বাংলাদেশে জ্বালানি তেল বিপণনের ইতিহাস ও বর্তমান প্রেক্ষিত
তেল আবিস্কারের পূর্ব কথা:
তেল আবিস্কারের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে তার অনুসন্ধান ও ব্যবহারের যথেষ্ট তথ্য পাওয়া যায়। যেমন প্রাচীনকালে মানুষ আলো জ্বালানোর উদ্দেশ্যে ভেজিটেবল অয়েল, ব্যাপসীড অয়েল বা প্রাণী ও মাছের চর্বিযুক্ত তেল ব্যবহার করতো। ঐ সময়ে মানুষ কাপড়, আঁশ অথবা রশি পুড়িয়ে অন্ধকারে আলো তৈরী করতো। ধনী লোকেরা আলো জ্বালাতে তিমি মাছের তেল ব্যবহার করতো। তিমি মাছের তেল ব্যবসায়ীরা তেল সংগ্রহ করার জন্য অধিক হারে তিমি শিকার করতে থাকলে তিমি বিপদাপন্ন হয়ে গিয়েছিল। তাই শাসকেরা তিমি শিকারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। নিষেধাজ্ঞার কারণে শক্তির উৎসের জন্য বিকল্প পথ খুঁজতে আরম্ভ করে এবং তারা মৌচাকের মোম থেকে আলো জ্বালানো শুরু করে। পরবর্তী মোম থেকে মোমবাতি তৈরী করে আলো জ্বালালে কম ধোঁয়ার সৃষ্টি হয় বলে মোমবাতি বাজারে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। খনিজ তেল সহজলভ্য হওয়ার কারণে ধীরে ধীরে মোমবাতির জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। প্রায় ৫০০০ বছর আগে ইউফ্রেটিজ এবং ভূ-মধ্যসাগর তীরবর্তী এলাকায় বসবাসকারী প্রাচীন সুমেরিয়, অ্যাসারিয়ান এবং ব্যবিলনীয় সভ্যতার লোকেরা তাদের দৈনন্দিন কাজ-কর্মে পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থ ব্যবহার করতো। ঐতিহাসিক হিরোডোস ও ডিওডোরাস এর মতে ৪০০০ বছরের বেশী আগে প্রাচীন ব্যবিলনের প্রাচীর ও টাওয়ার নির্মাণে এসফ্যাল্ট ব্যবহার করা হয়েছিল। এ বক্তব্যের সমর্থনে পবিত্র বাইবেলেও তথ্য পাওয়া যায। দুটো ইটকে পরস্পর মজবুত রাখতে এবং নৌযানকে শক্তিশালী রাখতে খৃষ্টপূর্ব ৪০০০ সালে দক্ষিণ পারস্যে মরটার হিসেবে ইহা ব্যবহৃত হতো।
খ্রীষ্টপূর্ব ৩২৭ সালে মহামতি আলেকজান্ডার অক্সাস নদীর তীরে অশোধিত তেলের সন্ধান পেয়েছিলেন। প্রাচীন গ্রীসের জনগণ বিটুমিনের বিবিধ ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞাত থাকলেও তারা বিটুমিনের ব্যবহার সম্পর্কিত জ্ঞান বিজিত রোমানদের কাছে সরবরাহ করেনি। কিন্তু রোমানরাও সভ্যতায় কোন দিক থেকে পিছিয়ে ছিলনা। তারা যুদ্ধ ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য এক ধরনের চমৎকার কামানের উদ্ভাবন করেছিল। যাতে জালানি হিসেবে পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থ ব্যবহার করা হতো। প্রথমে পেট্রোলিয়ামকে ক্যালসিয়াম অক্সইডের সাথে মিশিয়ে আর্দ্র করা হতো, তারপর তা দহন করে শক্তি উৎপাদন করা হতো। অষ্টম শতাব্দীতে আরব ও পারসিকরা অপরিশোধিত পেট্রোলিয়ামের দিকে বিশেষ নজর দেয়। নবম শতাব্দীতে পারসিক রসায়নবিদ মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া রাজী পেট্রোলিয়াম থেকে কেরোসিন তৈরীর পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন। আরব ও পারসিক রসায়নবিদরা সামরিক বাহিনীতে ব্যবহারের জন্য ক্রড অয়েল থেকে বিশেষ ধরনের তেল তৈরির পন্থা বের করে। ১৮০২ সালে ইতালীর রাস্তায় বাতি জ্বালানোর উদ্দেশ্যে অশোধিত তেল ব্যবহার করা হতো। ক্রড অয়েল থেকে পরিশোধনের মাধ্যমে কেরোসিন তেল উৎপাদনের মধ্যদিয়ে শুরু হয় পেট্রোলিয়ামের আধুনিক যুগ। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ভেজিটেবল অয়েল এবং প্রাণীর চর্বি মেশিন ও কলকারখানা সচল রাখার জন্য লুব্রিকেন্টস হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
অধিকাংশ ঐতিহাসিক তেল আবিস্কারে প্রাচীন চীনের অবদানের কথা স্বীকার করলেও তারা চীনের পাশ্ববর্তী দেশ বার্মার অবদান সহজেই এড়িয়ে গেছেন। চীনে যে তেলের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল ঠিক একই ধরনের তেল ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বার্মার টুইঞ্জা সম্প্রদায় বাতি জ্বালানোর প্রয়োজনে আবিস্কার করতে সক্ষম হয়েছিল। টুইঞ্জা সম্প্রদায় কর্তৃক তেল আবিস্কারের ঐতিহাসিক প্রমাণও রয়েছে। বস্তুত পেন্সিলভেনিয়ায় তেল আবিস্কারের বহু পূর্বেই যুক্তরাজ্যের বাজারে টুইঞ্জা সম্প্রদায়ের তেলের লক্ষণীয় বাজার গড়ে উঠেছিল। অধিকন্তু এই তেল শিল্পের জন্যই বৃটিশরা এক সময় বার্মা দখল করে নিয়েছিল। কাজেই তেল আবিস্কারে বার্মার টুইঞ্জা সম্প্রদায়ের অবদান এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। যদিও পাশ্চাত্যে দীর্ঘদিন ধরে একটি দাবী আসছে যে এড্উইন ডেইরক ১৮৫৯ সালে পেন্সিলভেনিয়ায় সর্বপ্রথম তেল আবিস্কার করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও প্রকৃত সত্য এই যে, পেন্সিলভেনিয়ায় তেল আবিস্কারের পাঁচশত বছরেরও বেশী আগে বার্মায় তেল শিল্পের উপস্থিতি প্রমানিত হয়েছিল।
টুইঞ্জা সম্পর্কিত কিংবদন্তী :
বার্মার প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক কিং মংজি‘র দাবী, ৯০০ খৃষ্টাব্দে রাজা মিনখর রাজত্বকালে বার্মায় তেল শিল্পের সূচনা হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, জনৈক চীনা পরিব্রাজক তাঁর ডায়রীতে উল্লেখ করেন যে, “তের শতকের শেষের দিকে আরাকানের দক্ষিণাঞ্চলে তেল শিল্পের ব্যাপকতা লাভ করেছিল”। এসব দাবীর সমর্থনে বার্মাতে বেশ কয়েকটি জনশ্রুতি, গল্প বা মিথ প্রচলিত আছে। নবম শতাব্দীতে ইনাংইয়াং ‘কিয়োকামিউ’ হিসেবে পরিচিত ছিল। যদিও বিভিন্ন কিংবদন্তীতে এর নাম দেয়া হয় সিকতা-কুন-হায়োক। সে সময়ের একজন প্রভাবশালী রাজা তাঁর মন্ত্রী, সভাসদ এবং শক্তিশালী দেহরক্ষী বাহিনী নিয়ে ইরাওয়ার্দ্দী নদীর তীর দিয়ে ঘোড়া চড়ে যাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে রাজা কিছু সুন্দুরী মেয়েকে একটি সুগন্ধীযুক্ত ডোবায় সাঁতার কাটছে দেখতে পেয়ে সভাসদদের জিজ্ঞাসা করেন, ঐ সকল নারীদের পরিচয় কি? মন্ত্রী নিরত্তর। পূনরায় তিনি জানতে চাইলে, উত্তরে তারা বললেন, তারা আপনার হেরেমের মেয়ে। এ কথা শুনে রাজা এতটাই রাগান্বিত হন যে, তিনি তার ভ্রমন সংক্ষিপ্ত করে রাজ্যে ফিরে এবিশেষ আদালতে তাদেরকে তৎক্ষনাৎ হত্যার হুকুম দেন। কিন্তু রাজা পরে তাঁর এ নিষ্ঠুর কর্মের জন্য মনে মনে খুবই অনুতপ্ত হন এবং মানসিক অস্থিরতায় ভোগছিলেন। তিনি রাতে ঘুমাতে পারছিলেননা। কারণ ঘুমোতে গেলেই রাজা দেখতেন যে, মৃত রমণীরা বিকট রূপ ধারন করে নিয়ে তাঁর কাছে আসতো। এক পযার্য়ে কতিপয় ওঝা বা কবিরাজ রাজাকে পরামর্শ দিল, আমরা আপনার চারপাশে এমন প্রতিরক্ষা বুহ্য তৈরি করবো যে, মৃত রমনীদের প্রেতাত্ম আপনার কাছে আসতে পারবে না। অবশেষে রাজা ধীরে ধীরে সুস্থ্য হয়ে উঠেন। খুশী হয়ে রাজা ওঝাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, বিনিময়ে তোমরা কি চাও? ওঝারা বলল, আমরা আপনার কাছে কিছুই চাইনা। রাজার পীড়াপীড়িতে ওঝারা বলল, আপনি খুশী হয়ে যা দিবেন আমরা তাতেই রাজি আছি। রাজা তখন তাঁর দৃষ্টি যতটুকু যায় ততটুকু এলাকা তাদেরকে দিয়ে দিলেন। সেই এলাকাটি ছিল নীচু, বছরের অধিকাংশ সময়ই পানি থাকত এবং পানি থেকে দুর্গন্ধ আসতো। শুকনো মৌসুমে ওঝারা ঐ এলাকায় নানা ধরনের খুড়াখুড়ি করত। এক পর্যায়ে তারা সেখানে কালো তরল পদার্থ দেখতে পায়। এসব কালো তরল পদার্থ তারা আগুন জ্বালানোর কাজে এবং ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করত। এসব কালো তৈলাক্ত পদার্থের উপকারিতা সমগ্র বার্মা ব্যাপি ছড়িয়ে পড়লে এর চাহিদা বেড়ে যায়। ওঝারা তাদের যাযাবর জীবন পরিত্যাগ করে তেল উত্তোলনের কাজে লেগে যায়। শহরের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ইনাংইয়াং ‘যার অর্থ দুর্গন্ধময় পানির নদী’। ইনানইয়াং এর নিকটস্থ ট্ইুন্জন এবং বিমের তেলত্রগুলো ২৪টি টুইঞ্জা পরিবারের বংশানুক্রমিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। টুইনজায়ো শব্দটি তিনটি শব্দ থেকে উদ্ভূত: ‘টুইন’ অর্থ কূপ;‘জা’ অর্থ ভক্ষনকারী বা কূপের মালিক; এবং ‘ইয়ো’ অর্থ পারিবারিক প্রতিনিধিত্ব। ‘টুইঞ্জায়োরা’ নিজেরাই কূপ খননের বন্দোবস্ত করতে পারতো এবং অন্যদেরকে কূপ খননের বন্দোবস্ত করে দিতে পারতো।
কূপ থেকে কালো তেল উত্তোলন পদ্ধতি ছিল খুবই ক্লান্তিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ। কূপ খনন করার পর নিচে নামার জন্য কূপের মধ্যে লম্বালম্বিভাবে গাছের খুটি স্থাপন করা হতো। খুটির সাথে আড়াআড়িভাবে শক্ত রশি নিচের দিকে ঝুলানো থাকতো। রশির নিচের প্রান্তে কাঠের তৈরী পিপা বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হতো। রশির সাহায্যে পিপাটি টানার জন্য উপরে কয়েকজন শ্রমিক অবস্থান করতো এবং অন্য ক’জন শ্রমিক পিপাটি তেলে পূর্ণ করার জন্য গাছের খুটি বেয়ে নিচে নামতো। সাধারণত পুরুষেরা কূপের উপরে রশি টানার কাজে নিয়োজিত থাকতো আর মহিলাদের কূপের ভিতরে নিচে নামিতে দেয়া হতো। সর্বোচ্চ ২৫০ ফুট গভীরে তেল পাওয়া যেতো। তেল জমা হওয়ার পর শ্রমিকরা তেল সংগ্রহের জন্য কূপে নামতো।
তেল সংগ্রহ করতে গিয়ে কূপে ত্রিশ সেকেন্ডের বেশী কেউই থাকতে পারতো না। ত্রিশ সেকেন্ড তেল সংগ্রহের পর এক দল শ্রমিক উপরে উঠে আসতো বিশ্রাম নেয়ার জন্য এবং অন্য একদল নিচে নামতো তেল সংগ্রহের জন্য। এভাবে পালাক্রমে দিনে মাত্র একবার একঘন্টা সময় তেল সংগহের কাজ চলতো। কারণ ভূ-গর্ভে তেল ফোঁটা ফোঁটা করে জমা হওয়া তেলের পরিমাণ বেশী ছিলনা। ১৮৯০ সালে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার যন্ত্রপাতি বাজারে আসার পূর্ব পর্যন্ত এভাবেই বার্মার টুইঞ্জা সম্প্রদায় কষ্ট ও ঝুঁকি নিয়ে কূপ হতে তেল সংগ্রহের করতো। রেঙ্গুনের খোলা বাজারে এবং বার্মার অন্যান্য অংশে এই কালো তেল বিক্রিত অর্থই ছিল টুইঞ্জাদের একমাত্র উপার্জন। তবে অন্যান্য পেশার লোকজনের তুলনায় তারা ছিল অপেক্ষাকৃত ধনী। ইনাংইয়াং এর তেল ক্ষেত্রগুলো ইরাওয়ার্দ্দী নদীর কাছাকাছি হওয়াতে নদী পথে সহজেই বার্মার বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করা সহজ ছিল।
চলবে…
ড. শরীফ আশরাফুজ্জামান
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড