বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে এখনো জরুরি অবস্থা!
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের মেয়াদ চার বছর শেষে আরও চার বছর বাড়ানোর সরকারি উদ্যোগ অনেক প্রশ্ন ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। মন্ত্রিসভা গতকাল সোমবার আইনটির মেয়াদ বৃদ্ধির অনুমোদন করেছে। এখন সেটি সংসদে পাস করা হবে।
কিন্তু এ বিষয়ে প্রথম প্রশ্ন হলো, বিশেষ পরিস্থিতিতে গৃহীত এই আইন দীর্ঘদিন বহাল রেখে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রচলিত আইনকে কত দিন উপেক্ষা করা বা পাশ কাটানো সংগত? দীর্ঘদিন আদালতের এখতিয়ার রহিত করে রেখে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সব ধরনের আইনি কার্যধারা গ্রহণ বন্ধ করে রাখলে কি জবাবদিহির অভাব প্রকট হয়ে উঠবে না?
দ্বিতীয় প্রশ্ন—আইনটি বহাল রাখার মানে হলো, যে পরিস্থিতিতে আইনটি গ্রহণ করা হয়েছিল, সেই বিশেষ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ না হওয়া। তাহলে কি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এখনো নাজুক এবং জরুরি অবস্থার মধ্যে রয়েছে বলে সরকার বলতে চাইছে?
তৃতীয়ত—বিশেষ আইনের সুযোগে অনেক অযোগ্য উদ্যোক্তাকে বিদ্যুৎকেন্দ্র করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তেমন কিছু কেন্দ্র এক-দেড় বছরে সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চার বছরেও হয়নি। বিশেষ আইনের মেয়াদ বৃদ্ধির ফলে কি এমন প্রকল্প অনুমোদনের আশঙ্কা থাকে না?
আরেকটি প্রশ্ন—অযোগ্য ছাড়াও রাজনৈতিক ও দলীয় বিবেচনায় কিছু প্রকল্প অনুমোদন দেওয়ার অভিযোগ আছে। বিশেষ করে ভাড়াভিত্তিক, দ্রুত ভাড়াভিত্তিকসহ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প। আইনটির মেয়াদ বৃদ্ধিতে কি এই অভিযোগের মাত্রা আরও বাড়তে পারে না?
সর্বোপরি, যে উদ্দেশ্যে বিশেষ আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল, তা হাসিল হয়েছে বলেই সরকার সব সময় উচ্চকণ্ঠে বলে থাকে। দেশের মানুষও তা স্বীকার করে। এ অবস্থায় কী কারণে, কার স্বার্থে আবার আইনটির মেয়াদ বৃদ্ধি করা হচ্ছে, তা বোধগম্য নয়।
কী কারণে আইন: দেশে তখন বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চরম ঘাটতি ছিল। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল তিন হাজার ২০০ মেগাওয়াট। ঢাকাসহ শহরাঞ্চলে আট থেকে ১২ ঘণ্টা লোডশেডিং হতো। প্রতিদিন চাহিদার তুলনায় গ্যাসের ঘাটতি ছিল ৫০ কোটি (৫০০ মিলিয়ন) ঘনফুট।
এই অবস্থায় কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছিল। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতি স্থবির হয়ে পড়েছিল। লোডশেডিংয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। প্রচণ্ড গ্রীষ্মে গভীর রাতের লোডশেডিং মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। এই চিত্র ২০০৯-১০ সালের।
এই অবস্থার দ্রুত নিরসন অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। কিন্তু প্রচলিত আইনের অধীন দরপত্র-প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কোনোভাবেই দ্রুত ফল পাওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে সরকার নির্দেশ দিল অযাচিত (আনসলিসিটেড) প্রস্তাব গ্রহণ করে দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তারা তাতে আগ্রহী হলেন না ভবিষ্যৎ ভেবে। দেশের প্রচলিত আইন পাশ কাটিয়ে অযাচিত প্রস্তাব গ্রহণ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে ভবিষ্যতে মামলায় পড়তে পারেন, এই ছিল তাঁদের ভয়।
এই অবস্থায় সরকার দুই বছরের জন্য বিশেষ বিধানসংবলিত আইনটি করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে পরিস্থিতিতে কেউই আইনটির তেমন কঠোর কোনো সমালোচনা করেননি। তারপর যখন দুই বছরের মেয়াদ বাড়িয়ে চার বছর করা হলো, তখনো তেমন উচ্চবাচ্য হয়নি। কারণ, তখন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পরিস্থিতির উন্নতি শুরু হলেও দুই বছরেই যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা সম্ভব হচ্ছে না, সবাই তা অনুধাবন করেছেন।
কিন্তু এখন? চার বছরের মেয়াদ শেষে আইনটি আরও চার বছরের জন্য বলবৎ করার যুক্তি হিসেবে সরকার যা-ই বলুক, তা এখন আর গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
সরকার কী বলতে চায়: একাধিক মন্ত্রী ও সচিব প্রথম আলোকে বলেন, বিশেষ আইনের অধীনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের দ্রুত অনেক অগ্রগতি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এখনো এমন স্থিতাবস্থা আসেনি, যাতে প্রচলিত আইনে প্রকল্প নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সময় দেওয়া যায়।
ওই মন্ত্রী ও সচিব বলেন, বিশেষ আইনের অধীনে অনুমোদন করা কয়েকটি বড় বিদ্যুৎ প্রকল্পের বাস্তবায়নও পিছিয়ে আছে। এর কারণ প্রধানত অর্থায়ন। কোনো কোনো প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার পর জ্বালানির স্বল্পতায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই অবস্থায় আরও কিছু প্রকল্প বিশেষ আইনের অধীনে অনুমোদন করা দরকার আছে।
তবে অন্য কয়েকটি সূত্রের ভাষ্য হচ্ছে, বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ১১ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। আরও বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। এই অবস্থায় নতুন বিদ্যুৎ প্রকল্প করার জন্য বিশেষ আইন অপরিহার্য নয়।
তবে জ্বালানি খাত পিছিয়ে আছে। যদিও গত সাড়ে পাঁচ বছরে গ্যাসের সরবরাহ বেড়েছে প্রায় ৬০ কোটি (৬০০ মিলিয়ন) ঘনফুট। কিন্তু গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ২০০৯ সালের মতো এখনো ব্যবধান প্রায় ৫০ কোটি (৫০০ মিলিয়ন) ঘনফুটই রয়ে গেছে। অবশ্য এ বছরের মধ্যেই বিবিয়ানা ক্ষেত্র থেকে দৈনিক ৩০ কোটি ঘনফুট বাড়তি সরবরাহ শুরু হলে পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি হবে।
এই অবস্থায় সরকার বিশেষ আইনটির চলতি মেয়াদের মধ্যেই (১১ অক্টোবর) আরও কিছু প্রকল্প অনুমোদন করে এর অবসান ঘটাতে পারত। কারণ, ২০১০ সালে দুই বছর মেয়াদের জন্য প্রণীত আইনের ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, এই আইন মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এর অধীনে করা কাজকর্ম বা গৃহীত ব্যবস্থা এমনভাবে অব্যাহত থাকবে ও পরিচালিত হবে, যেন আইনটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়নি।
তা সত্ত্বেও আইনটির মেয়াদ আরও চার বছর বাড়ানোয় সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জনমনে নিঃসন্দেহে অবিশ্বাস ও উদ্বেগ সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক হবে না।