ঠিকানা থেকেও তারা নিখোঁজ
বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়েছিলেন। বিদ্যুৎ ব্যবহারও করেছেন। কিন্তু বিদ্যুতের বিল শোধ করেননি। এই গ্রাহকদেরই বকেয়া বিদ্যুৎ বিল আদায় করতে গিয়ে দেখা দিয়েছে বিপত্তি। গ্রাহকরা উধাও। তাদের কোন খোঁজ নেই। বিদ্যুৎ অফিসগুলোতে তাদের বর্তমান অবস্থান নিখোঁজ হিসেবে।
এমনই নিখোঁজ ৩৬৬ জনের একটি তালিকা পাওয়া গেছে। এদের অনেকের বকেয়া লাখে গিয়ে ঠেকেছে। নিখোঁজ এসব গ্রাহকদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এদিকে বিদ্যুৎ সংযোগ নেয়ার সময় সংশ্লিষ্ঠ অফিসে স্থায়ী সম্পত্তির মালিকানার দলিলপত্র জমা দিতে হয়। এরপরও গ্রাহক নিখোঁজ থাকছেন।
অভিযোগ ওঠেছে সংশ্লিষ্ঠ বিদ্যুৎ অফিসের এক শ্রেনীর কর্মকর্তা-কর্মচারী যোগসাজসে পরিকল্পিত ভাবেই এ বিপুল সংখ্যক গ্রাহককে নিখোঁজ দেখানো হয়েছে। গত বছরের শেষ দিকে সংসদীয় কমিটিতে জমা দেওয়া পূর্ত অডিট অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে এসব কর্মকর্তাদের সনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এর একজন উর্দ্ধতন কর্মকর্তা বলেন, বকেয়া আদায়ে সব সময় অভিযান চলছে। বকেয়া থাকার কারণে সংযোগ বিচ্ছিন্ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও করা হচ্ছে। মামলার করণে অনেকের জেল জরিমানা হয়েছে। সব ধরণের নজির আছে। এরমধ্যে দুএকজন গ্রাহক তার অবস্থান পরিবর্তন করার সময় আর আমাদের কাছে কোন তথ্য দেন না। লাখ লাখ গ্রাহকের মধ্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলের দুএকজন পিডিবিকে তথ্য না দিয়ে স্থান পরিবর্তন করলে তাকে খুঁজে পেতে সমস্যা হয়। তাছাড়া মৌসুমীসহ বিভিন্ন ধরণের গ্রাহক আছে বলে তিনি জানান।
সংশ্লিষ্ঠ দফতর জানিয়েছে, নিখোঁজ এসব গ্রাহকদের কাছ থেকে বকেয়া আদায় করতে নানান পদপে গ্রহণ করা হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গ্রেফতারী পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে। এদিকে পূর্ত অডিট অধিদপ্তরের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে নিখোঁজ ব্যক্তিদের কাছ থেকে দ্রুত বকেয়া বিদ্যুৎ বিল আদায়ের তাগিদ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ সংযোগ নেয়ার পর গ্রাহকদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি যৌক্তিক নয় বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। ওই নিরীক্ষা প্রতিবেদনে নিখোঁজ দেখানোর বিষয়টি পরিকল্পিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, গ্রাহকদের যারা কাগজে কলমে নিখোঁজ দেখিয়েছেন তাদের সনাক্ত করা এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
সংশ্লিষ্ঠ সূত্র জানায়, বিদ্যুতের মূল্যহার ও নিয়মাবলী ১৯৮৯ এর বিধি ২২ এর ১ অনুযায়ী স্থায়ী সম্পত্তির মালিকানা প্রমাণপত্রের ভিত্তিতে বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া হয়। ২০.৬.২ অনুযায়ী বিল জারীর দিন থেকে ৩০ দিনের মধ্যে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করবেন এবং এ সময়কে ‘ত্বরিত পরিশোধ সময়’ বলে উল্লেখ করা হবে। ২৪.২.১ অনুযায়ী ত্বরিত পরিশোধের সময়ের মধ্যে গ্রাহক বিল পরিশোধে ব্যর্থ হলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। নিখোঁজদের তালিকা যাছাই করে দেখা যায় বকেয়া বিল আদায়ের ক্ষেত্রে এসব বিধি অনুসরণ করা হয় নি। কিছু গ্রাহক মাসের পর মাস বিল বকেয়া রেখেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো এক পর্যায়ে গ্রাহককে নিখোঁজ দেখানো হচ্ছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এর পাঁচটি নির্বাহী প্রকৌশলী কার্যালয়ে ৩১৫ জন গ্রাহক বর্তমানে নিখোঁজ রয়েছেন। এদের মোট বকেয়া বিল ৯৪ লাখ ৭৫ হাজার ৫৮৩ টাকা। এরমধ্যে পিডিবি রাঙ্গামাটি নির্বাহী প্রকৌশলী কার্যালয়ের ১৭৭ জনের কাছে বকেয়া ৩৪ লাখ ১১ হাজার, ময়মনসিংহ বিবিবি-২ (দক্ষিণ) পিডিবি নির্বাহী প্রকৌশলী কার্যালয়ের ৫৪ জনের কাছে ৩৫ লাখ ৮৯ হাজার, পিডিবি সিলেট নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ে ২৫ জনের কাছে ১১ লাখ ২৪ হাজার, বগুড়া পিডিবি নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ে ৩৯ জনের কাছে ৭ লাখ ৪১ হাজার এবং মৌলভীবাজার কুলাউড়া নির্বাহী প্রকৌশলী কার্যালয়ের অধিনে ২০ জনের কাছে ৬ লাখ ৮ হাজার টাকা বকেয়া রয়েছে।
এছাড়া ওয়েষ্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিমিটেডের চারটি কার্যালয়ে ৫১ জন গ্রাহক বর্তমানে নিখোঁজ রয়েছেন। এদের মোট বকেয়া ৩৬ লাখ ২৯ হাজার ৭২৬ টাকা। এর মধ্যে পটুয়াখালী ব্যবস্থাক নির্বাহী প্রকৌশলী বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের অধিনে চারজন গ্রাহকের কাছে বকেয়া ২৫ লাখ ৩৭ হাজার টাকা, বরিশাল ব্যবস্থাপক নির্বাহী প্রকৌশলী বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-১ এর ৩৩ জনে গ্রাহকের কাছে বকেয়া সাত লাখ ৬২ হাজার টাকা, ভোলা বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপক নির্বাহী প্রকৌশলীর অধিনে চার জন গ্রাহকের কাছে বকেয়া এক লাখ ২৫ হাজার টাকা। ব্যবস্থাপক নির্বাহী প্রকৌশলী বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-২ খুলনা অফিসের ১০ জন গ্রাহকের কাছে দুই লাখ চার হাজার টাকা পাওনা আছে।
নিখোঁজের তালিকা যাচাই করে দেখা যায় ১৯৮৩ সালে নিখোঁজ হওয়া গ্রাহকও রয়েছেন। দীর্ঘ বছর খুঁজেও এসব গ্রাহককে পাওয়া যায় নি। ৪৩৭/৪৪১৪ নম্বরের গ্রাহক রাঙ্গামাটির ত্রি-দীপ নগরের বাসিন্দা গায়না চাকমা। এক লাখ ১৪ হাজার টাকা বকেয়া বিল পরিশোধ না করায় ১৯৯৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। গত ১৭ বছরেও এ বকেয়া আদায় করা সম্ভব হয়নি। সংশ্লিষ্ঠ বিদ্যুৎ অফিস জানিয়েছে, গায়না চাকমা নিখোঁজ থাকায় বকেয়া আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। একই অফিসের অধিনে ৫০৬/২২৪০ নম্বরের গ্রাহক আর বাজারের বাসিন্দা আবুল হোসেন। তার বকেয়া এক লাখ আট হাজার টাকা। ১৯৯৩ সাল থেকে তিনি নিখোঁজ আছেন বলে টাকা আদায় করা যায়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ঠ বিদ্যুৎ অফিস।
১০৩৭/৪৬৪৭ নম্বরের গ্রাহক রাঙ্গামাটির কাঠালতলীর বাসিন্দা কামাল উদ্দিন। ১২ হাজার টাকা বকেয়া রাখার অভিযোগে ১৯৮৮ সালের ১৪ অক্টোবর তার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। গত ২৭ বছর তিনি নিখোঁজ থাকায় তার কাছ থেকে বকেয়া বিদ্যুৎ বিল আদায় করতে পারে নি সংশ্লিষ্ঠ বিদ্যুৎ অফিস। ৩২ বছর নিখোঁজ রয়েছেন ৪৩২০/২৩৯২ নম্বরের গ্রাহক রাঙ্গামাটির কালিন্দিপুরের মহাব্বত আলী। ১৯৮৩ সালের ২৮ আগষ্ট তার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। বরিশাল বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-১ ব্যবস্থপক (নির্বাহী প্রকৌশলী) কার্যালয়ের এ-১৩২৯৫৮ নরম্বর গ্রাহক কনক্ট্রাটর ক্লাব। এ গ্রাহকের বকেয়া ৫২ হাজার টাকা হওয়ার পর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ২০০৪ সালের পর থেকে এ ক্লাবটিও নিখোঁজের তালিকায় রয়েছে। ২০০০ সাল থেকে নিখোঁজ রয়েছে এ-১৩২৯৭৭ নম্বর গ্রাহক আ. রব মিয়া। তার বকেয়া ৩২ হাজার ৪৬৯ টাকা।