য তা না কমে আরও বাড়ছে।
এই অবস্থায় সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী তিন বছরের মধ্যে সাশ্রয়ীমূল্যে সারাদেশে এলপি গ্যাস সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছেন।
তরল খনিজ গ্যাস (এলপিজি) বা বোতল গ্যাসের ভর্তূকির কিছুই পাচ্ছে না গ্রাহকরা। মধ্যস্বত্বভোগিরা ভর্তূকির টাকা নিয়ে নিচ্ছে। এতে বাজার অস্থির হয়ে আছে। কোনভাবেই দাম নিয়ন্ত্রিত থাকছে না। এই সুযোগে বেশি দামে বিক্রি করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে একদিকে যেমন সরকার কম দামে বিত্রিক্রর জন্য রাজস্ব হারাচ্ছে অন্যদিকে গ্রাহকরা তার সুবিধা পাচ্ছে না।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এবিষয়ে বলেন, আগামী তিন বছরের মধ্যে ৭০ ভাগ মানুষের মধ্যে এলপিজি পৌছে দেয়া হবে। আবাসিকে আর নতুন করে পাইপের গ্যাস দেয়া হবে না। এজন্য প্রয়োজনে ভর্তহৃকি দেয়া হবে। এলপি গ্যাসের নিয়ন্ণের বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এবিষয়ে একটি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তৈরী করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা হবে।
দেশের যেসব এলাকায় পাইপে গ্যাস নেই সেখানে সরকার ভর্তুকি দিয়ে বোতল গ্যাস সরবরাহ করে। কিন্তু সে সুবিধা সাধারণ মানুষ পায় না। শুধু ভর্তুকির অর্থই মধ্যস্বত্ত্বভোগিরা নিচ্ছে তা নয় সাথে বাড়তি টাকাও নিচ্ছে। প্রতি বোতলে প্রায় ৪০০ টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। কিন্তু তার কানাকড়িও নির্দিষ্ট সুবিধাভোগির কাছে পৌছচ্ছে না।
সরকারি প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা কম মূল্যে বোতল গ্যাস বিক্রি করে। কম দামে কিনে যে দামে বিক্রি করার কথা তা করছে না মধ্যস্বত্ত্বভোগি বা ডিলার বা বিক্রেতারা। ঢাকাসহ সারা দেশে এই চিত্র। ঢাকাসহ এর আশপাশে পাইপে গ্যাস থাকলেও একাধিক হোটেল, ছোট প্রকৌশল শিল্পসহ অনেকেই বোতল গ্যাস ব্যবহার করে। নিয়ন্ত্রণ এবং জবাবদীহি না থাকার কারণে এই সুবিধা সাধারণ মানুষের কাছে পৌছানো যাচ্ছে না।
ন্যায্য দাম নেই বাজারে
ছোট প্রকৌশল শিল্প ও আবাসিক মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা এলপিজি। সরকারি ও বেসরকারিভাবে এলপিজি বিক্রি করা হয়। পাইপ লাইনে গ্যাস নেই এমন এলাকায় এলপিজি ব্যবহার বেশি। সরকারি ভাবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশসনের (বিপিসি) কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে এলপিজি সরবরাহ করে। বেসরকারিভাবে বসুন্ধরা এলপিজি, পেট্রোগ্যাস, যমুনা, টোটাল গ্যাস এবং বাংলাদেশ অক্সিজেন কোম্পানি (বিওসি)সহ অনেকে বিক্রি করে।
সরকারি এলপিজি সাড়ে ১২ কেজি ওজনের প্রতি বোতল ৭০০ টাকায় বিক্রি করার কথা। সরকার ভর্তুকি দিয়ে এর দাম ৭০০ টাকা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু সে দামে কোথাও বিক্রি হয়না। প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি হয় বাজারে। বেসরকারি এলপিজির সিলিণ্ডারের দাম এক হাজার ২০০ টাকা। কিন্তিু বিক্রি হয় আরও বেশি দামে।
বিপিসি জানায়, প্রতি বোতলে প্রায় ৪০০ টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়। কনডেনসেট থেকে এলপিজি তৈরি করতে খরচ হয় প্রায় এক হাজার ১০০ টাকা। কিন্তু কারখানা মুখে বিক্রি করা হয় ৬৪০ টাকায়। আর সাধারণ গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করার কথা ৭০০ টাকায়।
বেসরকারি কোম্পানি পেট্রোগ্যাস এর ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী জাকারিয়া জালাল জানান, বাজার নিয়ন্ত্রনে কোম্পানির কোন হাত নেই। নির্দিষ্ট দামে বিক্রেতারা কোম্পানি থেকে কিনে নিয়ে যায়। তারপর কত দামে কীভাবে বিক্রি করে তা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কোম্পানির থাকে না। কারখানা মুখে গড়ে এক হাজার ১০০ টাকায় সাড়ে ১২ কোজির বোতল গ্যাস সহ বিক্রি করা হয় বলে তিনি জানান। গ্যাস ভরার জন্য বোতল থেকে কর তুলে নিলে গ্যাসের দাম কমানো সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন।
জানা গেছে, সরকারি বোতলগুলোর গায়ের ছিলমোহর দ্রুত মুছে ফেলা হয়। ফলে বোঝা যায় না কোনটা সরকারি কোনটা বেসরকারি। দোকানীরা বেসরকারি ও সরকারি উভয় বোতল একই দামে বিক্রি করে। একই দোকানে উভয় বোতল বিক্রি হয়। এতে করে স্বাভাবিকভাবেই দামের তারতম্য হয়ে থাকে।
তবে সংশ্রিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, সরকারি বোতল বাজারে বিক্রি হয় খুব কম। বেশিরভাগ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কাছে সরাসরি বিক্রি করা হয়। এতে সরকারি ঐ কম দামের বোতল বাজারে প্রভাব ফেলতে পারে না। যতটুকু বাজারে আসে তা বেসরকরি বাজারের তুলনায় খুব কম।
জ্বালানি বিভাগের সচিব আবু বক্কর সিদ্দিকী বলেন, সরকারিভাবে যে এলপিজি বিক্রি করা হয় তা চাহিদার তুলনায় কম। বেসরকারিভাবে অনেক কো¤ক্সানি এখন এলপিজি বিক্রি করছে। সরকার বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। তবে বাজার অস্থির করে নয়। যত বেশি কোম্পানি থাকবে তত বেশি বাজার নিয়ন্ত্রিত থাকবে।
ঢাকার বাড্ডা এলাকার একজন এলপিজি বিক্রেতা বলেন, কোম্পানি যে দাম ঠিক করে দেয় সেই দামেই বিক্রি করতে হয়। সেখান থেকে কমিশন থাকে। বাজারে যখন দুএক সময় কম সিলিন্ডার থাকে পাওয়া যায় না তখন আমাদেরও বেশি দামে আনতে হয়। তখন একটু বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। ঢাকা শহরেরর মধ্যেই ভিন্ন ভিন্ন দামে সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে বলে তিনি জানান। বলেন, ‘যার কাছ থেকে যেমন নেয়া যায়’ – এই দামেও অনেকে সিলিন্ডার বিক্রি করে। একদামে বিক্রি করতে পারলে ভাল বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই
এলপিজি’র দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোন ভূমিকা নেই। বাজার তার নিজের গতিতেই চলছে। এতে সিন্ডিকেট করে বাজারে প্রভাব ফেলছে বেসরকারি বড় বড় কোম্পানিগুলো। তারা যে দাম নির্ধারণ করছে সেই দামেই কিনতে হচ্ছে। এই দাম নিয়ন্ত্রণ সরকারের কোন ভূমিকা নেই। এবিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি সচিব বলেন, বিপিসির লাইসেন্স দেয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। তাছাড়া দেশের সব স্থানে তদারকি করার মত জনবলও নেই। তিনি বলেন, বেসরকারি কোম্পানিকে এলপিজি বিক্রর লাইসেন্স দেয় বিপিসি। কিন্তু তাদের দাম কি হবে তা কোম্পানিই নির্ধারণ করে। এজন্য কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। এ কারণে বিপিসির পক্ষে দাম নিয়ন্ত্রণ বা তদারকি করা সম্ভব নয়। তবে বেসরকারিভাবে অনেক কোম্পানি যদি এলপিজি বিক্রি করে তাহলে তাদের মধ্যেই প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। ফলে কেউই নির্দিষ্ট দামের চেয়ে বেশি দামে গ্যাস বিক্রি করতে পারবে না। তিনি জানান, চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের সমন্বয় হলে স্বাভাবিকভাবেই দাম নিয়ন্ত্রণ হবে। বাজার কাঠামোর ভেতরে থেকেই দাম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
বৈষম্য থেকেই যাচ্ছে
নতুন করে পাইপলাইন করে গ্যাস দেয়া বন্ধ আছে। ফলে দেশের যে এলাকায় পাইপে গ্যাস আছে তারা সুবিধা পাচ্ছে বেশি। এতে জ্বালানি ব্যবহারে একটি বৈষম্য তৈরী হয়েছে। বৈষম্য কমাতে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও তার কোনটাই বাস্তবায়ন হয়নি। বরং সুবিধাভোগীরা আরও সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে।
এলপিজি করছে ভুই ফোঁড় কোম্পানি
দেশে বর্তমানে প্রায় একশ কোম্পানিকে এলপিজি বোতল প্রক্রিয়া করার লাইসেন্স দেয়া আছে। একবার লাইসেন্স দেয়ার পরে আর সেসব কোম্পানির যোগ্যতা ভালভাবে যাচাই করা হয় না। ফলে নিম্নমানের বোতল বাজারে সরবরাহ হচ্ছে। এতে দুর্ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। বর্তমানে বিপিসি অনুমোদিত ৪৪টি কোম্পানি বাজারে এলপিজি সরবরাহ করে। এর বাইরে লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় সময় বাড়ানেরার আবেদন করেছে ১৪টি কোম্পানি। এরমধ্যে পাঁচটিকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রক্রিয়াধীন আছে আটটি। মেয়াদ শেষ হয়নি কিন্তু এখনও বোতলিং প্ল্যান্টও স্থাপন করেনি এমন আছে ১৫টি কোম্পানি।
সরকারি উদ্যোগের বাস্তবায়ন নেই
এলপিজি বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার নানা উদ্যোগ নেয়ার চেষ্টা করেছে। বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণ এবং বৈষম্য কমাতে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কোন কাজই করা হয়নি। যেসব কোম্পানি বা ডিলাররা বেশি দামে এলপি বিক্রি করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু তা কখনই করা হয়নি। সারাদেশে একই দামে বোতল গ্যাস বিক্রির উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি।
মধ্যস্বত্ত্বভোগির কথা
সরকারীভাবে উৎপাদন করা এলপি গ্যাস সিলিন্ডার বিপণনের জন্য সারাদেশে প্রায় দুই হাজার ৫০০ ডিলার আছে। এসব ডিলারের বেশিরভাগই বেসরকারি এলপি গ্যাসও বিক্রি করে। একই ব্যক্তি সরকারি ও বেসরকারি উভয় ডিলার বা বিক্রেতা হওয়াতে দুই ধরণের এলপি গ্যাস একই দামে বিক্রি করছে। সরকারি দাম ৭০০ টাকা অপর দিকে বেসরকারি দাম এক হাজার ৫০০ টাকা থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা। কিন্তু সরকারি বেসরকারি দুই সিলিন্ডারই বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৫০০ টাকা থেকে এক হাজার ৬০০ টাকায়।
২০০৯ সালের ৩০ মার্চ পর্য্ন্ত সরকারি পর্যায়ে সাড়ে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ছিল এক হাজার টাকা। পরে তার ২০০৯ সালের ৩১ মার্চ ১৫০ টাকা এবং ২৮ জুলাই আরো ১৫০ টাকা কমিয়ে ৭০০ টাকা করা হয়। কিন্তু এই সুবিধা এখনো পর্যন্ত সাধারণ গ্রাহকরা পায় নি। তাদেরকে বাড়তি দামেই বোতল গ্যাস কিনতে হচ্ছে।
চাহিদা ও সরবরাহ
দেশে বর্তমানে বছরে প্রায় তিন লাখ বোতল গ্যাস প্রয়োজন হয়। কিন্তু সরবরাহ করা হচ্ছে গড়ে প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ হাজার মেট্রিক টন। এরমধ্যে সরকারিভাবে ২০ থেকে ২২ হাজার মেট্রিক টন। ইস্টার্ন রিফাইনারী লি. থেকে অপরিশোধিত তেল প্রক্রিয়া করে পাওয়া যায় ১৫ হাজার মেট্রিক টন। সিলেট গ্যাস ফিল্ড থেকে প্রাকৃতিক গ্যাসের উপজাত (ন্যাচারাল গ্যাস লিক্যুউড- এলএনজি) কে প্রক্রিয়া করে পাওয়া যায় পাঁচ থেকে সাত হাজার মেট্রিক টন। সরকারিভাবে আমদানি করা তেল কিংবা দেশের গ্যাস ক্ষেত্র থেকে পাওয়া কনডেনসেট থেকে এলপিজি তৈরি করা হয়। অন্যদিকে বেসরকারি কোম্পানিগুলো বিদেশ থেকে গ্যাস আমদানি করে তা বোতলে ভরে বিক্রি করে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা এই গ্যাস বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)র নিয়ন্ত্রনাধীন কোম্পানি এলপিজি লি. বোতলজাত করে তেল বিপণন কোম্পানিগুলোর ডিলারের মাধ্যমে সারাদেশে বাজারজাত করে। বেসরকারিভাবে প্রতিবছর ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেট্রিক টন এলপি গ্যাস বাজারজাত করা হয়। এই গ্যাসের পুরোটাই আমদানি করা। নিজস্ব কেন্দ্রে বিভিন্ন মাপের বোতলে বোতলজাত করে এই গ্যাস বেসরকারিভাবে বাজারজাত করা হয়।