প্রবৃদ্ধির লক্ষ অর্জন না হওয়ার আশংকা
স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ’উন্নয়ন অন্বেষণ’এর ষাম্মাসিক পর্যালোচনায়’ অর্থনৈতিক ও অ-অর্থনৈতিক উভয় ধরণের প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে, চলতি অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত নাও হতে পারে।
এর কারণ পর্যালোচনা করতে গিয়ে ’উন্নয়ন অন্বেষণ’ অর্থনৈতিক উপাদান হিসেবে বিনিয়োগের শ্লথ গতি, রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থতা, বহিঃখাতে আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি অর্জনে অসাফল্য ও অবকাঠামো অপর্যাপ্ততার আশংঙ্কা এবং অ-অর্থনৈতিক কারণ হিসেবে অর্থনীতিতে প্রাতিষ্ঠানিক দূর্বলতা ও অকার্যকারিতা এবং সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চিয়তাকে উল্লেখ করেছে।
প্রধান সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলোর বর্তমান অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের প্রবণতা মূল্যায়নের মাধ্যমে ’উন্নয়ন অন্বেষণ’ প্রক্ষেপণ করেছে যে, বর্তমান বাস্তবতা অব্যহত থাকলে ২০১৪-১৫ অর্থবছর শেষে মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির ৭.৩ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রায় অর্জিত না হয়ে ৬.২৬ শতাংশ হতে পারে।
ক্রমহ্রাসমান বেসরকারী বিনিয়োগের দিকে দৃষ্টি দিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি বলে যে, ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ কমছে যা লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি অর্জনকে বাঁধাগ্রস্থ করছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমান জিডিপি’র ২২.৫০ শতাংশ ছিল যা ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে হ্রাস পেয়ে যথাক্রমে ২১.৭৫ ও ২১.৩৯ শতাংশে দাঁড়ায়।
সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যকার বর্ধিত ব্যবধানের দিকে নির্দেশ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি দেখায় যে, ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে জাতীয় সঞ্চয়ের পরিমাণ যথাক্রমে জিডিপি’র ৩০.৫৩ ও ৩০.৫৪ শতাংশ ছিল। যেখানে একই অর্থবছরগুলোতে মোট বিনিয়োগের পরিমান যথাক্রমে ২৮.৩৯ ও ২৮.৬৯ শতাংশ দাঁড়ায় যা সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যে যথাক্রমে ২.১৪ ও ১.৮৫ শতাংশ পয়েন্ট পার্থক্য সৃষ্টি করে।
রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অসাফল্য নির্দেশ করে ’উন্নয়ন অন্বেষণ’ বলছে যে, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতা অর্থনীতিতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি এবং জাতীয় উৎপাদনের কাঙ্খিত হার অর্জনকে বাঁধাগ্রস্থ করবে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ১৪৯৭২০ কোটি টাকার মোট লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আয় ৩৮০০৫.৮১ কোটি টাকা হয়েছে যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ২৫.৩৮ শতাংশ। ২০১৩-১৪ ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের পরিমানের লক্ষ্যমাত্রার যথাক্রমে ৯৬ ও ৯৭ শতাংশ ছিল। অন্যদিকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে কর রাজস্বের পরিমান জিডিপি’র মাত্র ৯.৭ শতাংশ ছিল।
দেশে ’করদাতা শনাক্তকরন সংখ্যা’ (টিআইএন) অনুযায়ী করদাতার মাত্র ১৭ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.০৯ শতাংশ। ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসের তথ্যানুযায়ী, এই সংখ্যার মাত্র অর্ধেক করদাতা তাদের কর রির্টান জমা প্রদান করেছেন।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর বাস্তবায়ন আশঙ্কাজনক অভিচিত করেছে। বর্তমান অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ৮০৩১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে যার অক্টোবর ২০১৪ পর্যন্ত মাত্র ১৪ শতাংশ অর্থাৎ ১১২৫০.৮২ কোটি টাকা বাস্তবায়ন হয়েছে। ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির লক্ষ্যমাত্রা যথাক্রমে ৯৬ ও ৯৪ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে।
বাজেট ঘাটতি সৃষ্ট অনুন্নয়ন ব্যয় বৃদ্ধি ও উন্নয়ন ব্যয় হ্রাসের দিকে দৃষ্টি দিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি দেখায় যে, ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে অনুন্নয়ন বাজেট জিডিপি’র যথাক্রমে ১২.১ ও ১৩.২ শতাংশে দাঁড়ায়, যেখানে একই সময়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য বরাদ্দকৃত বাজেট ছিল যথাক্রমে মাত্র ৪.৭ ও ৫.১ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে অনুন্নয়ন ব্যয় ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি খাতে বরাদ্দকৃত বাজেটের পরিমান যথাক্রমে ১২.৭ ও ৬.৩ শতাংশ।
বহিঃখাতের আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি না হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে ’উন্নয়ন অন্বেষণ’ রপ্তানি গন্তব্যমুখীন দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের টানপোড়নের কথা উল্লেখ করে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি আরো দেখায় যে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরের সময়ে বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্য ২০১৩-১৪ অর্থবছরের একই সময়ের ১৬৪৯ মিলিয়ন ডলার থেকে কমে ১২৪৬ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১১২৮ মিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান অর্থছরের এই সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধির কারণ পর্যালোচনা করে ’উন্নয়ন অন্বেষণ’ দেখায় যে, গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি আয় ৭১ মিলিয়ন ডলার কম হয়েছে এবং আমদানি ব্যয় ১১৯৯ মিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পায়। সাম্প্রতিক সময়ে রপ্তানি তুলনামূলকভাবে কমে যাওয়ার আংশিক কারণ হিসেবে ’উন্নয়ন অন্বেষণ’ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস (জিএসপি) সুবিধার স্থগিতাদেশ বজায়থাকা কে উল্লেখ করে।
’উন্নয়ন অন্বেষণ’ দেখায় যে, রেমিটেন্স প্রবাহ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের উভয়ই ২০১২ সাল থেকে ক্রমহ্রাসমান। ২০১২ তে রেমিটেন্স প্রবাহ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সংখ্যা যথাক্রমে ১১৫৮১৬.৯৩ কোটি টাকা ৬০৭৭৯৮ ছিল, যা কমে গিয়ে ২০১৩ সালে যথাক্রমে ১০৮০৬৬.৯৩ কোটি টাকা ও ৪০৯২৫৩ এবং ২০১৪ সালের নভেম্বর সময় পর্যন্ত যথাক্রমে ১০৬০৬২.৩৩ কোটি টাকা ও ৩৮২২৯৮ ছিল।
অর্থনীতিতে প্রতিষ্ঠানিক দূর্বলতাকে নির্দেশ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি দেখায় যে, দেশের ব্যাংকিং খাতে বিচিত্র জটিলতা বিদ্যমান যার বৈশিষ্ট্য হিসেবে উচ্চ সুদ ব্যপ্তি, তারল্যের আধিক্য, বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণের হ্রাসমান প্রবৃদ্ধি, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অকার্যকারিতা, ফাঁকি ও সার্বিক পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার কার্যকারিতার অভাব উল্লেখযোগ্য। ব্যাংকিং খাতে নন-পারফারমিং লোনের পরিমান মার্চ ২০১৪ এর ৩.৪ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে জুন ২০১৪’তে ৩.৯ শতাংশে উপনিত হয়।
অর্থনীতিতে অ-অর্থনৈতিক উপাদান সমূহ যেমন বর্তমান অনিশ্চিয়তা ও অনুন্নত অবকাঠামোর বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ’উন্নয়ন অন্বেষণ’ বলে যে, রাজনৈতিক অনিশ্চিয়তা সৃষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ পরিবেশ শিল্পোৎপাদানকে তীব্রভাবে বাঁধাগ্রস্থ করছে।
’উন্নয়ন অন্বেষণ’ দেখায় যে, ২০১০-১১ অর্থবছরে কোয়ান্টাম ইনডেক্স অব প্রোডাকশনের প্রবৃদ্ধি ১৬.৯৫ শতাংশ ছিল যা ২০১১-১২ অর্থবছরে কমে গিয়ে ১০.৭৯ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে সামান্য বেড়ে ১১.৫৯ শতাংশে পোঁছালেও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে কোয়ান্টাম ইনডেক্স অব প্রোডাকশনের প্রবৃদ্ধি কমে গিয়ে ৮.৩ শতাংশ হয়েছে।
২০১৪-১৫ অর্থবছর বর্তমান সরকারের প্রথম অর্থবছর যে সরকারে ১৫৪ জন সংসদ সদস্য ২০১৪ এর সাধারণ নির্বাচনে বিনা প্রতিদন্দিতায় নির্বাচিত হয়েছেন এবং প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেনি। ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিদ্যমান আছে।
’উন্নয়ন অন্বেষণে’ উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাজনৈতিক সংলাপের ওপর গুরুত্বরোপের পাশাপাশি সাতটি কৌশল গ্রহণের সুপারিশ করেছে। কৌশল গুলো হলোঃ উন্নয়নমুখীন স্বকীয় ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি, কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধিমুখীন প্রবৃদ্ধি কৌশল, কর ভিত্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে অধিক রাজস্ব আয়, আর্থিক খাতে প্রতিষ্ঠানিক সংস্কার, বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে সুদের হারের ব্যাপ্তী কমানো এবং কার্যকরি সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা সৃষ্টি করা।