বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অর্জন সৃজনশীল নেতৃত্বের দৃঢ়তায়

প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী বীর বিক্রম বলেছেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের আজকের যে অর্জন তার মূলে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় ও সৃজনশীল নেতৃত্ব। অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল। নেতৃত্বের দৃঢ়তায় তা মোকাবেলা করে আইনি কাঠামোর মধ্যেই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, গত এক যুগে বাংলাদেশের অর্জন পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় বেশি। আমাদের ইতিহাস গৌরবের। আমাদের আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশ (এফইআরবি) আয়োজিত ‘বিজয়ের ৫০ বছর ও বিদ্যুৎ খাতের অগ্রযাত্রা’ শীর্ষক এক ওয়েবনিয়ারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ, নীতিকাঠামো, জ্বালানি মিশ্রন, বেসরকারি খাতের ভূমিকা প্রভৃতি বিষয়েও বক্তব্য রাখেন।

বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইপিপিএ-বিপ্পা)-এর সহযোগিতায় ১৯শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত এই ওয়েবনিয়ারে বিশেষ অতিথি ছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করা হয়েছে যার নজির আর কোথাও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।
তিনি বলেন, ২০০৯-১০ সালে ভাড়াভিত্তিক, দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, বিশেষ আইন প্রণয়নের মত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে বিদ্যুৎ সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব হত না। এখন আমরা শতভাগ বিদ্যুতায়নের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি। এই যাত্রার সঙ্গী হতে পেরে আমি গর্বিত।’

নসরুল হামিদ বলেন, আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সাশ্রয়ী দামে নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ। সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে চলেছে দেশ।

ওয়েবিনারে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে যখন মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে, তখন এদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল সাকুল্যে ৩০০ মেগাওয়াট। ঢাকাসহ প্রধান কয়েকটি শহর-নগরেই কেবল বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের কারণে সেই ব্যবস্থাও তখন একেবারেই নাজুক। গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল চিন্তারও অতীত।
অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর, প্রায় ২৪ বছরে পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বলতে গেলে কোনো উদ্যোগই নেয়নি। যার মানে-এদেশের উন্নয়নের জন্য তাঁদের কোনো চিন্তাই ছিল না।
স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে ‘গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকরণ’ তথা সবার জন্য বিদ্যুতের অঙ্গীকার ঘোষণা করে । বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) গঠন করা হয়। ঘোড়াশাল, আশুগঞ্জ ও সিদ্ধিরগঞ্জে একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (পাওয়ার হাব) স্থাপনের কাজ শুরু করে।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের ফলে এসব কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি। ফলে শুরু হয় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পথ চলা।
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের অংশ গ্রহনের উদোগ নেয়। আইপিপি পলিসি প্রণয়ন করে তার আওতায় বার্জ মাউন্টেড এবং ছোট ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু করেন।
২০০১ সালে সেই অগ্রগতি থেমে যায়। পরে ২০০৯ সালে পুনরায় যখন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন তখন দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। সেখান থেকে ১২ বছরে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৭৭৭ মেগাওয়াট। একইভাবে করা হচ্ছে সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন, উপকেন্দ্র প্রভৃতি। গ্রিড এলাকায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন প্রায় শেষ। এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত আছে।

মোহাম্মদ হোসাইন সুনির্দিষ্ট তথ্য উল্লেখ করে বলেন, জ্বালানি খাতেও দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে এবং সেখানেও পরিকল্পিত অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে।

এই মূল বক্তব্যের ওপর আলোচনায় ওয়েবিনারের অতিথি, পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট (পিআরআই)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ১৯৯৬-২০০১ সময়কালে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন (আইপিপি) সারা পৃথিবীতে একটা রোলমডেল হয়ে উঠেছিল। ২০০১ সালে নতুন সরকার (বিএনপি-জামায়াত) ক্ষমতায় এলে তাতে ছন্দপতন হয়। রাজনৈতিক কারণে অনেক ভাল প্রকল্প বাতিল করা হয়। ফলে অগ্রগতি ব্যাহত হয়।

ড. মনসুর বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অর্জন এখন বাস্তব, দৃশ্যমান। তবে সামনের চ্যালেঞ্জ সাশ্রয়ী দামে মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ এবং সঞ্চালন ও বিতরণে বিপুল বিনিয়োগের সংস্থান। গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ হয়েছে। কিন্তু এখনো বিদ্যুৎ তেমন পায় না। সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা এর একটা বড় কারণ।

তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম দ্রুত বেড়েছে। জ্বালানির আমদানি নির্ভরতা থাকবে বলেই মনে হয়। তাই বিদ্যুৎ খাতে জ্বালানি মিশ্রন কী হবে সেটা বিশেষভাবে ভাবতে হবে। প্রাথমিক জ্বালানির টেকসই নিরাপত্তা বিধান একটি বড় বিষয়।

পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক বলেন, বিদ্যুতে বেসরকারি খাত একটা ভাল অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। তাঁদের ভূমিকা আরও বাড়াতে হবে। সঞ্চালন ও বিতরণ বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্কের কথা ভাবা যেতে পারে। আঞ্চলিক বিনিয়োগ এবং বিদ্যুৎ আমদানি বাড়ানোর ওপরও বেশি জোর দেওয়া প্রয়োজন। বেসরকারি খাতকেও বিদ্যুৎ আমদানির সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। স্পট মার্কেট থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ব্যাপারে বেসরকারি খাতকে অনুমতি দিলে ভাল ফল আসতে পারে। বেসরকারি খাতকে আরও সুযোগ দিলে সামগ্রিক আর্থিক খাত আরও উজ্জীবিত হবে।

ওয়েবিনারে বিপ্পার প্রেসিডেন্ট ইমরান করিম বলেন, বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি উদ্যোক্তা সৃষ্টির সুযোগ করে দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। সরকারের নীতি বেসরকারি খাতের জন্য উৎসাহব্যাঞ্জক। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণে বিদ্যুৎ খাতের প্রেক্ষাপট বদলে গিয়েছে। বিপ্পা সরকারের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করতে চায়।
এফইআরবির চেয়ারম্যান অরুণ কর্মকারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই ওয়েবিনার সঞ্চালন করেন সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক শামীম জাহাঙ্গীর।