প্রতিযোগিতা ছাড়া কেনায় আরও ৫ বছর সুযোগ
রফিকুল বাসার:
‘যেহেতু দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতি চরমভাবে বিরাজ করিতেছে; এবং যেহেতু জ্বালানির সরবরাহের স্বল্পতাহেতু বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব হইতেছে না; এবং যেহেতু বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতিজনিত কারণে কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও গৃহস্থালী কাজকর্ম ব্যাপকভাবে ব্যাহত হইতেছে এবং উক্ত খাতসমূহে কাঙ্খিত বিনিয়োগ হইতেছে না; সেহেতু বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ আইন করা হইল।’ Ñ একথা ১১ বছর আগের। এই আইন পাশের যুক্তিতে আইনের মধ্যেই একথা বলা হয়েছিল।
দেশে যুদ্ধাবস্থা বিবেচনায় এই আইন করা হয়েছিল। এখন আর সে অবস্থা নেই। তখন দেশে বিদ্যুতের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। বিদ্যুৎ ঘাটতি, লোডশেডিং, প্রাথমিক জ্বালানি কোথা থেকে আসবে তার অনিশ্চয়তা, বিদ্যুতের অভাবে শিল্পকারখানা ঠিকমত চলেনা। তেলভিত্তিক জেনারেটর চালানোতে শিল্পে খরচ বেশি, বিদ্যুৎ জ্বালানির ঘাটতির কারণে বিনিয়োগ আসে নাÑ এসব ছিল দেশের উন্নয়নে বড় বাধা।
কিন্তু এসবের কোন কিছুই এখন আর নেই। নিন্ম আয়ের দেশ খেকে বেরিয়ে এসেছি। বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত। বড় বড় একাধিক প্রকল্প চলমান। শত কোটি টাকা দেশীয় কোম্পানিই বিরিয়োগ করছে। বিদেশি কোম্পানিও থেকে নেই হাজার কোটি টাকা নিয়ে। তারপরও প্রতিযোগিতা ছাড়া কেনাকাটা করার জন্য বিশেষ আইন পাশ করা হলো।
দরপত্রের দীর্ঘ মেয়াদী জটিলতা থেকে মুক্ত হতে যে বিশেষ আইন করা হয়েছিল তা থেকেই যাচ্ছে। বার বার এর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। আরও চারবছর অর্থাৎ ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রিসভা। সংসদে পাশ হলেই তা কার্যকর হবে।
কাজের গতি আনার জন্য দশ বছর আগে এই সিদ্ধান্ত নিলেও এই আইন থেকে বের হতে পারছে না বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
এই আইন এখনও টিকিয়ে রাখার মানে হচ্ছে, দরপ্রস্তাব মূল্যায়ন শেষে দ্রুত কাজ দেয়ার যোগ্যতা দীর্ঘ দিনেও অর্জন করা যায়নি। কিন্তু এই যোগ্যতা অর্জন খুবই জরুরি।
মূলত একক কোম্পানির সাথে আলোচনা করে প্রতিযোগিতা ছাড়া দ্রুত কাজ দেয়ার জন্যই এই আইন করা হয়েছি। যাতে করে বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্রুত হয়। জ্বালানি ঘাটতি দ্রুত হয়। এগুলো হয়েছে। কিন্তু তবুও কিছুক্ষেত্রে পিছিয়েও থাকতে হয়েছে। সঞ্চালন ও বিতরণে এখন অনেক পিছিয়ে।
প্রথম থেকেই সরকার বিদ্যুৎ জ্বালানিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। অগ্রাধিকার দেয়ার পরও এই বিশেষ আইন রাখা হয়েছে। বিদ্যুতের লোডশেডিং দূর হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এখনও টেকসই হয়নি। টেকসই হয়নি তার প্রমান হচ্ছে, এখনও ভাড়ায় আনা তেলভিত্তিক উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বের হতে পারেনি। উৎপাদনের বড় অংশই এখনও ছোট ছোট ঐসব কেন্দ্রই ভরসা। তাই বছর বছর এগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে।
শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু খরচের বিষয়গুরুত্ব দেয়া হয়নি। প্রয়োজনের প্রায় দ্বিগুণ অর্থ খরচ হয়েছে এই পর্যায়ে আসতে। এতে সরকারি মোট খরচের বড় অংশ যেমন ভর্তুকি দিতে হয়েছে তেমনই সাধারণ মানুষকে দিতে হয়েছে বাড়তি অর্থ। বারবার বিদ্যুতের দাম কমানোর যে পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছিল তা বাস্তবায়ন হয়নি। বরং দাম বেড়েছেই।
এই আইনের সুবিধা নেয়ার পাশাপাশি; তা যাতে আর প্রয়োজন না হয় সে দিকে নজর দেয়া হয়নি। তাই এখনও এই আইনের দারস্থ হয়েই থাকতে হচ্ছে।
এই আইনের সুবিধা নিয়ে উৎপাদনে এসেছে ভাড়ায় আনা এবং ছোট ছোট বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। এগুলো স্বল্প মেয়াদী। এলএনজিসহ জ্বালানিতে কিছু কাজ দেয়া হয়েছে।
‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) (সংশোধন) আইন, ২০২১’ এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
সরকার বলছে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই আইনের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। তবে প্রতিযোগিতা ছাড়া কেনার এই আইনের ফলে সবকিছু স্বচ্ছ ও জবাবদিহি হচ্ছে না বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্ঠদের।
সরকারি ক্রয় আইন, ২০০৬ অনুযায়ী সরকারি কোন কিছু কিনতে গেলে তা প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে কেনা বাধ্যতামূলক। কিন্তু এই আইনের মাধ্যমে সে বাধ্যবাধকতা রহিত করা হয়েছে। এই আইন ব্যবহার করে যে কারও কাছ থেকে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে দর ঠিক করে কিনতে পারবে। বাংলাদেশে শুধু বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতেই এই সুবিধা আছে। অন্য কোন খাতে এই সুবিধা নেই।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্রুত বেড়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল হয়েছে। তবে এসব কেন্দ্র থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে অনেক ভর্তুকি দিতে হয়েছে এবং হচ্ছে। সরকার ভর্তুকি দিয়েছে। আবার সাধারণ ক্রেতারাও বাড়তি দাম দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য এ ধরণের আইনের প্রয়োজন নেই। সরবরাহ বাড়ালেই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না।
প্রতিযোগিতা না থাকায় কেনাকাটায় খরচ বেড়েছে। এতে সাধারণ মানুষের জীবন-যাত্রায় প্রভাব ফেলেছে। বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়াতে হয়েছে।
সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ি ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তিন বছর এবং ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পাঁচবছর মেয়াদি হওয়ার কথা ছিল। এরমধ্যে বড় ও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আনার কথা। কিন্তু দশ বছরেও সাশ্রয়ী কেন্দ্র উৎপাদনে আনতে পারেনি।
জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও যা করা হয়েছে তা ব্যয়বহুল। সরবরাহের সাথে যথাযথ মূল্য নিশ্চিত করাও জ্বালানি নিরাপত্তার অংশ।
মন্ত্রিপরিষদ সচিবের বক্তব্য
মন্ত্রিসভায় এই আইনের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাবে অনুমোদন দেয়ার পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানান, ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের এবং ২০৪০ সালের মধ্যে উন্নত দেশ গড়ার ক্ষেত্রে যে পরিকল্পনা আছে, তাতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ যাতে নির্বিঘ্নে করা যায় এজন্য ২০২৬ সাল পর্যন্ত এর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, কিছুদিন আগেও উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, আজকে যে পরিসংখ্যান দেখলাম তাতে শিল্প-কারখানায় চাহিদা আরও বাড়ছে। পদ্মা সেতু আগামী বছর শেষ হলে ওই পাড়ে যে পরিমাণ বিনিয়োগ শুরু হবে, তাতে অনেক জ্বালানি প্রয়োজন হবে।
সচিব বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) (সংশোধন) আইন, ২০২১’ এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। জরুরি পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ঘাটতি মোকাবেলায় ২০১০ সালে বিশেষ আইনটি করার পর এর মধ্যেই কয়েকবার তার মেয়াদ বাড়ানো হয়। বর্তমান মেয়াদ ছিল ২০২১ পর্যন্ত।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আইনটি খুবই কার্যকর। আগের আইনটারই কেবল সময় বাড়ানো হয়েছে। এটা ছিল বিশেষ আইন। ২০১০ সালে বিভিন্ন বিশেষ নিয়ম প্রয়োজন ছিল। সাধারণ যে ক্রয় প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি এটার বাইরে কিছু বিশেষ প্রয়োজন। সেটার জন্য এই আইন করা হয়। এখন দেখা যাচ্ছে এটা কার্যকর।
বার বার মেয়াদ বাড়ছে
২০১০ সালে দুই বছরের জন্য এই আইন করা হয়েছি। পরে ২০১২ সালে দুই বছরের জন্য বাড়ানো হয়। এরপরে চার বছরের জন্য বাড়ানো হয়েছিল। পরে সংশোধন করে আবারও তিন বছর বাড়ানো হয়। এবার নতুন করে আরও পাঁচ বছরের জন্য এই আইন বাড়ানোতে মত দিল মন্ত্রিসভা। এখন সংসদে পাশ হলেই আবারও বলবদ থাকবে।
বিশেষ আইনে যত কাজ
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের আওতায় প্রতিযোগিতা ছাড়া সরাসরি ১৫টি কুইক রেন্টাল ও পাঁচটি রেন্টাল কোম্পানির ২২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে চুক্তি করে পিডিবি। এছাড়া এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ১৫টি আইপিপি (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প¬্যান্ট) স্থাপন করা হয়েছে।
জ্বালানিখাতে এই আইনের আওতায় রাশিয়ার রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রমের সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্রের ১০টি উন্নয়ন কূপ খননের চুক্তি করে পেট্রোবাংলা। গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) ৮টি চুক্তি করে। এরমধ্যে ২টি গ্যাস কম্প্রেসর এবং আশুগঞ্জ থেকে এলেঙ্গা, বাখরাবাদ থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ এবং ভেড়ামারা থেকে খুলনা পর্যন্ত তিনটি গ্যাস ট্রান্সমিশন লাইন স্থাপনের কাজ রয়েছে।
এই আইনের আওতায় কক্সবাজারের মহেশখালীতে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এর ভাসমান টার্মিনাল স্থাপনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এক্সট্রা অয়েল এন্ড এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে চুক্তি করেছে পেট্রোবাংলা।