বাংলাদেশের বালু কি শুধুই বালু?
প্রকৃতির খেয়ালে কিছু প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া যেমন বাতাস, পানির স্রোত, তাপ, চাপ ইত্যাদি কারণে ভ‚ত্বকের কিছু অংশ ক্ষয়ে যায় এবং স্থানচ্যুত হয় এবং অজনা উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। ভূত্বকের একক হচ্ছে শীলা। প্রত্যেক শীলায় থাকে খনিজ। প্রত্যেক খনিজের থাকে ¯^াধীন হওয়ার প্রচণ্ড সহজাত প্রবৃত্তি। সেই কারণে ভ‚ত্বকের প্রত্যেক একক প্রত্যেক এককের সাথে সংঘর্ষ করে এবং প্রতিনিয়ত করতেই থাকে। ফলে এদের আকার ছোট হতে হতে ব্যাস দুই মিলিমিটারের চেয়ে কম হলে বালিকণা বা স্যান্ড গ্রেইনে পরিনত হয়। সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে এরা অবক্ষেপ বা স্যান্ড ডিপোজিট হিসেবে জমা হয়। এই অবক্ষেপের বেশির ভাগই কোয়ার্টজ বা স্ফটিক কণা। সিলিকা সম্মৃদ্ধ বালি থেকে বর্তমানে তৈরি হচ্ছে উৎকৃষ্ট কাঁচ। কাঁচের সাথে জড়িয়ে আছে ধর্ম, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। মনুষ্য সভ্যতায় কাঁচের অবদান অনেক এবং যুগে যুগে তা বেড়েই চলেছে।
কাঁচ নির্মিত আয়নায় আমরা আমাদের অয়বয়ব দেখতে পছন্দ করি। আয়না বা কাঁচ কখন প্রথম তৈরি হয়েছিল বা ব্যবহার হয়েছিল তা ভাল ভাবে জানা যায় না।
মানব জীবনে কাঁচের ব্যবহার অতি বিস্তর। একসময় কাঁচ শুধু ব্যবহার হত জানালায়। কিন্তু এখন বাসার দেয়াল নির্মিত হচ্ছে কাঁচ দিয়ে। বর্তমান স্থাপত্যের ধারা এবং প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে ভবনে কাঁচের ব্যবহারে এসেছে অভ‚তপূর্ব পরিবর্তন। বর্তমানে নবায়নযোগ্য শক্তির উপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তাই ভবনে ব্যবহার হচ্ছে ফটোভোল্টিক কাঁচ।
কাঁচ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল কাঁচবালি প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে দুইটা ফ্লট কাঁচ কারখানা আছে। একটা চট্রোগ্রামে পিএইচপি গ্লাস ফ্যাক্টরি ও অন্যটা টাঙ্গাইলে- নাসির ফ্লট গ্লাস ফ্যাক্টরি। পিএইচপি গ্লাস ফ্যাক্টরিতে প্রায় ৯০% সিলিকা সমৃদ্ধ বালি বা স্যান্ড ব্যবহার হয়।
তিন কারণ কাঁচ বালির গুনাগুন নিয়ন্ত্রণ করে। যথা- ১) বালিকণার আকার এমন হতে হবে যাতে ২০ নং সিভ দিয়ে গমন করতে পারে অর্থাৎ এর ব্যাস ০.৮৪১ মিলিমিটারের কম হতে হবে। বাংলাদেশে সমুদ্রতীর ও উপকুলীয় এলাকায় এবং ব্রহ্মপূত্র-যমুনা ও গঙ্গা নদীর কিছু কিছু অংশে এরকম বালির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় ২) সিলিকার উপস্থিতি হতে হবে প্রাচুর্যপূর্ণ এবং ৩) আয়রন, ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট ইত্যাদি অনুপস্থিত থাকবে বা খুব কম পরিমাণে থাকবে।
অধিক প্রাচুর্য সম্পন্ন সিলিকা বালি বাংলাদেশে অপ্রতুল। কানাডায় প্রচুর পরিমাণে কাঁচবালি পাওয়া যায়। যা ওট্টয়া স্যান্ড নামে পরিচিত। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কতিপয় গবেষক গবেষণা করে দেখেছেন যে বাংলাদেশের কাঁচবালি ওট্টয়া স্যান্ডের চেয়ে ভাল। বাংলাদেশের শেরপুর জেলার বালিজুরীতে, হবিগঞ্জ জেলার তেলিপারা ও শাহজিবাজারে, কুমিল্লা জেলার চৈদ্দগ্রাম উপজেলায় এবং চট্রোগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলায় কাঁচবালির মজুদ আছে। কিন্তু তার পরিমাণ মাত্র কয়েক মিলিয়ন টন। সমুদ্র উপকুল, ব্রহ্মপূত্র-যমুনা ও গঙ্গা নদী এলাকার চরের বালি ব্যবহার করে কৃত্রিমভাবে কাঁচবালির মজুদ বাড়ানো যেতে পারে। সমুদ্র উপকুল, ব্রহ্মপূত্র-যমুনা ও গঙ্গা নদীর কিছু কিছু অংশে ০.৮৪১ মিলিমিটারের চেয়ে কম ব্যাসের বালির অবক্ষেপ পাওয়া যায় যাতে সিলিকার পারিমান অপেক্ষাকৃত কম এবং এসব বালিতে আয়রন, ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট ইত্যাদির উপস্থিতি লক্ষ্ করা যায়। তাই এই বালি ফ্লট গ্লাস ফ্যাক্টরিতে ব্যবহার করা যায় না। তবে এই বালিকে প্রক্রিয়া করে অধিক প্রাচুর্য সম্পন্ন সিলিকা বালিতে রূপান্তর করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ভ‚তাত্তি¡ক জরীপ অধিদপ্তরের প্রকাশণা ‘রেকর্ড অব দ্যা জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ, ভলিউম-৫, পার্ট-৫’ থেকে জানা যায় যে, কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপূত্র-যমুনা ধরলার সংযোগ স্থল থেকে সিরাজগঞ্জে এর সাথে করতোয়ার সংগম স্থল পর্যন্ত নদী খাতের চরগুলোর অবক্ষেপের বালিতে প্রায় শতকরা ৮৫ থেকে ৯৫ ভাগই সিলিকা বা কোয়ার্টজ ও ফেল্ডস্পার বিদ্যমান। আর মূল্যবান ভারি খনিজের পরিমাণ প্রায় শতকরা ৫ থেকে ১৫ ভাগ যার গড় পরিমাণ ৯.০১ ভাগ। এখানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জিরকন, গারনেট, ইলমেনাইট এবং কিছু পরিমাণ রুটাইল ও মোনাজাইট আছে।
ইনস্টিটিউট অব মাইনিং, মিনারেলজি এন্ড মেটালার্জি (আইএমএমএম) ব্র্রহ্মপুত্র নদের প্রবেশ মুখ ও সন্নিহিত এলাকায় একটি জরিপ করেছে। জরিপ ফল থেকে জানা যায়, নদ দিয়ে প্রতি বছর ৭৩৫ থেকে ৮০০ মিলিয়ন টন পলি প্রবাহিত হয়। এর অন্তত এক তৃতীয়াংশ নদীর বুকে এবং এক তৃতীয়াংশ তীরবর্তী এলাকায় জমা হয়। বাকি এক তৃতীয়াংশ প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে হারিয়ে যায়। ব্রহ্মপুত্র থেকে বছরে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন টন খনিজসমৃদ্ধ বালু সংগ্রহ করা সম্ভব। আইএমএমএম’র ফলাফলে দেখা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদের প্রতি টন বালুর অন্তত অর্ধেক পরিমাণই কোয়ার্টজ। অর্থাৎ প্রতিটন বালু থেকে অন্তত ০.৫ টন কোয়ার্টজ সংগ্রহ করা যাবে। বছরে ২৫০ মিলিয়ন টন পলি উত্তোলন করা হলে তা থেকে অন্তত ১২৫ মিলিয়ন টন কোয়ার্টজ সংগ্রহ উপযোগী। এছাড়া প্রতি টন পলি হতে প্রায় ৬০০ গ্রাম ইলমিনাইট, ৪০০ গ্রাম জিরকন, ৪০০ গ্রাম রুটাইল, ২ কেজি ৫০০ গ্রাম গারনেট এবং ১০০ গ্রাম মোনাজাইট সংগ্রহ করা সম্ভব। কোয়ার্টজ কাঁচশিল্প ছাড়াও সোলার প্যানেলের সিলিকনের চিপ তৈরিসহ এ ধরনের বিভিন্নকাজে ব্যবহার করা হয়। ইলমিনাইট, রুটাইল ও জিরকন ব্যবহার করা হয় পেইন্ট, পেপার ও সিরামিক শিল্প-কারখানায়। ইলমিনাইট ও রুটাইলের ব্যবহার রয়েছে বিমান তৈরিতে ব্যবহূত টাইটেনিয়ামের উৎস হিসেবেও। গারনেট রতœপাথর এবং কাঁচ বা লোহার তৈরি সামগ্রী উজ্জ্বল করতে ব্যবহূত হয়। ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে মোনাজাইট ব্যবহূত হয়। আর মোনাজাইট হল থোরিয়ামের প্রাথমিক উৎস। ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, সিইআরএন এর প্রাক্তন মহাপরিচালক, নোবেল বিজয়ী প্রফেসর জনাব কার্লো রুবিয়ার মতে, এক মেট্রিকটন থোরিয়াম যে পরিমান শক্তি উৎপন্ন করতে পারে তা এক মেট্রিকটন ইউরিনিয়াম হতে প্রাপ্ত শক্তির প্রায় ২০০ গুন বেশি।
ভ‚ত্বক গঠনকারী উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অক্সিজেন (৪৬.৬%), সিলিকোন (২৭.৭%), অ্যালুমিনিয়াম (৮.১%), লোহা (৫%), ক্যালসিয়াম (৩.৬%), পটাসিয়াম (২.৮%), সোডিয়াম (২.৬%), ম্যাগনেসিয়াম (২.১%) ইত্যাদি। এই উপাদানগুলো খনিজ আকারে ভ‚ত্বকে থাকে। ধাতব সিলিকোন অক্সিজেনের সাথে যুক্ত হয়ে একটি গ্রæপ তৈরি করে, এর নাম সিলিকেট গ্রæপ এবং এই গ্রæপের অন্তর্ভুক্ত খনিজ বা মিনারেলগুলোকে বলা হয় সিলিকেট মিনারেল। ভ‚ত্বকের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগেরও বেশি অংশই সিলিকেট মিনারেল বা সিলিকেট খনিজ দ্বারা গঠিত। সর্বাধিক প্রাচুর্য সম্পন্ন সিলিকেট মিনারেল হচ্ছে ফেল্ডস্পার মিনারেল (পটাসিয়াম/সোডিয়াম,ক্যালসিয়াম অ্যালুমিনিয়াম সিলিকেট) তন্মধ্যে প্লাজিওক্লেস ফেল্ডস্পার (সোডিয়াম,ক্যালসিয়াম অ্যালুমিনিয়াম সিলিকেট) ৩৯% এবং অ্যালকালি ফেল্ডস্পার (পটাসিয়াম অ্যালুমিনিয়াম সিলিকেট) ১২%। অন্যান্য সিলিকেট মিনারেল গুলোর মধ্যে স্ফটিক বা কোয়ার্টজ ১২%, পাইরোক্সিন ১১%, এমফিবল ৫% এবং ক্লে মিনারেল ৫%। এছাড়া সিলিকেট গ্রæপের অন্যান্য খনিজ সমূহ ভূত¦কের মাত্র ৩ ভাগ এবং ভ‚ত্বকের মাত্র ৮ ভাগ ননসিলিকেট মিনারেল অর্থাৎ কার্বনেট, অক্সাইড, সালফাইড ইত্যাদি।
আয়রন, ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট সমৃদ্ধ খনিজ সমূহ সাধারনত চুম্বকীয় মূল্যবান ভারি খনিজ। ভারি খনিজ পৃথকিকরণ (হেভি মিনারেল সিগ্রেগেশন) ও চুম্বকীয় পৃথকিকরণ (ম্যাগনেটিক সেপারেশন) পদ্ধতির মাধ্যমে ভারি খনিজ সমূহ আহরণের পর বালিতে বিদ্যমান থাকে হালকা খনিজ সমূহ (লাইট মিনারেল্স) যার মধ্যে প্রধান মণিক বা খনিজ হিসেবে সিলিকা বা কোয়ার্টজ (ঝরঙ২) ও ফেল্ডস্পারই উল্লেখযোগ্য। এক সময় অধিক ভারি খনিজকে (ভেরি হেভি মিনারেলস) মনে করা হত অধিক মূল্যবান খনিজ বা মণিক ভেরি ভেল্যুয়েবল মিনারেলস)। কিন্তু হালকা খনিজ সমুহও হয়ে উঠেছে অনেক মূল্যবান। আবার ভারি খনিজের ক্ষেত্রে মনে করা হত ‘যত কাল তত ভাল’ এখন এই ধারনা পাল্টে গেছে। কারণ প্লাটিনাম গ্রুপ মেটাল সমূহ কাল হয়না। ফ্রোথ ফ্লোটেশন প্রসেসের মাধ্যমে ফেল্ডস্পার মিনারেল সমূহকে আলাদা করলে যে অবশিষ্ট বালি পাওয়া যায় তাই অধিক প্রাচুর্যতার সিলিকা সমৃদ্ধ কাঁচ বালি যা ফ্লট কাঁচ কারখানায় কাঁচ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
নদীজ ও সমুদ্রতীরের বালির অবক্ষেপ থেকে ভারি খনিজ উত্তোলন শুরু হলে একদিকে যেমন ভারি খনিজের দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানী করে বাংলাদেশ আয় করতে পারে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা, অপরদিকে কাঁচ শিল্প হয়ে উঠতে পারে সয়ং সম্পন্ন ও সমৃদ্ধিশালী।
লেখক- ভূতত্ত্ববিদ ।