জ্বালানি তেলের দাম কমানোর কোন উদ্যোগ শুরু হয়নি

জ্বালানি তেল বিক্রিতে দ্বিগুনেরও বেশি লাভ হচ্ছে। তবু এখনও দাম কমানোর কোন আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়নি।  বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমার পর পৃথিবীর প্রায় সকল দেশ কমালেও শুধু বাংলাদেশে এখনও কমেনি। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী দাম কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন। এদিকে গতকাল বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ব্যারেল প্রতি ৩০ দশমিক ৪৩ ডলারে নেমেছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এ এম বদরুদ্দোজা এনার্জি বাংলাকে বলেন, তেলের দাম কমানোর বিষয়ে সরকারের পক্ষক্ষ থেকে এখনও কোন নির্দেশনা পাইনি। নির্দেশনা পেলে সে অনুযায়ি উদ্যোগ নেয়া হবে। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমার ফলে বিপিসির লাভ হচ্ছে। দাম আরও কমলে লাভও স্বাভাবিকভাবেই আরও বেশি হবে।
এদিকে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর জোরালো দাবি উঠেছে ব্যবসায়ী, বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে। দীর্ঘদিন এই দাবি থাকলেও সরকার দাম কমানোর কোন উদ্যোগ নেয়নি।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। দুই বছর আগে তা ছিল ১২২ ডলার। গত প্রায় দেড় বছর বিপিসি জ্বালানি তেল বিক্রি করে লাভ করছে। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। সে সময় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ছিল ব্যারেল প্রতি ৯৭ ডলার। আর এখন ৩০ ডলার। ২০০৪ সালের পর জ্বালানি তেলের দাম এত নিচে কখনও নামেনি। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হওয়ার কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতি অব্যহত থাকলে তেলের দাম আরও কমতে পারে। এই অবস্থায় নতুন করে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর আলোচনা শুরু হয়েছে।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এনার্জি বাংলাকে বলেন, তেলের দাম নিয়ে কথা বলার মত পরিস্থিতি এখনও তৈরী হয়নি।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) এখন পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমার ফলে গত অর্থবছর বিপিসি প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এ বছর তেলের দাম অপরিবর্তিত থাকলে ১১ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করবে। তবে এ মুনাফার অর্থ দিয়ে ঋণ পরিশোধ করা হচ্ছে না। বিপিসি সরকারের কোষাগারে জমা দিচ্ছে। ফলে বিপিসির পুঞ্জিভূত লোকসান কমছে না, লোকসান থেকেই যাচ্ছে।
এরআগে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল ২০১৩ সালের ৪ জানুয়ারি। ওই সময় পরিবহন ব্যয় থেকে শুরু করে উৎপাদন খাতসহ সবখাতেই খরচ বেড়ে যায়। কিন্তু এরপর বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও দেশের ভেতরে আর কমানো হয়নি।
গত আগস্টের হিসেব অনুযায়ি, প্রতি লিটার অকটেন উৎপাদনে বিপিসির যেখানে খরচ ৬৩ টাকা ৫১ পয়সা, তা বিক্রি করছে ৯৯ টাকায়। অর্থাৎ এক লিটার অকটেন বিক্রি করে বিপিসির মুনাফা ৩৫ টাকা ৪৯ পয়সা। একইভাবে ৫৪ টাকা ২৩ পয়সার কেরোসিন ৬৮ টাকায় বিক্রি করে মুনাফা করছে ১৩ টাকা ৭৭ পয়সা, ৫৪ টাকা ২৫ পয়সার জেট অয়েল ৭৩ টাকায় বিক্রি করে ১৮ টাকা ৭৫ পয়সা, ৫৩ টাকা ৩২ পয়সার ডিজেল ৬৮ টাকায় বিক্রি করে ১৪ টাকা ৬৮ পয়সা এবং ৪০ টাকা ৪৩ পয়সার ফার্নেস অয়েল ৬০ টাকায় বিক্রি করে ১৯ টাকা মুনাফা হচ্ছে বিপিসির।
ভারত গত আগস্ট থেকে পেট্রোলের দাম সাতবার আর ডিজেলের দাম তিনবার কমিয়েছে। নভেম্বরের শুরুতেই পেট্রোলের দাম কমেছে দুই দশমিক ৪১ রূপি আর ডিজেলের দাম কমেছে দুই দশমিক ২৩ রূপি। আগস্ট থেকে ভারতের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে গড়ে নয় দশমিক ৩৬ রূপি।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম তামিম এনার্জি বাংলাকে বলেন, ফার্ণেস অয়েলের দাম সবার আগে কমাতে হবে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমবে। কমানো যাবে বিদ্যুতের দামও। তিনি বলেন, অকটেন ও পেট্রোলের দাম কমলে সিএনজির ওপর চাপ কমবে। কিন্তু ডিজেলের দাম কমানোর ক্ষেত্রে সরকারকে আগে পরিকল্পনা করতে হবে এ দাম কমানোর সুবিধা জনগণ কিভাবে পাবে। কারণ ডিজেলে দাম কমানো হলে বাস ভাড়া, ট্রাক ভাড়া, সেচ খরচ সবই কমার কথা। যদি সরকার বলে যে, তারা পরিবহণ ভাড়া নিয়্ন্ত্রণ করতে পারবে না তাহলে তো কোনো কিছুই সরকারের হাতে থাকবে না। ফলে ডিজেলের দাম কমানোর আগে সরকারের উচিত বাস-ট্রাক এমনকি সেচে তেল সরবরাহকারীদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। তাদেরকে বাধ্য করা উচিত যে, তারা যাতে তেলের দাম কমলে ভাড়াও কমায় এবং ওই ভাড়া যাতে কার্যকর হয় সেই ব্যবস্থাও করে। পাশাপাশি সরকারকেও মনিটরিং করতে হবে যে ডিজেলের দাম কমানোর সুবিধা জনগণ পাচ্ছে কিনা।
জ্বালানি তেলের দাম কমানোর বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি বলেছেন, জ্বালানি তেলের মূল্যনীতি চূড়ান্ত করে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হবে। জ্বালানি তেলে যে লোকসান দেয়া হয়েছে, তা সমন্বয় করেছে বিপিসি। এখন দাম কমানোর বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সুপারিশ করেছে। তারা বলছে, দেশে জ্বালানি তেলের দাম গড়ে ১০ শতাংশ কমানো হলে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি দশমিক ৩ শতাংশ বাড়বে।
সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমায় সরকার নি:শ্বাস নিতে পারছে। এখন উৎপাদক ও ভোক্তাকেও নি:শ্বাস ফেলতে দিতে হবে। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শুধু জ্বালানি তেল নয়, গ্যাস-বিদ্যুতের দামও সমন্বয় করতে হবে। তবে এটা কীভাবে ভারসাম্য আনা হবে, সেটা ঠিক করতে হবে। তিনি মনে করেন, এখনই ভালো সময় এ তিন বিষয়ের সমন্বয় করার। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল-ও সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সুপারিশ করেন।