ফণীতে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন, হাজারো ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত

ফণীতে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন, হাজারো ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত

ইবি ডেস্ক
ঘূর্ণিঝড় ফণীর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে উপকূলীয় অঞ্চলে। উপকূলীয় অঞ্চলসহ দেশের অন্যান্য স্থানেও শনিবার কখনও টানা, কখনও থেমে থেমে ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে।

ফণীর তাণ্ডবে বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে পড়ায় অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে খুলনা, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালীর কলাপাড়া, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, পিরোজপুর ও বরগুনা।

খুলনার উপকূলীয় উপজেলাগুলোর ৪ হাজার ৬৪০টি ঘরবাড়ি এবং এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
‘ফণী’র প্রভাবে ফেনীর বিভিন্ন স্থানে বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার খবর পাওয়া গেছে।

ফেনী পল্লী বিদ্যুৎ অফিস সূত্র জানায়, বাতাসের তীব্র গতিবেগ থাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে শনিবার সকাল ৬টা থেকে বিদ্যুৎসংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। অবস্থার উন্নতি হলে সংযোগ স্বাভাবিক হবে।

সাতক্ষীরায় ৬০০ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত, ২ হাজার হেক্টর ফসলি জমি এবং শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার প্রায় ৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফাটল দেখা দিয়েছে আরও কয়েকটি বাঁধে। বরগুনায় গাছচাপায় দাদি ও নাতি নিহত এবং সাড়ে ৮ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নোয়াখালীর সুবর্ণচর ও হাতিয়া উপজেলায় সহস্রাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত এবং ঘরচাপা পড়ে এক শিশু নিহত ও আহত হয়েছেন অর্ধশত। বেড়িবাঁধ ভেঙে হাতিয়ায় জোয়ারের পানি প্রবেশ করে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ভোলায় দুই শতাধিক ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছে। সদর উপজেলার কোড়ালিয়া গ্রামে ঘরচাপা পড়ে মারা গেছেন এক গৃহবধূ। তৃতীয় দিনের মতো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে এ দ্বীপজেলা।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় গাছের ডাল পড়ে একজন মারা গেছেন। বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ এলাকায় অন্তত তিন হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে। কুয়াকাটায় অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। মানুষজন ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। চাঁদপুরে শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। ঝালকাঠির রাজাপুরে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। যশোরের কেশবপুরে ঝড়-বৃষ্টিতে বিদ্যুৎ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে ঘরচাপা পড়ে একজন নিহত এবং চরাঞ্চলে শতাধিক কাঁচাঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে গাছের নিচে চাপা পড়ে নানা-নাতনি মারা গেছেন। ভোলার লালমোহনে ও পিরোজপুরের কাউখালীতে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রামে উপকূলীয় উপজেলা আনোয়ারা, নগরীর পতেঙ্গাসহ কয়েকটি এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ে জনপদে। এছাড়া বগুড়া, রংপুর, ফেনী ও পাবনায় ঝড়-বৃষ্টিতে গাছপালা ভেঙে গেছে ও ফসলের ক্ষতি হয়েছে।

দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের মাটিয়াভাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য গাজী বেলাল হোসেন জানান, গতকাল সকালে গ্রামে ঢুকে দেখেন বেশিরভাগ মানুষের ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। শুধু কয়রা সদর বা দক্ষিণ বেদকাশীই নয়; ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে খুলনার উপকূলীয় উপজেলাগুলোর ৪ হাজার ৬৪০টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

খুলনায় বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে কয়রা ও দাকোপ উপজেলার ২টি স্থান থেকে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। যে কোনো সময় বাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

দুটি গ্রাম প্লাবিত এবং এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টিনের চাল ভেঙে দিঘলিয়ায় একজন আহত হয়েছেন। তবে কোথাও কারও প্রাণহানি ঘটেনি। ঘর মেরামত ও ক্ষতিগ্রস্তদের তাৎক্ষণিক সহযোগিতার জন্য দাকোপে ১০০ টন খাদ্যশস্য ও ১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

খুলনা আবহাওয়া অফিস জানায়, গতকাল সকাল ৯টায় ঘূর্ণিঝড় এই অঞ্চল অতিক্রম করে। এর প্রভাবে প্রায় ৬০ থেকে ৮০ কিলোমিটার বেগে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়। দুপুরের পর থেকে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের আশ্রয়কেন্দ্র থেকে লোকজন নিজ নিজ বাড়িতে ফিরতে শুরু করে।

এদিকে মহানগরীর খালিশপুর থানার আলমনগর বাজার এলাকায় বিদ্যুৎস্পর্শে সুজন নামে এক শিশু মারা গেছে। গতকাল সকালে আলমনগর রেললাইনের পাশে এ দুর্ঘটনা ঘটে। সুজন রেললাইন এলাকার ফেরিওয়ালা বেল্লাল হোসেনের ছেলে। সে খালিশপুর প্রভাতি স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছিল। ঝড়ের কারণে বিদ্যুতের তার দোকানের ওপর পড়লে ওই দুর্ঘটনা ঘটে।

সাতক্ষীরায় প্রায় ৬০০ কাঁচা ঘরবাড়ি আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ছাড়া জেলায় দুই হাজার হেক্টর ফসলি জমি এবং শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার প্রায় পাঁচ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের আংশিক ক্ষতি হয়েছে।

মোংলায় ফণীর প্রভাবে ভেঙে গেছে পশুর নদীর কানাইনগরের ছয় হাজার ফুট বেড়িবাঁধ। এতে কয়েকশ’ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া সরকারি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের টিনের চাল উড়ে গেছে। বিধ্বস্ত হয়েছে বাড়িঘর। ঝড়ো বাতাসে পশুর নদ ও সুন্দরবনের ভেতরে থাকা কয়েকটি ছোট নৌযানডুবির তথ্য পাওয়া গেছে।

‘ফণী’র ভয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন বাগেরহাট শহর, শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ, মোংলাসহ উপজেলাগুলোর লক্ষাধিক মানুষ। ঝড়ের প্রভাবে জেলার সব পরিবহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। শুক্রবার রাত ১১টা থেকে জেলার অধিকাংশ উপজেলায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ থাকে। মোরেলগঞ্জের পানগুছি নদীতে ফেরি ও ট্রলার চলাচলও বন্ধ থাকে। পারাপার হতে না পারে মোরেলগঞ্জ ফেরিঘাট সংলগ্ন বাসস্ট্যান্ডে মানুষের ভিড় জমে যায়।
বরগুনা জেলা প্রশাসনের কট্রোলরুমের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় আট হাজার ৫০০ ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমতলীতে দুই শতাধিক কাঁচাঘর ও দুই শতাধিক পানের বরজ ও সহস্রাধিক গাছপালা উপড়ে পড়েছে।

সুবর্ণচর ও হাতিয়া উপজেলায় শুক্রবার রাতে ও শনিবার সকালে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। এতে ঘরচাপা পড়ে সুবর্ণচরের ইসমাইল নামের ১৪ মাস বয়সী এক শিশুর প্রাণহানি ঘটেছে। সে উপজেলার চর আমানুল্লাহপুর গ্রামের আবদুর রহমানের ছেলে। এ ছাড়া সুবর্ণচরে ৩০০, সদর উপজেলায় চার শতাধিক ও হাতিয়ায় ১৫০সহ ৯ উপজেলায় সহস্রাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। অনেক গাছ ও বৈদ্যুতিক খুঁটি উপড়ে পড়ে ও তার ছিঁড়ে গেছে। ঝড়ের আঘাতে চাটখিল, সোনাইমুড়ী, সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাট, সদর, সুবর্ণচর ও হাতিয়া উপজেলায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রবল জোয়ারে হাতিয়ার ক্যারিংচর ও তমরুদ্দি ইউনিয়ন রক্ষা বেড়িবাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব ঘটনায় অর্ধশতাধিক লোক আহত হয়েছেন।

ভোলায় বিপুলসংখ্যক গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়ায় বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। আধাপাকা বোরো ধানসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তৃতীয় দিনের মতো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে এ দ্বীপ জেলা। এছাড়া লালমোহনে পানিতে ডুবে মারা গেছে এক শিশু।

পটুয়াখালীতে কলাপাড়ায় ঝড়ের সময় চলন্ত মোটরসাইকেলের ওপর গাছের ডাল পড়ে গুরুতর আহত হাবিব মুসল্লী বরিশালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। শুক্রবার মধ্যরাতে তিনি মারা যান। ফণীর তাণ্ডবে উপজেলায় সম্পূর্ণভাবে ৪৬টি ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ছাড়া আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে ৪৮৭টি ঘর। বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ এলাকায় অন্তত তিন হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে। দশমিনায় শুক্রবার সারারাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন অনেক মানুষ। বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে পড়ায় মির্জাগঞ্জের ৫ গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।