চুড়ান্ত হচ্ছে বাংলাদেশ ভারত সমুদ্রসীমা
চুড়ান্ত হচ্ছে ভারত বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহের অথবা এ মাসের শেষে দুই দেশের সীমানা নির্ধারণে আন্তর্জাতিক সালিশ আদালত রায় দেবে। তারপর নতুন করে তৈরী করা হবে বাংলাদেশের মানচিত্র। মানচিত্র তৈরীর পরপরই বাংলাদেশ ভাগের সমুদ্রের পূর্বাঞ্চলে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবান করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মেরিটাইম বিষয়াবলী ইউনিটের প্রধান রিয়াল এ্যাডমিরাল মো. খুরশেদ আলম (অব.)বলেন, লিখিতভাবে রায়ের তারিখ এখনো জানানো হয়নি। তবে অল্প কিছু দিনের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্রসীমা নির্ধারণের রায় পাওয়া যাবে। মিয়ানমারের মত এবারও বাংলাদেশের জয় হবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, রায়ের আগে মন্তব্য করা ঠিক নয়। তবে আশা করি আমরা যে যুক্তি উপস্থাপন করেছি তা আদালত আমলে নেবে।
নেদারল্যান্ডের পার্মানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশন বাংলাদেশ ও ভারতের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে বা ২রা জুলাই) রায় দিতে পারেন বলে অন্য একটি সূত্র জানায়। এই রায়ের মাধ্যমে ৪২ বছর পর বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হবে।
পররা¯দ্ব্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা আমাদের দাবি উপস্থাপন করেছি। ভারতও তাদের দাবি উপস্থাপন করেছে। আমাদের দাবি ছিল ন্যায্য। ফলে আমরা মিয়ানমার সীমান্তর মতই ভারতের সাথেও জয়ী হব।
ভারতের সাথে সমুদ্র সীমা মিমাংসিত হলে নতুন করে দেশের মানচিত্র তৈরী করা হবে। মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারন করা হয়েছে। এখন ভারতের সাথে হলে বাংলাদেশে পুরো সীমানা নির্ধারণ হবে।
বাংলাদেশের যুক্তি অনুযায়ী ভুমির মূল বিন্দু থেকে সমুদ্রের দিকে ১৮০ ডিগ্রি সরল রেখা যাবে। তবে ভারতের যুক্তি সমুদ্রতট বিবেচনায় এ রেখা হবে ১৬২ ডিগ্রি। বাংলাদেশ সীমান্ত জেলা সাতক্ষীরা থেকে সরাসরি সরল রেখায় নিচের দিকে মহীসোপান পর্যন্ত নিজেদের বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের দাবি করা অংশ ৩২ হাজার বর্গ কিলোমিটার নিজেদের বলে দাবি করেছে ভারত।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত সমস্যা সমাধান করতে বেশ কয়েকবার দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হয়। তাতে মিমাংসা হয়নি। ভারতের সঙ্গে ১৯৮০ সালের পরে ধীর্ঘ দিন আলোচনা হয়নি। পরে ২০০৯ সালে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। সে আলোচনায় মীমাংসা হয়নি। আলোচনায় মিমাংসা না হওয়ায় আদালতে গড়ায় মামলা। দুই দেশের পক্ষ থেকে তাদের দাবির পক্ষে নিজস্ব যুক্তি উপস্থাপন করা হয়। এরপ্রেক্ষিতে আদালত রায় দিতে যাচ্ছে।
১৯৭৪ সালে আন্তর্জাতিক সীমানা বিশেষজ্ঞ ডি পি ও কনেলকে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তার সুপারিশ অনুযায়ি একটি সীমানা রেখা ঠিক করা হয়েছিল সে সময়। কিন্তু তা মানতে রাজি হয়নি ভারত কিংবা মিয়ানমার। পরে আদালতে মিমাংসা হয়েছে মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা। এখন ভারতের সাথেও আদালতের মাধ্যমেই মিমাংসা হতে যাচ্ছে।
গত বছরের ১৪ই মার্চ মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা মামলায় জয়লাভ করে বাংলাদেশ।
গত বছর অক্টোবর মাসে অারবিট্রেশন কোর্টের প্রতিনিধিরা সমুদ্রের অমিমাংসিত এলাকা সরোজমিন পরিদর্শন করেছেন। ২০১৩ সালের ৮ই ডিসেম্বের নেদাল্যান্ডের রাজধানি হেগ এর সমঝোতা আদালতে দুই দেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে শুনানী শুরু হয়।
জাতিসংঘ সমুদ্র আইন এর ধারা ৭৬ অনুযায়ি বাংলাদেশ সমুদ্র তটরেখা থেকে ৩৫০ নটিক্যাল মাইল বা ৬৪৮ দশমিক দুই কিলোমিটার পর্যন্ত অধিকার দাবি করেছে বাংলাদেশ। ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এমনিতেই পাবে বাংলাদেশ। বাকী ১৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গেলে জাতিসংঘে দাবি করতে হয়। আইন অনুযায়ি মহিসোপানের মহিঢাল থেকে যেখানে পলি (সিডিমেন্ট) এক শতাংশ পর্যন্ত আছে অথবা দুই হাজার ৫০০ মিটার পানির গভীরতা রেখা থেকে আরো ১০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত যাওয়া যাবে।
সমুদ্রসীমা মিমাংসা হওয়ার পর ভারতের সাথে স্থলভাগের সীমানা নির্ধারনে উদ্যোগ নেয়া হবে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূ্ত্র জানায়। এরআগে স্থলভাগের অমিমাংসীত সীমানা ঠিক করতে জরিপ করা হয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয় এই জরিপ করেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, ছিটমহলসহ অমিমাংসিত স্থলভাগের সীমান্ত সমস্যা সমাধানে কৌশল নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ও ভারত। কিভাবে এই সমস্যার সমাধান হবে তা ঠিক করেছে দুই দেশ। গত কয়েক বছর উভয় দেশ সীমান্তবর্তী ভ’খন্ডের তথ্য সংগ্রহ করেছে। সমুদ্রের পর ছিট মহল, অদখলি জমি ও নির্দিষ্ট না থাকা সীমানা সমস্যা সমাধান করা হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্থলভাগে তিনটি স্থানের সীমানা এখনো নির্ধারন করা হয়নি। এগুলো হলো, দিকহাটা-৫৬, লাঠিটিলা-দুমাবাড়ি এবং মুহুরী নদী।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল আছে। বাংলাদেশের মধ্যে ভারতের ছিট মহল আছে ১১১টি, যার আয়তন প্রায় ১৭ হাজার একর। অন্যদিকে ভারতের মধ্যে বাংলাদেশের ছিট মহল আছে ৫১টি যার আয়তন প্রায় ১০ হাজার একর।
বাংলাদেশের কিছু জমি আছে যা ভারতের দখলে। আবার ভারতের কিছু জমি আছে যা বাংলাদেশের দখলে। আন্তর্জাতিক আইনে, এসব জমির বিরোধ নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে মিমাংসা না হওয়া পর্যন্ত যারা ভোগ করে তাদেরই দখলে থাকে। আন্তর্জাতিক আইনে সীমান্তের এমন জমি অন্তত ১২ বছর কেউ ভোগ করলে তাদেরই হয়ে যায়। দু’দেশের সরকার পর্যায়ের সমঝোতার মাধ্যমে এ জমির মালিকানা ঠিক হতে পারে। তবে দু’দেশ সমঝোতায় না আসলে কেউ এ জমি জোর করে দখল করতে পারেনা। আন্তর্জাতিক আইনের আর্টিকেল-৩ ও মুজিব-ইন্দিরা সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী, মিমাংসা না হওয়া পর্যন্ত এধরণের ভূখন্ড- যার দখলে থাকবে সেই ভোগ করবে। অন্য কেউ জোর করে দখলে নিতে পারবে না। বর্তমানে সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে এই সমস্যা আছে। এছাড়া তিনবিঘা করিডোর ২৪ ঘন্টা খোলা রাখার বিষয়ে উভয় দেশ সম্মত হয়েছে। বর্তমানে ১২ ঘন্টা এই করিডোর খোলা থাকে। আগে থাকতো তিন ঘন্টা। ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাংলাদেশ-ভারত ল্যান্ড বাউন্ডারি এগ্রিমেন্ট (এলবিএ) অনুযায়ী কিছু কিছু সমস্যার সমাধান করা হবে বলে সূত্র জানায়।
সমুদ্রের খনিজ অনুসন্ধানের জন্য বাংলাদেশ যে ব্লক তৈরী করেছে তারমধ্যে ৩১হাজার ৭৪৩ বর্গ কিলোমিটার নিজেদের বলে দাবি করেছে ভারত। এরমধ্যে পাঁচ নম্বর ব্লক(ছয় হাজার ৭৬৬ বর্গকিলোমিটার), নয় নম্বর ব্লক ( তিন হাজার ৩৭৪ বকিমি), ১৪ ( তিন হাজার ৩৭২ বকিমি ), ১৫ (তিন হাজার ৮৬৫), ১৯ (তিন হাজার ৩৬৯ বকিমি), ২০ ( তিন হাজার ৮৮৮ বকিমি ), ২৪ (তিন হাজার ৩০২) ও ২৫ ( তিন হাজার ৮০৮ বকিমি) নম্বর ব্লককে নিজেদের অংশ আছে বলে দাবি করেছে ভারত। এরমধ্যে ১৯, ২০ , ২৪ ও ২৫ নম্বর ব্লককের প্রায় সম্পূর্ণ নিজেদের বলে দাবি করেছে ভারত।
এদিকে পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ হওয়ার পরপরই সমুদ্রে খনিজ অনুসন্ধানের জন্য নতুন করে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবান করা হবে।