ফুরিয়ে আসছে গ্যাস

বাংলাদেশের দীর্ঘ মেয়াদী জ্বালানি চাহিদা মেটানোর জন্য খুব অল্কপ্প গ্যাস মজুদ আছে। যা মজুদ আছে তাও ফুরিয়ে আসছে। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্যাস মজুদ ২০ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। এরমধ্যে ব্যবহার হয়েগেছে ১২ দশমিক ৪১ টিসিএফ। অর্থাৎ মজুদ আছে আট দশমিক ২৩ টিসিএফ গ্যাস। এখন প্রতিবছর প্রায় এক টিসিএফ করে গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে। এই হিসাবে বাংলাদেশে আবিস্কৃত গ্যাসের মজুদ আছে আগামী আট বছরের। নতুন মজুদ আবিস্কার হলে এর সাথে যোগ হবে।
পেট্রোবাংলার করা শেষ জরিপে এই তথ্য দেয়া হয়েছে। বুধবার পেট্রোবাংলা তাদের জরিপ প্রতিবেদন মন্ত্রনালয়ে উপস্থাপন করে।
পেট্রোবাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ি, আবিস্কৃত, সম্ভাব্য ও সম্ভাবনা মিলিয়ে গ্যাসের মজুদ ৩১ দশমিক ২৪ টিসিএফ। এরমধ্যে আবিস্কৃত ও সম্ভাব্য মজুদ ২৭ দশমিক ০৭ টিসিএফ। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি মজুদ আছে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে। এই ক্ষেত্রে আবিস্কৃত গ্যাসের মজুদ প্রায় চার টিসিএফ। এরপরে আছে তিতাস গ্যাসক্ষেত্রে। তিতাসে মজুদ আছে আড়াই টিসিএফ গ্যাস।
দেশের ২৬টি গ্যাস ক্ষেত্রের মজুদ হিসাব পর্যালোচনা করে পেট্রোবাংলা এই তথ্য উপস্থাপন করেছে। একই সাথে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভবিষ্যৎ চাহিদা মেটাতে বেশি করে গ্যাস অনুসন্ধান করতে হবে।স্থল এবং সমুদ্রের বেশিরভাগ স্থানেই এখনও অনুসন্ধান করা হয়নি। গ্যাসের উত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অপচয় বন্ধ করতে শিল্পে ব্যবহার করা গ্যাসের দাম সহনীয় পর্যায়ে বাড়াতে হবে।
পেট্রোবাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের চাহিদা অনুযায়ি গ্যাস ঘাটতি আছে। এই ঘাটতি ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। এখন দৈনিক ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ঘাটতি আছে। ২০১৯ সালে এই ঘাটতি হবে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। ২০১৭ সাল পর্যন্ত বর্তমান অবস্থায় চলতে থাকবে। অর্থাৎ প্রতিদিন ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট করেই ঘাটতি থাকবে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত উৎপাদন বাড়তে থাকবে। সাথে চাহিদাও বাড়বে। কিন্তু এরপর চাহিদা বাড়বে কিন্তু উৎপাদন কমতে থাকবে। ফলে চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যে পার্থক্য বা ঘাটতি পর্যায়ক্রমে বাড়বে। বর্তমানে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে দৈনিক দুই হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদা আছে তিন হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ২০১৯ সালে সরবরাহ করা হবে সর্বোচ্চ তিন হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। আর সে সময় চাহিদা হবে চার হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি গ্যাস উৎপাদন হবে ২০১৭ সালে। ২০১৭ সালের জুন মাসে তিন হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এরপর উৎপাদন কমতে থাকবে।
গ্যাস মজুদ বিষয়ক পর্যবেক্ষণে পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, বিকল্প কোন কিছু না হলে বর্তমান মজুদে দেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। এতে চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতি দিন দিন বাড়তেই থাকবে। দেশে উৎপাদিত গ্যাসের চেয়ে আমদানি করা এলএনজি’র দাম অনেক বেশি। পরিকল্পনা অনুযায়ি প্রথম পর্যায়ে এলএনজি আমদানি শুরু হবে ২০১৭ সালে। প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হলে দ্বিতীয় পর্যায়ে আমদানির উদ্যোগ নেয়া হবে। বর্তমানে যথাযথভাবে গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে না। গ্যাসের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সচেতনতা আরও বাড়াতে হবে। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর বয়লার জ্বালানি সাশ্রয়ী হতে হবে। শিল্প প্রতিষ্ঠানে গ্যাসের দাম অনেক কম। এজন্য সেখানে প্রচুর গ্যাস অপচয় হয়। অপচয় রোধ করতে সহনীয় মাত্রায় গ্যাসে দাম বাড়ানো উচিত। স্থলভাগ ও সমুদ্রের একটি বড় অংশ এখনও অনুসন্ধান করা হয়নি। সকল এলাকায় জরুরী ভিত্তিতে গ্যাস অনুসন্ধান করতে হবে।
পেট্রোবাংলা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বর্তমান গ্যাস ক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদন বাড়ানো হবে। এতে চলতি বছর বাড়তি গ্যাস যোগ হবে ২৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট। ২০১৬ সালের মধ্যে হবে আরও ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। ২০১৭ সালে যোগ হবে ৪৮৯ মিলিয়ন ঘনফুট।
আগামী পাঁচ বছরের গ্যাসের চাহিদা পর্যবেক্ষণ করে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রম শুধু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দৈনিক দুই হাজার ৯৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন হবে। আর চলতি বছর লাগবে এক হাজার ৫১২ মিলিয়ন ঘনফুট। ২০১৬ সালে বিদ্যুতে গ্যাস লাগবে দৈনিক এক হাজার ৮৫২ মিলিয়ন ঘনফুট, ২০১৭ সালে এক হাজার ৯৫৪ মিলিয়ন এবং ২০১৮ সালে বিদ্যুতে গ্যাস লাগবে দুই হাজার ৯৩ মিলিয়ন ঘনফুট। একই সাথে সার উৎপাদনে ২০১৯ সালে দৈনিক গ্যাস লাগবে ৩১৭ মিলিয়ন ঘনফুট। সার উৎপাদনে গ্যাসের ব্যবহার বাড়বে না বলে জানানো হয়েছে। চলতি বছরও সার উৎপাদনে দৈনিক ৩১৭ মিলিয়ন ঘনফুট করে গ্যাসের প্রয়োজন হবে। শিল্প কারখানায় চলতি বছর গ্যাস লাগবে দৈনিক ৪৪৬ মিলিয়ন ঘনফুট। পর্যায়ক্রমে ২০১৯ সালে এর পরিমান বেড়ে হবে ৬০৫ মিলিয়ন ঘনফুট। আবাসিক গ্রাহকদের চলতি বছর দৈনিক প্রয়োজন হবে ৩১৬ মিলিয়ন এবং ২০১৯ সালে গিয়ে লাগবে ৩৯৬ মিলিয়ন ঘনফুট। বাণিজ্যিক গ্রাহকদের এবছর দৈনিক লাগবে ২৬ মিলিয়ন এবং ২০১৯ সালে গিয়ে ৩১ মিলিয়ন ঘনফুট। ক্যাপটিভ বিদ্যুতে চলতি বছর দৈনিক ৪৭২ মিলিয়ন এবং ২০১৯ সালে গিয়ে লাগবে ৪৮৭ মিলিয়ন ঘনফুট। সিএনজিতে বর্তমানে দৈনিক ১৪০ মিলিয়ন এবং ২০১৯ সালে গিয়ে দৈনিক লাগবে ১৬০ মিলিয়ন ঘনফুট। চা ও ইটভাটায় বর্তমানে দৈনিক সাত মিলিয়ন ঘনফুট এবং ২০১৯ সালে গিয়ে লাগবে নয় মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।
পেট্রোবাংলা’র উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা জানান, এখন থেকে স্থলভাগ ও সমুদ্রে ব্যাপক অনুসন্ধান করতে হবে। না হলে নিকট ভবিষ্যতে গ্যাস সংকট আরও বাড়বে। আমদানি করা এলএনজি দিয়ে এই সংকট পুরণ করতে গেলে গ্যাসের দাম অনেক বেড়ে যাবে।