এসডিজি: উত্তরণের শীর্ষ তিনে বাংলাদেশ
বিডি নিউজ:
পরিবর্তনশীল বিশ্বে সমতা ও বৈষম্যহীন উন্নয়ন নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো ছয় বছর আগে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) স্থির করার পর যে তিনটি দেশ তাদের আগের অবস্থান থেকে সবচেয়ে বেশি উন্নতি করতে পেরেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি।
জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক সোমবার ২০২১ সালের যে অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতেই উঠে এসেছে এ চিত্র।
এবারের এসডিজি সূচকে বিশ্বের ১৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম। চার বছর আগে ২০১৭ সালের সূচকে ১৫৭টি দেশের মধ্যে ১২০তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ।
২০১৫ সালে জাতিসংঘে গৃহীত এসডিজিতে ২০৩০ সালের মধ্যে পূরণের জন্য মোট ১৭টি লক্ষ্য স্থির করা হয়। সেসব ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর অগ্রগতি বিচার করেই এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। তবে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় জাতিসংঘের ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১৫৭টির তথ্য এবারের প্রতিবেদনে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সালের পর থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোই এসব লক্ষ্য পূরণের পথে সবচেয়ে বেশি এগিয়েছে। আর ২০১৫ সালের পর থেকে এসডিজি সূচকে স্কোরের দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি এগিয়েছে বাংলাদেশ, কোত দি ভোয়া (আইভরি কোস্ট) এবং আফগানিস্তান।
এসডিজি সূচকে বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর এবার একশর মধ্যে ৬৩.৫। গতবছর এই স্কোর ছিল ৬৩.২৬, তার আগের বছর ছিল ৬৩.০২। যে বছর এসডিজি গৃহীত হয়, সে বছর বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৫৯.০১। আর ভিত্তিবছর ২০০০ সালে স্কোর ছিল ৫৩.৪৯।
বাকি দুটি দেশের মধ্যে কোত দি ভোয়া ৫৭.৫৬ স্কোর নিয়ে এবারের সূচকে ১৩১তম অবস্থানে রয়েছে। ২০১৫ সালে দেশটির স্কোর ছিল ৫৩.৩৫।
আর ৫৩.৯৩ স্কোর নিয়ে আফগানিস্তান এবার আছে সূচকের ১৩৭তম অবস্থানে। এসডিজির শুরুর বছরে দেশটির স্কোর ৪৯.৬৩ ছিল।
এবারের তালিকায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে থাকা ফিনল্যান্ডের স্কোর ৮৫.৯ এবং সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের স্কোর ৩৮.২৭।
সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট বলছে, বিগত বছরগুলোতে স্কোরের দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি অবনমন ঘটেছে জেনেজুয়েলা, টুভালু ও ব্রাজিলের।
জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক বলছে, এসডিজির লক্ষ্য পূরণে দেশগুলোর রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং তাদের লক্ষ্য পূরণের জন্য রাষ্ট্রীয় নীতি গ্রহনের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতা রয়েছে। চলতি বছর ৪৮টি দেশে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, ২৮ দেশই তাদের বার্ষিক বাজেটে এসডিজির প্রসঙ্গ রাখেনি।
জাতিসংঘে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য গৃহীত হওয়ার পর থেকে সামগ্রিকভাবে বিশ্ব পরিস্থিতি ক্রমোন্নয়নের ধারায় থাকলেও মহামারীর মধ্যে ২০২০ সালে প্রথমবারের মত তাতে ছেদ পড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারী কেবল স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেনি, টেকসই উন্নয়নেও সঙ্কট তৈরি করেছে।
সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্কের প্রেসিডেন্ট জেফ্রি ডি সাকস বলেন, ‘এসডিজির লক্ষ্যগুলোতে উন্নতির ধারায় ফেরার জন্য উন্নয়নশীন দেশগুলোকে আর্থিক খাতে বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়াতে হবে। সেজন্য কর কাঠামোর সংস্কারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ব্যাংকগুলো থেকে অর্থায়ন বৃদ্ধির প্রয়োজন হবে।’
এসডিজির যে ছয়টি মূল লক্ষ্য, সেগুলোতে জোর দিয়েই উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের আর্থিক পরিকল্পনা সাজাতে হবে।
মহামারীর মধ্যে বৈশ্বিকভাবেই এসডিজি বাস্তবায়নের গতি ধীর হয়ে আসার কথা জানানো হয়েছে এবারের প্রতিবেদনে।
সেখানে বলা হয়েছে, মহামারীর কারণে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে বেকারত্ব। এমনকি সূচকের শীর্ষে থাকা ফিনল্যান্ড এবং সবচেয়ে এগিয়ে থাকা নর্ডিক দেশগুলোও মহামারীর কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির বেশ কিছু লক্ষ্য পূরণে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ১২ নম্বরে পরিমিত ভোগ ও টেকসই উৎপাদনধরন নিশ্চিত করা আর ১৩ নম্বরে জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব মোকাবেলায় জরুরি কর্মব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্য বাংলাদেশ ইতোমধ্যে পূরণ করে ফেলেছে। সূচকের এ দুটি অবস্থানে তাই বাংলাদেশের রঙ সবুজ।
এসডিজির ১ নম্বরে সব ধরনের দারিদ্র্যের অবসান এবং ৪ নম্বরে সকলের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষালাভের সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ লক্ষ্য পূরণের পথেই রয়েছে।
এর মধ্যে এসডিজি-৪ এ বাংলাদেশকে সূচকের হলুদ তালিকায় রাখা হয়েছে। এর অর্থ হল, এসব ক্ষেত্রে লক্ষ্য অর্জনে আরও অনেক কাজ করতে হবে।
আর এসডিজি-১ এ দারিদ্র্য হ্রাস, এসডিজি-২ এ ক্ষুধামুক্তি, এসডিজি-৫ এ জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন, এসডিজি-৭ এ সাশ্রয়ী, টেকসই জ্বালানি সহজলভ্য করা, এসডিজি-৮ এ শোভন কর্মসুযোগ সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং এসডিজি-১০ এ অন্তঃ ও আন্তঃদেশীয় অসমতা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে রাখা হয়েছে কমলা তালিকায়। অর্থাৎ এই ছয় লক্ষ্য অর্জনের পথে বাংলাদেশের সামনে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
এছাড়া এসডিজি-৩ স্বাস্থ্য ও কল্যাণ, এসডিজি-৬ এ পানি ও স্যানিটেশন, এসডিজি-৯ এ অবকাঠামো ও টেকসই শিল্পায়ন, এসডিজি-১১ তে নিরাপদ ও টেকসই নগর গড়ে তোলা, এসডিজি-১৪ তে সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার, এসডিজি-১৫ তে বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র সুরক্ষা, ভূমির অবক্ষয় রোধ, এসডিজি-১৬ তে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ, ন্যায়বিচার, প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা এবং এসডিজি-১৭ তে বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব উজ্জীবিতকরণে বাংলাদেশকে লাল তালিকায় রাখা হয়েছে।
অর্থাৎ এই আটটি ক্ষেত্রে লক্ষ্য পূরণ করতে গেলে বাংলাদেশকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
এই ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে কেবল এসডিজি-১৫ তে বাংলাদেশের অবস্থার অবনতির তথ্য দেয়া হয়েছে এবারের সূচকে।
বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে এবারের সূচকে ভুটানের অবস্থা সবচেয়ে ভালো। ৬৯.৯৮ স্কোর নিয়ে হিমালয়ের এ দেশটির অবস্থান সূচকের ৭৫ নম্বরে।
এছাড়া ৬৯.২৭ স্কোর নিয়ে মালদ্বীপ ৭৯তম, ৬৮.১০ স্কোর নিয়ে শ্রীলঙ্কা ৮৭তম, ৬৬.৫২ স্কোর নিয়ে নেপাল ৯৬তম, ৬৪.৯৫ স্কোর নিয়ে মায়ানমার ১০১তম অবস্থানে আছে।
সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে তিন দেশ। ৬০.০৭ স্কোর নিয়ে ভারত সূচকের ১২০তম, ৫৭.৭২ স্কোর নিয়ে পাকিস্তান ১২৯তম এবং ৫৩.৯৩ স্কোর নিয়ে আফগানিস্তান ১৩৭তম অবস্থানে রয়েছে।