জ্বালানির দাম: কমানোর দাবির মুখে বাড়ানোর প্রস্তাব

রফিকুল বাসার:
যখন জ্বালানি তেলের দাম কমানোর দাবি মানুষের মুখে মুখে তখন গ্যাস ও পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিল সরবরাহকারি কোম্পানিগুলো। শুধু উদ্যোগই নয় বাস্তবতার সাথে কোন মিল না রেখেই দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় তথ্য ছাড়া দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল। পরে সংশোধন করে, প্রয়োজনীয় ত্য উপাত্তসহ আবার আবেদন করেছে।
কোম্পানিগুলো বলছে, বেশিদামে কিনে কম দামে বিক্রির জন্য পেট্রোবাংলার লোকসান হচ্ছে। সরবরাহ কোম্পানিগুলো লাভ করলেও পেট্রোবাংলাকে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। সবমিলিয়ে খরচের চেয়ে অর্ধেক দামে গ্যাস বিক্রি করা হচ্ছে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান এনার্জি বাংলাকে বলেন, বিইআরসি নির্ধারণ করা অনুযায়ি দেশে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের গড় দাম ৯ টাকা ৩৭ পয়সা। আর প্রতি ঘনমিটারে পেট্রোবাংলার খরচ দেশীয় আর আমদানি করা মিলিয়ে প্রায় ২০ টাকা ৫০ পয়সা। প্রতি ইউনিটে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ১১ টাকা ১৩ পয়সা। পেট্রোবাংলা বর্তমানে অর্ধেকেরও কম মূল্যে গ্যাস বিক্রি করছে। দেশীয় ও আমদানি করা গ্যাসের বছরে মোট বিক্রয়মূল্য প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর পেট্রোবাংলার খরচ (কোম্পানিগুলোর নির্ধারিত মার্জিনসহ) ৬৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। ফলে বছওে ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি প্রয়োজন হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরেকটি এফএসআরইউ স্থাপিত হলে আমদানি করা এলএনজির পরিমান বাড়বে। তখন খরচ আরও বাড়বে।
এলএনজি আমদানিতে খরচ বেড়ে যাওয়া, আইওসি থেকে বেশি দামে গ্যাস নিয়ে কম দামে বিক্রি, দেশীয় কোম্পানির পরিচালন খরচ বেড়ে যাওয়া, আমদানি ও ভোক্তা উভয় মূল্য সংযোজন কর দেয়াসহ বিভিন্ন পর্যায়ে খরচ বেড়ে যাওয়ায় ভর্তুকি বাড়ছে বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলা।
আন্তর্জাতিক বাজারে এখন অল্প অল্প করে গ্যাসের দাম বাড়ছে। করোনার টিকা দেয়া শুরু হওয়া থেকে, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে থাকার সময় থেকে জ্বালানি চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু সরবরাহ সেভাবে বাড়েনি। তাই দাম বাড়তি।

দেশে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের গড় মূল্য ৯ টাকা ৩৭ পয়সা। খরচ দেশীয় আর আমদানি করা মিলিয়ে প্রায় ২০ টাকা ৫০ পয়সা। প্রতি ইউনিটে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ১১ টাকা ১৩ পয়সা। দেশীয় ও আমদানি করা গ্যাসের বছরে মোট বিক্রয়মূল্য প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর পেট্রোবাংলার খরচ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বেশি

তবে যে কোন অবস্থায় গ্যাসের দাম না বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে উদ্যোক্তারা। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে রপ্তনি কমে যেতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
বিটিএমএ এর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন এনার্জি বাংলাকে বলেন, সরকারের কাছে বলব এই মুহুর্তে যেন কোনভাবেই গ্যাসের দাম বাড়ানো না হয়। এতে অর্থনীতিতে নতুন করে চাপ তৈরি হবে। অন্য কোন উপায়ে সমন্বয় করে হলেও গ্যাসের দাম বাড়ানো বন্ধ করতে হবে। এতে মূল্যস্ফিতি হবে। বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, কার্যাদেশ নেওয়ার পর উৎপাদন খরচ বাড়লে লোকসান হয়। তাই এখনই কোনভাবেই গ্যাসের দাম বাড়ানো ঠিক হবে না। এতে শুধু পোশাকশিল্প নয় দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি বাধাগ্রস্থ হবে।
গ্যাসের দাম না বাড়িয়ে বিকল্প উপায় খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তামিম। তিনি এনার্জি বাংলাকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে এটা সত্য। সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা সচল রাখতে, মূল্যস্ফিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গ্যাসের দাম না বাড়িয়ে বিকল্প কোন উপায় আছে কিনা তা দেখতে হবে। তবে ভর্তুকি দেয়ারও একটা সীমাবদ্ধতা আছে।
দেশে যে গ্যাস ব্যবহার হয় তার ৭৮ শতাংশ দেশের গ্যাস, নিজস্বভাবে উৎপাদন হয়। যার দাম কম, প্রতি ইউনিট ২ টাকা ৩০ পয়সা। ১৪ শতাংশ কাতার আর ওমান থেকে নির্ধারিত দামে আমদানি করা হয়। যার দাম পড়ে ইউনিট প্রতি ৩৬ টাকা। আর পাঁচ শতাংশ গ্যাস উচ্চমূল্যে আন্তর্জাতিক বাজারে যখন যে দাম থাকে সেই দামে খোলা বাজার থেকে কেনা হয়। তবে তা সব সময় নয়। যখন প্রয়োজন বেশি হয় তখন এভাবে গ্যাস বা এলএনজি আনা হয়।
বিইআরসিতে বাড়ানোর প্রস্তাব
গ্যাসের দাম বাড়াতে ইচ্ছে মত মনগড়া প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্পসহ সব গ্রাহকের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে সরবরাহকারি কোম্পানিগুলো। আবাসিকে এক চুলা এখন আছে ৯২৫ টাকা। এটা বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা এবং দুই চুলা ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ১০০ টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এছাড়া আবাসিকে প্রিপেইড মিটারে প্রতি ঘনমিটার ১২টাকা ৬০ পয়সা থেকে থেকে বাড়িয়ে ২৭ টাকা ৩৭ পয়সা করার প্রস্তাব দিয়েছে। সিএনজিতে প্রতি ঘনমিটার ৩৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৬ টাকা ৪ টাকা, হোটেল রেস্টুরেন্টে ২৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৯ টাকা ৯৭ পয়সা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ১৭ টাকা ৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩৭ টাকা ২০ পয়সা, ক্যাপটিভ বিদ্যুতে ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা ৯ পয়সা, চা শিল্পে ১০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২৩ টাকা ২৪ পয়সা, বিদ্যুৎ ও সার কারখানায় ৪ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ৬৬ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিইআরসির চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিল জানিয়েছেন, নিয়ম, অনুযায়ি প্রস্তাব এলে কারিগরি কমিটি গঠন করে তা মূল্যায়ন করা হবে। তারপর গণশুনানি হবে। তারপর নতুন দাম নির্ধারণ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
সম্প্রতি তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন এন্ড ট্রান্সমিশন কোম্পানির প্রধান কার্যালয় পরিদর্শনে এলে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এর কাছে সাংবাদিকরা গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এবিষয়ে মন্তব্য করার এখনও সময় আসেনি।