বাংলাদেশে জ্বালানি তেল বিপণনের ইতিহাস ও বর্তমান প্রেক্ষিত
দেশের উন্নয়নের সাথে সাথে জ্বালানি তেলের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য বিপিসি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রয়াত্ত প্রতিষ্ঠান থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করছে। ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে প্রায় ৫৭.০০ লক্ষ মেঃ টন জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রাক্কলন করা হয়েছে। এ চাহিদার প্রায় সম্পূর্ণ পরিমাণই আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে ০.২৫% মানমাত্রার সালফারযুক্ত ডিজেল আমদানি করা হচ্ছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস হতে পর্যায়ক্রমে আরো উন্নতমানের ০.০৫% সালফারযুক্ত ডিজেল আমদানি করা হচ্ছে। দেশে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিপিসি জ্বালানি আমদানির সার্বিক কার্যক্রম গ্রহণ করবে।
বিপিসি’র এর অধীনস্থ কোম্পানিসমূহের বিপণন কার্যক্রম:
পদ্মা অয়েল কোম্পানী লিমিটেড: পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড বাংলাদেশের প্রাচীনতম বৃটিশ-ভারত উপনিবেশিক সময়কালে এর সৃষ্টি। কোম্পানির পূর্বসূরী প্রতিষ্ঠান ”রেংগুন অয়েল কোম্পানি” ঊনবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে বিশ্বের এই অংশে পেট্রোলিয়াম ব্যবসা শুরু করে এবং বর্তমানে এটি দেশের বৃহত্তম তেল বিপণন কোম্পানিসমূহের মধ্যে অন্যতম।
১৮৭১ সালে ”রেংগুন অয়েল কোম্পানি” তাদের প্রধান ব্যবসায়িক কার্যক্রম বার্মায় পরিচালনার উদ্দেশ্যে স্কটল্যান্ড জয়েন্ট স্টক কোম্পানি হিসেবে নিবদ্ধিত হয় (ঊনবিংশ শতকের শেষ পর্যন্ত বার্মা বৃটিশদের নিকট বৃটিশ-ভারতের একটি প্রদেশ হিসেবে পরিচিত ছিল) । ১৮৮৮ সালে, রেংগুন অয়েল কোম্পানি বার্মা অয়েল কোম্পানি হিসেবে পুর্নগঠিত হয়। কোম্পানির ব্যবসায়িক কার্যক্রম সে সময় আসাম ও বাংলাসহ বৃটিশ-ভারত এর অন্যান্য প্রদেশে বিস্তার লাভ করে। কোম্পানির প্রদান কার্যালয় ছিল ১৯১ ওয়েস্ট জর্জ ষ্ট্রীট, গ্লাসগো, ইউ কে। ১৮৮৮ সালে, বার্মা অয়েল কোম্পানি প্রথমবারের মত তেল আহরণের জন্য বার্মায় ড্রিলিং সরঞ্জামাদি ব্যবহার করে। পূর্বে বার্মায় হতে খননকৃত কুপ হতে তেল আরোহন করা হতো।
ইংরেজ ভূ-তত্ত্ববিদ এইচ বি. মেডলিকোটের পরামর্শানুসারে ১৮৮৯ সালে বৃটিশ শাসনামালে বার্মা অয়েল কোম্পানি আসাম এবং বাংলাদেশের সীতাকুন্ড এলাকায় কূপ খনন করলে ১৮৯০ সালে আসামের দিগবয়ে তেল আবিস্কৃত হয়। দিগবয়ে তেল আবিস্কারের পর পরই বার্মা অয়েল কোম্পানি বাংলাদেশের ভূ-খন্ডেও তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্য শুরু করে; পাশাপাশি বিওসির মাধ্যমে বাংলাদেশে শুরু হয় পেট্রোলিয়াম পন্যের আমদানি ও বিপণন ।
১৯০৩ সালে বিওসি চট্টগ্রাম শহরের গোসাইল ডাঙ্গার মহেশখালিতে একটি অয়েল কারখানা প্রতিষ্ঠা করে। এই কারখানায় বার্মা হতে ব্যারেল হিসেবে নৌকাযোগে আনীত কেরোরিন ও জ্বালানি তেল মজুদ করে রাখা হতো। মহেশখালিতে টিনের বক্সে কেরোসিন রাখা হতো এবং তা পরে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হতো। ১৯০৪ সালে বুলক ব্রাদার্স নামে একটি কোম্পানিকে চট্টগ্রামে বিওসির এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বুলক ব্রাদার্স এর কার্যালয় ছিল চট্টগ্রামের সদর ঘাটে। যাহোক ১৯১৪ সালে বিওসি বুলক ব্রাদাসের সদরঘাট অফিসসহ সবকিছুই কিনে নেয়। বুলক ব্রাদার্সের সদর ঘাট অফিসেই বর্তমানে পদ্মা অয়েল কোম্পানির প্রধান কার্যালয়।
১৯০৪ সালে বৃটিশ শাসনামলে বিওসি চট্টগ্রাম এলাকায় একটি ভূ-তত্ত্বিক জরিপ সম্পন্ন করে এবং ১৯১৪ সালে সীতাকুন্ডে প্রথম একটি কূপ খনন করলেও সেটি ছিল শুকনো গর্ত। ১৯১৫ সালে বিওসি বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট সীমান্ত থেকে দশ মাইল দূরে আসামের বদরপুরে দ্বিতীয় একটি তেলক্ষেত্র আবিস্কার করে। ১৯২০ সালে বিওসি আসাম অয়েল কোম্পানির মালিকানা নিয়ে নেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বিওসি’র কর্মকান্ডে কিছু ভাটা পড়লেও ১৯২৩ সালে বিওসি পুনরায় বাংলাদেশ ভূ-খন্ডে তেল অনুসন্ধানের উদ্দ্যেশ্যে কূপ খনন করতে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে জাপানীদের আক্রমণের ভয়ে বিওসি এবং আইবিপিসি’র (ইন্ডো-বার্মা পেট্রোলিয়াম কোম্পানি) প্রায় সকল কর্মকান্ড বন্ধ থাকে। বিওসি তার চট্টগ্রামস্থ স্থাপনা বন্ধ করে দেয়। ভারত বিভাগের পূর্বে বৃটিশ ভারতে পেট্রোলিয়াম পণ্য কলকাতার নিকটবর্তী বজবজ বন্দর হতে বোঝাই করে স্থলপথে ও রেলপথে বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হতো। ড্রাম এবং ৪ গ্যালনের টিনের বক্সের মাধ্যমে নদীপথেও বিভিন্ন জায়গায় তেল পাঠানো হতো। ১৯৪৭ পর্যন্ত প্রধানত বিওসি এবং বার্মা শেল অয়েল ষ্টোরেজ এন্ড ডিসট্রিবিউশন কোম্পানি (বিএসওসি) এ দুটি মার্কেটিং কোম্পানি বাংলাদেশে পেট্রোলিয়াম ব্যবসা পরিচালনা করতো। ১৯৪৮ সালে বার্মা শেল ঢাকার তেজগাও বিমান বন্দরে বিমানের জ্বালানি রাখার জন্য একটি গুদামাগার প্রতিষ্ঠা করেছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর বাংলাদেশে তেল অনুসন্ধানের কাজ নতুনভাবে শুরু হয়; বিওসি এবং বার্মা-শেল পাকিস্তান ও ভারতে তাদের ব্যবসা অব্যাহত রাখে। ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের নিকট গুপ্তখালে বিওসি তার চট্টগ্রামস্থ প্রধান কারখানা নির্মাণ করেছিল। বস্তুত এজন্যই পরবর্তীকালে প্রায় সব তেল উৎপাদন ও পরিশোধন কারখানা বিওসির গুপ্তখালস্থ কারখানার আশপাশে গড়ে উঠে।
তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের তেল বিপণন পরিস্থিতি বিবেচনা করে বার্মা শেল তাদের শেয়ার বিওসি (বার্মা অয়েল কোম্পানি) কে হস্তান্তর করে এবং ১৯৬৫ সালে বিওসি এর ৪৯% শেয়ার নিয়ে বার্মা ইস্টার্ণ লিমিটেড নামে নতুন একটি কোম্পানি গঠিত হয়। অবশিষ্ট শেয়ার পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও বেসরকারি ব্যক্তি মালিকদের ইস্যু করা হয়। ১৯৭৭ সালে বার্মা ইস্টার্ণ লিমিটেড বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন এর একটি অংগ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আতœপ্রকাশ করে। ১৯৮৫ সালে, বিওসি (বার্মা অয়েল কোম্পানি) তাদের বাংলাদেশের সমস্ত সম্পত্তি (বার্মা ইস্টার্ণ লিমিটেড এর শেয়ারসহ) বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) এর অনুকুলে হস্তান্তর করে। বিওসি এর সমস্ত শেয়ার বিপিসি-কে হস্তান্তরের শর্তানুযায়ী বার্মা ইস্টার্ণ লিমিটেড এর নাম পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে এবং তদানুযায়ী ১৯৮৮ সালে কোম্পানির নাম ”পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড এ রুপান্তরিত হয়।
মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড: বর্তমানে বিপিসির অন্যতম প্রতিষ্ঠান মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড মূলত যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ষ্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানির উত্তরসুরি। ১৯০২ সালে ষ্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি বৃটিশ-ভারতে প্রথম তেল অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরুর চেষ্টা করে। ১৯৫৬ সালে ষ্ট্যান্ডার্ড ভ্যাকুয়াম অয়েল কোম্পানি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পেট্রোলিয়াম পণ্যের ব্যবসা শুরু করে। প্রাথমিক বছরগুলোতে ষ্ট্যান্ডার্ড ভ্যাকুয়াম অয়েল অন্য নাম থাকলেও স্বধীনতার পর ১৯৭৫ সালের ২৪ জুন বাংলাদেশ সরকার অধিগ্রহন করে এর নাম দেয় মেঘনা পেট্রোলয়াম মার্কেটিং কোম্পানি।
অপরদিকে পাকিস্তানী কোম্পানি দাউদ গ্রæপ এর সহযোগি প্রতিষ্ঠান দাউদ পেট্রোলিয়াম লিমিটেড ১৯৬৯ সনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পেট্রোলিয়াম পণ্যের ব্যবসা আরম্ভ করেছিল। এ কোম্পানির প্রধান কার্যালয় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। খাজা আরিফ ছিলেন উক্ত কোম্পানির প্রথম পূর্ব-পাকিস্তান ম্যানেজার। ম্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার উক্ত কোম্পানির মালিকানা স্বত্ত্ব লাভ করে এবং ১৯৭৩ সালের ২৩ জানুয়ারী দাউদ পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের নাম রাখা হয় পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড। ১৯৭৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড মেঘনা পেট্রোলিয়াম মার্কেটিং কোম্পানির সাথে একীভূত হলে গঠিত হয় মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড। ১৯৭৮ সালের ৩১ মার্চ থেকে মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড কার্যক্রম শুরু করে। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৮ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (দাউদ পেট্রোলিয়াম কোম্পানি) এর জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন যথাক্রমে এস আর হোসেন এবং আর. কে. জি. মোর্শেদ। প্রথমদিকে যার কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তা পূর্ণাঙ্গরূপে সংগ্রহ করা যায়নি। তবে কিছু নথিপত্রে দেখা যায় ১৯৬০ সাল থেকে যথাক্রমে আলমগীর হাফিজুর রহমান, আর ডব্লিউ মিচেল, আর জে.মাটেলি এবং জি.এস ব্রাউন প্রমুখ ঊঝঝঙ ঊধংঃবহ ওহপ. এর পূর্ব-পাকিস্তান ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সর্বশেষ (৩০.০৩.১৯৭৮ পর্যন্ত) জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করিয়াছিলেন কে. জেড. ইসলাম।
মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড (এমপিএল) সীমাবদ্ধ দায়সহ ১৯৭৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর একটি প্রাইভেট কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয়। ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইন অনুযায়ী এটা পরে ২০০৭ সালের ২৯শে মে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয়। দু’টি শেয়ার ব্যতীত কোম্পানির অবশিষ্ট সকল শেয়ারের মালিক বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন। কোম্পানির মূল কার্যক্রম হলো বিভিন্ন ধরনের পেট্রোলিয়াম সামগ্রী (এইচওবিসি, এমএস, এইচএসডি এবং এসকেও) তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি), বিটুমিন এবং লুব্রিক্যান্টস সংগ্রহ, গুদামজাত ও বাজারজাতকরণ।
১৯৫৬ সালে ষ্ট্যান্ডার্ড ভ্যাকুয়াম অয়েল কোম্পানি লিমিটেড পূর্ব পাকিস্তানে সরাসরি জ্বালানি তেলের ব্যবসা শুরু করেছিল। ১৯৬৮ সালে ষ্ট্যান্ডার্ড ভ্যাকুয়াম অয়েল কোম্পানি তার লুব অয়েলের ব্যবসা হস্তান্তর করে। স্বাভাবিকভাবেই ১৯৬৮ সালের ১২ এপ্রিল রাত বারটায় ষ্ট্যান্ডার্ড ভ্যাকুয়াম অয়েল কোম্পানির পূর্ব পাকিস্তানস্থ পেট্রোল পাম্পগুলো হতে লাল ঘোড়া চিহিৃত লোগো সরিয়ে নেয় এবং এ্যসোর নিজস্ব লোগো স্থাপন করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এ্যসো লাল ঘোড়া চিহিৃত লোগো মুছে ফেললেও মোবিল নামটি মানুষের মুখে মুখে থেকে যায়। সম্ভবত মোবিল নামের লুব অয়েল বাংলাদেশে বেশ সুপরিচিত ছিল বলেই এ্যসো মোবিল শব্দটি রেখে দেয়। স্বাধীনতার পর এ্যাসো মেঘনা অয়েল কোম্পানিতে রূপান্তিরত হয় এবং পেট্রোল ও ডিজেলের পাশাপাশি প্রায় সব ধরনের লুব অয়েলের ব্যবসা অব্যাহত রাখে।
পেট্রোলিয়াম পণ্যের যথাযথ সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষে এমপিএল ১৯৮৩ সালের ৬ অক্টোবর যুক্তরাজ্যের বিপি অয়েল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের সাথে “মেরিন লুব্রিক্যান্টস কনসাইনমেন্ট এ্যন্ড ডেলিভারি এজেন্সি” চুক্তি স্বাক্ষর করে। একই উদ্দেশ্যে ১৯৮৫ সালের ১লা জুলাই এমপিএল বৃটিশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানি পিএলসি (বিপি) এর সাথে” লুব্রিক্যান্টস ফরমুলেশনস, ট্রেড মার্কস এবং মার্কেটিং” সংক্রান্ত একটি লাইসেন্স চুক্তি সম্পন্ন করে। ২০১১ সালের ১৫ মে এমপিএল সাইপ্রাসের লুক অয়েল মেরিন লুব্রিক্যান্টেস লিমিটেড এর সাথে মেরিন লুব অয়েল মজুদ ও বিপণন সংক্রান্ত আরো একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এসব চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে এমপিএল বাংলাদেশে সকল প্রকার ইঞ্জিনে ব্যবহৃত লুব অয়েল মজুদ ও বিপণনের মাধ্যমে জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে।
যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড:
যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড এর পুরনো নাম ছিল পাকিস্তান ন্যাশনাল অয়েল লিমিটেড (চঘঙখ)। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান ন্যাশনাল অয়েল লিমিটেড একটি বেসরকারী লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রথমে দুই কোটি টাকা অনুমোদিত মূলধন নিয়ে পিএনএল এর কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার আইনগতভাবে পিএনএল এর মালিকানা লাভ করে এবং কোম্পানির নতুন নাম হয় বাংলাদেশ ন্যাশনাল অয়েল লিমিটেড। ১৯৭৩ সালের ১৩ই জানুয়ারী এর পুন:নামকরণ হয় যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড। এসময় কোম্পানটি পেট্রোবাংলার নিয়ন্ত্রনাধীন একটি বিশেষ উপদেষ্টা কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হতো। ১৯৭৫-১৯৭৬ সালে কোম্পানির সব সম্পত্তি এবং দায়-দায়িত্ব বিপিসি’র ৩১(সি) নং ধারা মোতাবেক বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের নিকট হস্তান্তর করা হয়। তখন হতে যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড বিপিসির একটি সাবসিয়ারী হিসেবে কাজ করে আসছে। ১৯৮৬ সালের ১লা জানুয়ারি ইন্দো-বার্মা পেট্রোলিয়াম কোম্পানি লিমিটেড এর সকল সম্পত্তি ও দায়-দায়িত্ব যমুনা অয়েল কোম্পানির নিকট হস্তান্তর করা হয়। বিপিসি এবং বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০০৭ সালের ২৫ জুন যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয়। কোম্পানির দু’টি শেয়ার ব্যতীত অবশিষ্ট সকল শেয়ারের মালিক বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন। কোম্পানির মূল কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে-সমগ্র দেশব্যাপী পেট্রোলিয়াম সামগ্রী, বিটুমিন, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) এবং লুব্রিক্যান্ট সংগ্রহ, গুদামজাত ও বাজারজাতকরণ।
১৯৭৫ সালে যমুনা অয়েল কোম্পানি বাংলাদেশে লুব্রিক্যান্ট উৎপাদন ও বিপণন ব্যবসার চুক্তি করে। সর্বশেষ নবায়ন চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ১৯৯৬ সালের ৩০শে জুন। ঐ সময়ের পর যমুনার আর কোন নবায়ন চুক্তি হয়নি। ১৯৯৯ সালে যমুনা অয়েল কোম্পানি মোবিল এশিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের সাথে একটি যৌথ লুব-অয়েল মার্র্কেটিং চুক্তি সাক্ষর করে।
ইষ্টার্ণ রিফাইনারী লিমিডেট ঃ ইষ্টার্ণ রিফাইনারী লিমিটেড (ইআরএল) বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) একটি সাবসিডিয়ারী প্রতিষ্ঠান। এটা দেশের একমাত্র পেট্রোলিয়াম পরিশোধনকারী কারখানা। পাকিস্তানী ব্যবসায়ীদের মালিকানাধীন এই পরিশোধনকারী কারখানাটি ১৫১.৭ মিলিয়ন টাকা ব্যয়ে ১৯১৩ সালের কোম্পানি আইনের আওতায় ১৯৬৩ সালে একটি জয়েন্টভেঞ্চার পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে কর্ণফুলী নদীর তীরে স্থাপিত হয়েছিল। কোম্পানির বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ১৯৬৮ সালে। স্বাধীনতার পর ইআরএলকে জাতীয়করণপূর্বক প্রথমে বাংলাদেশ মিনারেলস, অয়েল এন্ড গ্যাস কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা) এর অধীনে ন্যস্ত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সনে নবগঠিত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) এর নিকট ন্যস্ত করা হয়। ১৯৮৫ সনে বার্মা অয়েল কোম্পানি তাদের শেয়ার বিপিসি’র নিকট বিক্রি করলে কোম্পানির ১০০% শেয়ার বিপিসি বা সরকারী মালিকানায় চলে আসে। কোম্পানির সার্বিক ব্যবস্থাপনা ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইন এর বিধান মোতাবেক গঠিত ন্যূনতম ৭ (সাত) সদস্যের পরিচালক পরিষদের ওপর ন্যস্ত।
ইআরএল এর মূল কাজ হলো- বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন কর্তৃক আমদানিকৃত ক্রুড অয়েল পরিশোধন করে বিভিন্ন পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন করা। ইআরএল প্রধানত দু’ ধরনের অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করে। (১) অ্যারাবিয়ান লাইট ক্রড অয়েল যা সৌদিআরব থেকে আসে এবং (২) মারবান অয়েল যা আবুধাবী থেকে আমদানি করে । ইআরএল প্রতিদিন ৩৪,০০০ ব্যারেল (১৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন) অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করতে পারে। ইআরএল সতের প্রকার পেট্রোলিয়াম পণ্য পরিশোধন করে থাকে। এগুলোর মধ্যে আর.জি (রিফাইনারী গ্যাস), এলপিজি (লিকুইফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস), এস.বি.পি (স্পেশাল বয়েলিং পয়েন্ট সলভেন্ট), এম.এস (মটর স্পিরিট), ন্যাপথা, এস.কে.ও (সুপারিয়র কেরোসিন অয়েল), এম.টি.টি (মিনারেল টারপেনটাইন জেপি-১), জে.বি.ও (জুট-বেচিং অয়েল), এইচ.এস. ডি. (হাইস্পিড ডিজেল) এল.এস.ডি.ও (লো-সালফার ডিজেল অয়েল), এইচ.এস.এফ.ও (হাই সালফার ফুয়েল অয়েল), এল.এস.এফ.ও (লো সালফার ফারনেস অয়েল) এবং বিটুমেন। অবশ্য এগুলোর মধ্যে এসবিপি, জেবিও, এমটিটি এবং বিটুমিন বাহ্যিক অর্থে-জ্বালানি পণ্য নয়। বিপিসি থেকে প্রাপ্ত ‘ক্রুড অয়েল প্রসেসিং ফি’ কোম্পানির আয়ের মূল উৎস। তাছাড়া বিপিসির পক্ষে বিভিন্ন পণ্য যাচাই কমিশন, পণ্য-মানোন্নয়ন, ইনটেনসিভ ইত্যাদি কোম্পানির অন্যান্য আয়ের উৎস।
ই.আর.এল. সর্বদাই একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান। জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এজন্য স্বাধীনতার পর প্রায় সব সরকারই এই প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে সুনজর দিয়ে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশকে জ্বালানি সংক্রান্ত কোন পরীক্ষার জন্য অন্যদেশের উপর নির্ভর করতে হয় না। বাংলাদেশের তেল বিপণন সংস্থা পদ্মা, মেঘনা এবং যমুনা তাদের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলি এখানেই সম্পন্ন করে। বাংলাদেশ বিমান-বাহিনী, নৌ-বাহিনী, সেনাবাহিনী, পাইলট ক্লাব কর্তৃক প্রেরিত জ্বালানি এবং লুব অয়েল নমুনার পরীক্ষা এখানেই সম্পাদিত হয়। জাতীয় জ্বালানি তেল চাহিদার পুরোটাই যদি ই.আর.এল তার নিজ¯^ কারখানায় উৎপাদন করতে পারতো তবে সরাসরি আমদানিকৃত প্রতি ব্যারেল তেলের বিপরীতে ১০ ডলার সাশ্রয় করা সম্ভব হতো।
এলপি গ্যাস লিমিটেড (এলপিজিএল):
এলপিজি বা তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস হলো হাইড্রোকার্বন এবং বুটেন এর সংমিশ্রন। ১৯১০ সালে ডঃ ওয়াল্টার স্নিলিং সর্বপ্রথম এই গ্যাস উৎপাদন প্রক্রিয়ার উদ্ভাবন করেন। ১৯১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্যিকভাবে এলপিজি গ্যাসের উৎপাদন শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশে ১৯৭৮ সালে যমুনা অয়েল কোম্পানির একটি ইউনিট হিসেবে এলপি গ্যাস লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হয় এবং একই বছর এ কোম্পানি বাণিজ্যিকভাবে এলপি গ্যাস উৎপাদন শুরু করে। ১৯৮৩ সালে কোম্পানি আইনের আওতায় প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয় এবং ১৯৮৮ সালে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয়।
ষ্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড:
১৯৪৭ সালের পর বেশ কিছু বেসরকারী কোম্পানি ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান লুব-অয়েল আমদানির সাথে জড়িত হয়। এসব কোম্পানির মধ্যে মেসার্স পাক-বে, এস.টি.এ, ম্যাকলিন এন্ড কিলবার্ন, সিংগার, জনতা, প্যারাগন অয়েল কোম্পানি, রিজভী, এ্যসো, পি.এন.ও, আগা লিমিটেড, আই.বি.পি, অ্যাডাম লিমিটেড, বিইএল, আরিফ ব্রাদার্স, এ,আই.এল এন্ড গ্রীভস লিমিটিড এর নাম অন্যতম। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত এসব কোম্পানি তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে লুব অয়েলের রমরমা ব্যবসা করেছিল। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের তেল মন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্রোর পরামর্শে পাকিস্তান সরকার দেশের তেল সম্পদ জাতীয়করণের লক্ষে বিদেশ থেকে তৈরী লুব্রিক্যান্টস আমদানীর পরিবর্তে দেশে দুটি লুব্রিক্যান্টস উৎপাদন কারখানা গড়ে তুলে। এ দুটি প্রতিষ্ঠান হলো- ইষ্টার্ণ লুব্রিক্যান্টস ব্লেন্ডার্স লিমিটেড (১৯৬৪) এবং ষ্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি (১৯৬৫)। ষ্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানির অন্যতম অংশীদার ছিল এ্যাসো এবং স্থানীয় ব্যবসায়ী মিনহাজ উদ্দীন আহমেদ।
ষ্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড বাংলাদেশের অন্যতম লুব্রিক্যাটিং অয়েল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। ১৯৬৫ সালে এস্যো ষ্ট্যান্ডার্ড ইনকর্পোরেটেড (এস্যো) এবং দি এশিয়াটিক ইন্ডাষ্ট্রিজ লিঃ (এশিয়াটিক) এর যৌথ উদ্যোগে ৫০ঃ৫০ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ষ্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি (প্রাইভেট) লিঃ প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে কোম্পানির ৫০% মালিকানা সরকারের এবং বাকী ৫০% এর মালিক বে-সরকারী প্রতিষ্ঠান-দি এশিয়াটিক ইন্ডাষ্ট্রিজ লিঃ।
ইষ্টার্ণ লুব্রিক্যান্টস্ ব্লেন্ডার্স লিমিটেড (ইএলবিএল):
বিপিসি’র অন্যতম সাবসিডিয়ারী প্রতিষ্ঠান ইষ্টার্ণ লুব্রিক্যান্টস্ ব্লেন্ডার্স লিমিটেড (ইএলবিএল) ১৯৬৩ সালের অক্টোবর প্রথমে একটি প্রাইভেট কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে পরবর্তীতে ইষ্ট পাকিস্তান লুব্রিক্যান্টস্ ব্লেন্ডার্স লিমিটেড নামে একটি পাবলিক কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয় । স্বাধীনতার পর এর নাম হয় ইষ্টার্ণ লুব্রিক্যান্টস্ ব্লেন্ডার্স লিমিটেড। ১৯৮৫ সালে বিওসি গ্রুপ তাদের ৪৯% মালিকানা বাংলাদেশ পোট্রালিয়াম কর্পোরেশন এর নিকট বিক্রি করে দেয়। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৪৫টি কোম্পানি লুব অয়েল আমদানি করে বাজারজাত করছে। বর্তমানে বাংলাদেশে চারটি লুব্রিক্যান্টস উৎপাদন কারখানা রয়েছে। এগুলো হলো ষ্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, ইষ্টার্ণ লুব্রিক্যান্টস ব্লেন্ডিং লিমিটেড, প্যাসিফিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড এবং এফ.আই.সি.এইচএস লুব্রিক্যান্টস বাংলাদেশ লিমিটেড।
২০০৩ সালের ৪ মে যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড মোবিল এশিয়া প্রাইভেট লিমিটেড এর সাথে “মোবিল-যমুনা লুব্রিক্যান্টস” নামে একটি লুব্রিক্যান্টস কোম্পানি প্রতিষ্ঠার অনুমতি লাভ করে।
চলবে…
ড. শরীফ আশরাফুজ্জামান
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড