বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, গভীর সমুন্দ্র বন্দর স্থাপনে চুক্তি সই
মহেশখালীর মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র নির্মাণ করে দিচ্ছে জাপান মাতারবাড়িতে কয়লাভিত্তিক একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, কয়লা আমদানির জন্য জেটি নির্মাণ, মাতারবাড়ি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপন, কক্সবাজার থেকে মাতারবাড়ি পর্যন্ত সমুদ্রের ওপর সেতু নির্মাণ এবং মাতারবাড়ি ইউনিয়নকে এইটি টাউনশিপ হিসেবে গড়ে তুলতে অর্থায়ন করবে জাপান। এর পাশাপাশি কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ি ইউনিয়নে একটি বিশেষায়িত গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে দেবে জাপান সরকার। এজন্য জাপান সরকার চার বিলিয়ন ডলার বা ৪০ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে।
জাপানের মারুবিনি কর্পোরেশনের মাধ্যমে এসব অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। আর সবই করা হচ্ছে গত ২৬ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফর কালে স্বাক্ষরিত ‘বাংলাদেশ-জাপান কমপ্রিহেনসিভ পার্টনারশিপ’ শীর্ষক সমঝোতার আওতায়। ওই সমঝোতার আলোকে জাপান সরকার বাংলাদেশের শিল্প উন্নয়নের জন্য ‘বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট বা বিগ-বি’ নামে এক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
জাপান সরকার বিগ-বির জন্য প্রধান তিনটি পিলার চিহ্নিত করেছে। প্রথমটি হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড ট্রেড। মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের মাধ্যমে এই পিলার স্থাপন করা হবে। এ বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশ এশিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্য পরিচালনা করবে। দ্বিতীয় পিলার হচ্ছে জ্বালানি। এজন্য মাতারবাড়িকে দেশের অন্যতম প্রধান জ্বালানি সরবরাহ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে। আর ট্রান্সপোর্ট হচ্ছে তৃতীয় পিলার। এজন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মধ্যে বিদ্যমান সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে শিল্প ও বাণিজ্যের উপযোগী করে ঢেলে সাজানো হবে এবং তা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে বিস্তৃত করা হবে।
এ কর্মসূচির মাধ্যমে মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এলাকায় একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্ট গঠন করবে। প্রস্তাবিত ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্টের জন্য মাতারবাড়ি থেকে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। একই কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ সরকার চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত শিল্প স্থাপনের জন্য ‘ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান’ তৈরি করার প্রস্তাব করেছে সফররত জাইকা প্রেসিডেন্টের কাছে।
এ মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে মাতারবাড়িতে প্রতিটি ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য একটি ঋণ চুক্তি সই হয়েছে। গতকাল রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁও হোটেলে চুক্তিতে সই করেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (আইরডি) সচিব মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিন এবং জাইকার বাংলাদেশ প্রধান মিকিও হাতাদা। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ সময় বাংলাদেশ সফররত জাইকার প্রেসিডেন্ট ড. আকিহিতু তানাকা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, জাপান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ মোট পাঁচ প্রকল্প ঋণের চুক্তি হয়েছে। পঁয়ত্রিশতম জাপান ওডিএ লোন প্যাকেজের আওতায় পাঁচ প্রকল্পে জাপান সরকার বাংলাদেশকে মোট ১ হাজার ১৮৪ কোটি ডলার বা ৯ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দেবে। এর মধ্যে মাতারবাড়ি ‘আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল’ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে জাপান দেবে ৪০ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ১০ বছরের রেয়াতি সময়সহ এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে ৪০ বছরে। আর সুদ দিতে হবে মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়াও অনুষ্ঠানে ২৩ কোটি ১ লাখ ডলারের ন্যাচারাল গ্যাস ইফিসিয়েন্সি প্রজেক্ট, ৩০ কোটি ডলারের ইনক্লুসিভ সিটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ের হাওর ফুড ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড লাইভলিহুড প্রজেক্ট এবং ৯ কোটি ৭০ লাখ ডলারের এগ্রিকালচারাল প্রডাক্টিভিটি ইম্প্রভমেন্ট অ্যান্ড ডাইভারসিটি প্রজেক্টে জাপানি ঋণ দেয়া বিষয়ে চুক্তি সই হয়েছে।
চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে জাইকা প্রেসিডেন্ট ড. আকিহিতু তানাকা বলেন, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে বিশ্বঅর্থনীতির কেন্দ্র এখন ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় বিস্তৃত হচ্ছে। এক্ষত্রে বাংলাদেশ সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার নতুন অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভাব হচ্ছে। তিনি বলেন, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একটি কৌশলগত এলাকা বাংলাদেশ। বিগ-বি কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশ তার কৌশলগত অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে। আর বিগ-বির মাধ্যমে শিল্প স্থাপনের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা হলে বাংলাদেশের অফুরন্ত সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে এদেশের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের ওপরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। আর সেক্ষেত্রে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে বাংলাদেশকে খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না। কারণ মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই মধ্য আয়ের দেশের কাতারে চলে এসেছে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, বাংলাদেশ হচ্ছে ৫ কোটি ক্রেতার বিশাল বাজার। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ উন্নয়নে অনেক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও গভর্নেন্স এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা। এর উন্নতি হলে দেশের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের বেশি হতো। আর গভর্নেন্স ব্যবস্থার উন্নয়নে পুরো পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে সংস্কার করবে সরকার। কেন্দ্র থেকে সরকার পরিচালনার পরিবর্তে ৬৪ জেলা থেকে আলাদাভাবে সরকার পরিচালনা করা হবে।