কবে কাটবে গ্যাস সংকট?
নিজস্ব প্রতিবেদক:
সোনিয়া আক্তার দুই সন্তান আর পরিবারের অন্যদের নিয়ে থাকেন খিলগাঁও। সংসারের আর পাঁচটা কাজ ঠিকমত করতে পারেন না গ্যাস সংকটের কারণে। নিত্য দিনের এই দুর্ভোগে সন্তানদের ঠিক মত খাওয়াতে পারেন না। স্বাভাবিক জীবনে তার এখন একটিই আতঙ্কÑ গ্যাস না থাকা। বিদ্যুতের মত অবস্থা হয়ে গেছে গ্যাসের। কখন থাকে কখন থাকে না তা কেউ বলতে পারে না। যখন প্রয়োজন তখন থাকে না। আর যখন থাকে তখন ক্লান্ত।
এই অভিযোগ শুধু রাশেদা আক্তারের নয়, ঐ এলাকার নাসরিন, আমেনা, মাহবুবা কিম্বা জেসমিন, সবার।
সোনিয়া আক্তার এনার্জি বাংলাকে বলেন, দিনে গ্যাস থাকেই না। সন্ধ্যার পর আসে। কোন কোন দিন ভোরে থাকে। রাত গভীর হলে পুরো চাপে গ্যাস পাওয়া যায়। তখন আর রান্নার প্রয়োজন হয় না। একই সাথে বিদ্যুতের লোডশেডিংও বেড়েছে। বাচ্চাদের ঠিকমত স্কুৃলে টিফিন দেয়া যায় না।
গ্যাস সংকট পিছু ছাড়ছে না। ঠিক মত গ্যাস না পাওয়ায় ভোগান্তিতে নগরবাসী। রান্নার চুলা জ্বলে না।
দ্রুত গ্যাস সমস্যা সমাধানের দাবি জানিয়েছেন এসব ভূক্তভোগীরা।
প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী বীর বিক্রম এনার্জি বাংলাকে বলেন, গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে গ্যাসের উৎপাদনও অনেক বেড়েছে। গত কয়েকবছরে চাহিদা অনেক বেড়েছে। তাই এই সংকট। গ্যাস সরবরাহ বেড়েছে বলেই চাহিদা বেড়েছে।
এমনিতেই গ্যাসের জন্য চারদিকে হাহাকার। বাসাবাড়িতে পাইপলাইনে গ্যাস মিলছে না। রান্নাবান্নায় গৃহিণীদের কষ্টের শেষ নেই। শিল্প মালিকরাও বলতে বাধ্য হচ্ছেন, কারখানায় নির্ধারিত চাপে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। গ্যাসের বদলে ‘বাতাস’ দেওয়া হচ্ছে। এতে উৎপাদন সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। এ রকম নাজুক অবস্থার মধ্যেই এলপিজি বা রান্নার সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বাড়ানো হল।
প্রতিবছর দেখা যায়, শীতকালে রাজধানী ঢাকার বাসাবাড়িতে গ্যাসের চুলা জ্বলে না। জ্বললেও মিটমিট করে। তাতে রান্নার কাজ শেষ করতে কয়েক গুণ সময় লাগে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় এ যন্ত্রণা সীমাহীন। এ সংকট বহু বছর ধরেই চলছে; কিন্তু কোনো সমাধান নেই। এ নিয়ে মিছিল, সভা-সমাবেশ হয়েছে। এমনকি হরতাল পর্যন্ত। কিন্তু সমস্যা সেই তিমিরেই।
দেশে গ্যাস-সংকট কাটছে না বরং বাড়ছে। চাহিদার এক তৃতীয়াংশের বেশি গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। শিগিগরই দূর হচ্ছে না চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতি। বিদ্যমান সংকটে শিল্প উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকে নেমে এসেছে। তিন পালার অনেক কারখানায় এখন চলছে এক পালা।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্দ্ধগতির মধ্যে এ গ্যাস-সংকট অর্থনীতি এবং জনজীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ঘাটতি মেটাতে স্থানীয় গ্যাসের জোগান বাড়ানো যাচ্ছে না। আবার নগদ অর্থের সংকটে বিদেশ থেকে গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বাড়ানো যাচ্ছে না বরং কমছে। গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে এবং গার্মেন্টস-টেক্সটাইলসহ অধিকাংশ শিল্প কারখানায় উৎপাদন কমায় জাতীয় উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী এনার্জি বাংলাকে বলেন, শিল্প কারখানায় গ্যাস-সংকট অসহনীয় হয়ে উঠেছে। দিনে ছয় থেকে ১২ ঘণ্টা বন্ধ রাখতে হচ্ছে মিল। গ্যাসের চাপ কম থাকায় অন্য সময়েও উৎপাদন চালিয়ে যাওয়া চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে।
দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু সরবরাহ হচ্ছে ২৮০ থেকে ২৭৫ কোটি ঘনফুট। গ্যাসের অভাবে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না।
গ্যাস বিতরণ কোম্পানি বলছে, পেট্রোবাংলার কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছে না তারা। তাই শিল্প, বিদ্যুৎ, আবাসিক বা বাণিজ্য কোনো শ্রেণির গ্রাহকদেরকেই চাহিদার সমান গ্যাস দেওয়া যাচ্ছে না। আর পেট্রোবাংলা বলছে, স্থানীয় বা বিদেশি কোনো উৎস থেকেই এখন পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহের উপায় নেই। স্থানীয়ভাবে অনুসন্ধান কূপ এবং উন্নয়ন কূপ খননের কাজ জোরদার করা হয়েছে। কিন্তু তার ফল এখনই আসবে না। বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম ও মার্কিন ডলারের দর বেড়ে যাওয়ায় এই তরলীকৃত গ্যাস আমদানিও আপাতত বাড়ানো যাচ্ছে না।
দেশে গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহে ঘাটতি প্রায় দেড় দশকের। চলতি বছর এই ঘাটতি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির পর ঘাটতি কিছুটা কমতে শুরু করলেও চলতি সেপ্টেম্বরে তা ফের বেড়েছে। গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ না থাকায় ঢাকা মহানগর, সাভার, গাজীপুর, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার বেশির ভাগ শিল্পকারখানা দিনের অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকছে।
বরাবরের মতোই কর্তৃপক্ষ বলছে এই সমস্যা সাময়িক। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান এনার্জি বাংলাকে বলেন, এটা সাময়িক সমস্যা। গ্যাস সংকট মেটাতে দেশীয় গ্যাসের নির্ভরতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ৪৬টা কূপ খননের পরিকল্পনা করেছি। ২০২৫ সালের মধ্যে সেখান থেকে ৬১ কোটি ঘনফুটের বেশি গ্যাস পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।
দেশে চলমান গ্যাস সংকটে বিঘ্ন ঘটছে শিল্প উৎপাদনে। সিএনজি স্টেশনগুলোতে গ্যাস দেয়া হচ্ছে সময় মেনে। দেশীয় গ্যাস দিয়ে আপাতত এই সংকট মেটাতে আগ্রহী পেট্রোবাংলা। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম না কমলে আর খোলা বাজার থেকে গ্যাস আমদানি করা হবে না। তাই যে সংকট চলছে তা সাথে নিয়েই চলতে হবে।
কবে কাটবে গ্যাস সংকট তার যথাযথ উত্তর কারও কাছে নেই।