বিদ্যুতের গ্রাহকসেবা টাকা ছাড়া মিলবে না
সরকারের সেবা খাত হিসেবে স্বীকৃত হলেও বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো টাকা ছাড়া সেবা পাওয়ার সুযোগ গ্রাহকদের জন্য ক্রমেই সীমিত করে দিচ্ছে। বিতরণ কোম্পানিগুলোর সূত্র বলছে, অদূর ভবিষ্যতে টাকা ছাড়া গ্রাহকদের কোনো সেবাই মিলবে না।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) অনুমোদন ছাড়া বিভিন্ন অপরিহার্য সেবার জন্য গ্রাহকদের ওপর সময় সময় মূল্য আরোপ, এর হার ও আওতা বাড়ানো বিধিসম্মত নয়। বিতরণ কোম্পানিগুলো বিইআরসির অগোচরেই এসব করছে।
জানতে চাইলে বিইআরসির চেয়ারম্যান এ আর খান প্রথম আলোকে বলেন, গ্রাহকসেবার জন্য মূল্য ধার্য করা কিংবা এর হার ও আওতা বাড়ানোর জন্য কমিশনে কখনো কেউ (বিতরণ কোম্পানি) আবেদন করেনি। এ সম্পর্কে কমিশন অবগত নয়।
আর গ্রাহকস্বার্থ নিয়ে কাজ করা কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও বিইআরসির সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, বিইআরসির অনুমোদন ছাড়া গ্রাহকসেবার জন্য এ ধরনের কোনো মূল্য নেওয়া অবৈধ।
ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ করছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। ইতিমধ্যে এই কোম্পানির প্রায় সব গ্রাহকসেবাই টাকার বিনিময়ে দেওয়ার বিধান করা হয়েছে। কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মোট ৩৪ প্রকার সেবার জন্য উচ্চ হারে মূল্য ধার্য করে গত বছরের ১২ অক্টোবর দপ্তর আদেশ জারি করা হয়েছে।
ডিপিডিসির সূত্র জানায়, সীমিতসংখ্যক সেবার জন্য আগেও গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হতো। কিন্তু ওই দপ্তর আদেশে সেবার মূল্য ও মূল্যের বিনিময়ে সেবার আওতা বাড়ানো হয়েছে। এখন টাকা ছাড়া গ্রাহকদের জন্য ডিপিডিসির আর কোনো সেবা আছে কি না, জানতে চাইলে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) নজরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘না, মূল্য ছাড়া কোনো সেবা নেই।’
ডিপিডিসি সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও পুনঃসংযোগ, ফিউজ কলচার্জ, ট্রান্সফরমার ভাড়া, সার্ভিস তার মেরামত, মিটার পরীক্ষা, মিটার স্থাপন, মিটার পরিদর্শন, বিল পুনরায় প্রিন্ট, মিটার স্থানান্তর চার্জসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেবার জন্য নির্ধারিত হারে টাকা নিচ্ছে।
ঢাকার বাকি অংশে বিদ্যুৎ বিতরণ করে ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডেসকো)। ডেসকোর অধিকাংশ গ্রাহকসেবা (প্রায় ২১টি) মূল্যের বিনিময়েই নিতে হচ্ছে। তবে মূল্যহার ডিপিডিসির চেয়ে কম এবং এখনো সব সেবার জন্য টাকা নেওয়ার বিধান করেনি। অবশ্য ডিপিডিসি মূল্যহার ও আওতা বাড়ানোর পর ডেসকোও একই পথ অনুসরণের জন্য আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে বলে কোম্পানির সূত্রে জানা গেছে।
গ্রামাঞ্চলসহ দেশের অধিকাংশ এলাকাজুড়ে ৭০ শতাংশের বেশি গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ বিতরণ করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি)। তাদের সেবার জন্য হাতে গোনা কয়েকটি ক্ষেত্রে (১০টির মতো) গ্রাহককে মূল্য শোধ করতে হয়। আরও প্রায় সমানসংখ্যক সেবা এখন পর্যন্ত মূল্য ছাড়াই দিচ্ছে বিআরইবি।
বিআরইবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মঈন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বিতরণ উপকেন্দ্র থেকে শুরু করে লাইন, ট্রান্সফরমার, সার্ভিস তার হয়ে গ্রাহকের বাড়ির মিটার পর্যন্ত সব দায়িত্ব তাঁরাই নেন। এর কোনো পর্যায়ে সেবার জন্য তাঁরা মূল্য নেন না। মূলত গ্রাহকের ঘরের মধ্যে কোনো কাজ করা দরকার হলে তার জন্য মূল্য নেওয়া হয়।
অপর দুটি বিতরণকারী সংস্থা পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ওজোপাডিকো) এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বিতরণ অঞ্চলের গ্রাহকসেবাও বিআরইবির মতোই। তবে এ দুটি সংস্থাও মূল্যের বিনিময়ে দেওয়া গ্রাহকসেবার আওতা ও মূল্য হার বাড়াতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
দুর্নীতি বাড়ছে: গ্রাহকসেবার জন্য ‘সার্ভিস চার্জ’-এর হার ও আওতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতিও বাড়ছে। রাজধানীর আদাবরের একজন গ্রাহক বলেন, তাঁর বাসার বিদ্যুৎ-সংযোগের সার্ভিস তার (রাস্তার লাইন থেকে যে এক টুকরা তারের সাহায্যে কোনো বাড়ির মিটারে সংযোগ দেওয়া হয়) পুড়ে যাওয়ায় তা মেরামতের জন্য ডিপিডিসির স্থানীয় কার্যালয়ে যোগাযোগ করেছিলেন। সেখান থেকে তাঁকে বলা হয়, ‘ব্যাংকে এক হাজার টাকা (সিঙ্গেল ফেজের ক্ষেত্রে, থ্রি ফেজ হলে ফি দুই হাজার টাকা) জমা দিয়ে রসিদ নিয়ে আসুন। আর কাজের জন্য যে মালামাল (মূলত এক টুকরা তার) লাগবে তা কিনুন। তারপর আমাদের লোক গিয়ে মেরামত করে দিয়ে আসবে।’
ওই গ্রাহক বলেন, ওই ফিরিস্তি শুনে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে অনুরোধ করেন তাড়াতাড়ি কাজটি করে দিতে। তখন একজন টেকনিশিয়ানকে ডেকে ওই কর্মচারী বলেন, ‘ওকে নিয়ে যান। মালপত্র যা লাগে ও-ই দেবে। এক হাজার টাকা দিয়ে দেবেন।’ সে অনুযায়ী কাজটি সেরে নেন ওই গ্রাহক।
পুরানা পল্টন ও মোহাম্মদপুরের দুজন গ্রাহকও একই রকম অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন গিয়েছিলেন ট্যারিফ পরিবর্তন করাতে (আবাসিক গ্রাহক থেকে বাণিজ্যিক গ্রাহক হবেন)। তাঁকে এ জন্য ব্যাংকে ৫০০ টাকা জমা দিয়ে রসিদ নিয়ে কার্যালয়ে যেতে বলা হয়। কিন্তু তিনি ব্যাংকে না গিয়ে টাকা দিলে হয় কি না, জানতে চাইলে একজন কর্মচারী ৫০০ টাকা নিয়ে কাজটি করে দেন। তাঁকে ব্যাংকে যেতে হয়নি। ডিপিডিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, এ কাজটির জন্য মাত্র এক মিনিট লাগে। কম্পিউটারে ওই গ্রাহকের ঠিকানা বের করে সেখানে আবাসিকের স্থলে বাণিজ্যিক লিখে দেওয়াই হলো কাজ।
এমন সামান্য অনেক কাজের জন্যই নতুন করে মূল্য ধার্য করা হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে আগের মূল্য হার বাড়ানো হয়েছে। সরকার শিগগিরই নতুন বিদ্যুৎ-সংযোগের জন্য সৌরবিদ্যুতের প্যানেল স্থাপন বাধ্যতামূলক করতে যাচ্ছে। এই প্যানেল পরিদর্শনের জন্যও মূল্য ধার্য করা হয়েছে। নতুন সংযোগ পাওয়ার আগে এক হাজার ওয়াটপিক ক্ষমতা পর্যন্ত প্যানেল পরিদর্শনের জন্য দিতে হবে দুই হাজার টাকা। এর বেশি ক্ষমতার প্যানেলের জন্য ধার্য করা হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা।
বিতরণ কোম্পানিগুলোর সূত্র জানায়, কোনো কোনো সেবার জন্য মূল্য ধার্য করা যৌক্তিক। কিন্তু প্রায় সব ধরনের সেবার জন্য উচ্চহারে মূল্য ধার্য করা হচ্ছে মূলত দুটি কারণে। এক, সংস্থার কিছু আয় বাড়ানো। দুই, সেবার জন্য গ্রাহকের দেওয়া অর্থ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর পকেটে যাবে। সংস্থার ব্যাংক হিসাবে এর প্রমাণ থাকবে না। এতে সংস্থার পক্ষ থেকে বলার সুযোগ থাকবে, তাদের বিতরণব্যবস্থা এত ভালো যে গ্রাহকের কোনো সমস্যা হয় না। আলাদাভাবে কোনো সেবাও নিতে হয় না।