কোন দামে তেল রুবল না ডলার?

তামান্না আক্তার:
দাম কম হওয়ায় সর্বোচ্চ উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম সৌদি আরবও রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি করছে। প্রতিবেশি দেশ ভারত রাশিয়া থেকে যে পরিমাণ জ্বালানি আমদানি করত তার থেকে বেশি আনছে। চীনে গ্যাস রপ্তানি বাড়াবে বলে জানিয়েছে রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাজপ্রম। সবমিলে এশিয়ায় জ্বালানি রপ্তানি বাড়িয়েছে রাশিয়া। ভবিষ্যতেও বাড়বে বলে পূর্বাভাস দেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশও রাশিয়া থেকে তেল নিতে চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবিষয়ে পর্যালোচনার নির্দেশ দিয়েছেন।
রাশিয়া থেকে বাংলাদেশে জ্বালানি তেল আনার উদ্যোগকে অনেকে স্বাগত জানিয়েছেন। কম দামে পেলে তা অর্থনীতিতে ভাল ভূমিকা রাখবে। একে একটি সুযোগ হিসেবে দেখতে চাইছেন অনেকে।
এখন এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আনতে প্রধানত দুটো প্রতিবন্ধকতা। এক, বিনিময় হার আর দুই, কারিগরি বিষয়।
কারিগরিভাবে অপরিশোধিত তেল রাশিয়া থেকে এখনই নেয়া সম্ভব নয়। এখন যে তেল আমদানি করা হয় সৌদিআরবসহ অন্যান্য দেশ থেকে তার তুলনায় রাশিয়ার তেল ভারি বা ঘনত্ব বেশি। বাংলাদেশে যে শোধনাগার আছে সেখানে রাশিয়ার তেল শোধন করা সম্ভব না। ইস্টার্স রিফাইনারি থেকে একথা জানিয়ে দেয়া হয়েছে। রাশিয়া থেকে তেল এনে এটা পরীক্ষা করা হয়েছে।
অবশ্য পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সম্প্রতি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, রাশিয়ান বিশেষজ্ঞ দল খুব তাড়াতাড়িই শোধনাগারের সম্ভাবনা যাচাই করতে বাংলাদেশ সফর করবেন। পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন, রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল আমদানিতে বাংলাদেশের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্তু শোধন করার ক্ষমতার অভাব আছে। যদি রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল শোধন করার সক্ষমতা গড়ে তুলতে পারি তাহলে অপরিশোধিত তেল কিনতে পারবো। তবে এতে বেশ সময় লাগবে। বিশেষজ্ঞ দল কিছু দিনের মধ্যে দেশে এসে শোধনাগার পরিদর্শন করবেন বলে তিনি জানান।
তবে পরিশোধিত যে তেল অর্থাৎ সরাসরি ডিজেল কোরোসিন কিম্বা অকটেন আমদানি করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে এর বিনিময় হার কী হবে, তা নিয়েও আলোচনার প্রয়োজন।
বিকল্প মুদ্রায় রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি তেল কিনতে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবকে সময়োপযোগী বলছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের সাথে টাকার বিনিময় বা ‘সোয়াপ’ করে জ্বালানি তেল কেনার সুযোগ আছে। এই সুযোগকে কাজে লাগানোর আহŸান জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাশিয়া যদি বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্য বাড়ায় তাহলে বিনিময় করা সহজ হবে।
রাশিয়ার সাথে অন্যান্য লেনদেন এতদিন ডলারেই হয়েছে। কিন্তু নতুন করে নিষেধাজ্ঞার কারণে ডলার বিনিময় করা জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রর অর্থ লেনদেন বন্ধ ছিল। রূপপুর নিয়ে সমস্যা নেই কারণ সেখানে ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া। আবার বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রাংশ আনাও হচ্ছে রাশিয়া থেকে।
এখন জ্বালানি তেল আমদানিতে রাশিয়ার নিজস্ব মূদ্রা রুবলে বিনিময় করা যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের কাছে নিশ্চয় সেই পরিমান রুবল নেই। সেটাই স্বাভাবিক। রাশিয়া-চীনের মত বিনিময় করা যাবে কিনা তা আলোচনা সাপেক্ষ।
বিশ্বে জ্বালানি তেলের অন্যতম উৎস দেশ রাশিয়া। ইউক্রেনের সাথে দেশটির চলমান যুদ্ধ, আর পশ্চিমা দেশগুলোর অবরোধ বিশ্বজুড়ে জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় ভিন্ন মাত্রার সংকট দেখা দিয়েছে।
বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও খাদ্য পণ্যের দাম বেড়েছে। এতে দেশীয় বাজারে ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সমাধান হিসেবে, রাশিয়া থেকে তেল আমদানির জন্য রুবলের সাথে টাকার বিনিময় মুদ্রা হিসেবে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
উদ্যোক্তরা বলছেন, বাংলাদেশের সাথে রাশিয়া আরও কিছু বাণিজ্য বাড়াতে পারে। যদি রাশিয়া বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্টসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি বাড়ায় তাহলে বাণিজ্য ঘাটতি কমবে। এতে বিনিময় সহজ হবে।
এখন রাশিয়ার সাথে সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করে, বিনিময় হার, বাণিজ্য বাড়ানো, তেল আমদানির পরিমান, কম দামের তেল কত বছর আনতে পারবো, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে তখন কত দাম হবে ইত্যাদি বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা বা চুক্তির মাধ্যমে এই তেল আমদানি করা যেতে পারে।
রাশিয়া যে বাংলাদেশে তেল রপ্তানির প্রস্তাব দিয়েছে তাতে ইউরোপ আমেরিকার বাইরে রাশিয়ার সাথে নতুন বাণিজ্য সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
তবে সিদ্ধান্তটা চট করে নেওয়ার নয়। আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণের সাথে দীর্ঘমেয়াদের বিষয়টিও ভাবতে হবে।
এখন অস্বাভাবিক দাম চলছে। এই দামের সাথে ভবিষ্যৎ তুলনা করা ঠিক হবে না। তাই দীর্ঘমেয়াদের কথা চিন্তা করতে হবে। এমনভাবে রাশিয়ার সাথে চুক্তি করতে হবে যেন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে তখন সেই সুবিধাও পাওয়া যেতে পারে।
ডলারে বিনিময় করা না গেলে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে হবে। সে জন্য রাশিয়াকে এগিয়ে আসতে হবে।
রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের একক প্রকল্প হিসেবে সবচেয়ে বড়। এর খরচ ধরা হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থের ৯০ শতাংশ অর্থ ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া। ভোলায় গ্যাস কূপ খনন করছে রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাজপ্রম। এসব বড় বড় বাণিজ্যে বাংলাদেশকে শুধু শোধ করতে হবে। তেল আমদানি করলে সেটাও এর সাথে যোগ হবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ রাশিয়ায় পোশাক রপ্তানি করে। পোশাক ছাড়াও পাট ও পাটজাত পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে। যুদ্ধের মধ্যেও রপ্তানি হচ্ছে। কিন্তু তা অনেক কমেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে রাশিয়ায় ৪৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে রাশিয়ায় ৫৯ কোটি ৩০ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।