বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঝুঁকি রয়েই গেছে

বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কবল থেকে দেশ রক্ষার সুপারিশ এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে যে কোন সময় আবার বড় ধরণের বিপর্যয়ের ঝুঁকি রয়েই গেছে। স্বল্প মেয়াদে তিন মাসের মধ্যে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু ঘটনার সাড়ে চার মাস হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
এদিকে সোমবার বড় ধরণের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছে দেশ। সে দিন বড় ধরণের গ্রিড বিপর্যয় হতে যাচ্ছিল। জাতীয় গ্রিড বিকল হয়ে সন্ধ্যা ছয়টার সময় একসাথে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রায় ৮০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার কেন্দ্র। সে দিন দ্রুত সময়ের মধ্যে একসাথে কয়েকটি জেলার বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় করা হয়েছিল।  সে জন্য বড় ধরণের বিপর্যয় হয়নি বলে মনে করছেন সংশ্লিরা।
১নভেম্বর সারাদেশে একযোগে বিদ্যুৎ বিপর্যয় হয়েছিল। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির উচ্চক্ষমতার সাবস্টেশনে সমস্যার কারণে সেদিন সমস্যা হয়েছিল। ভয়াবহ সেই বিপর্যয়ের পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ভবিষ্যতে এমন ঝুঁকি মোকাবেলায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছিল। সুপারিশে স্বল্প মেয়াদী কার্যকলাপগুলো তিন মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে বলে। কিন্তু সেগুলো এখন বাস্তবায়ন হয়নি।
সে সময় কমিটি তিন মাসের মধ্যে ২২টি কাজ করার সুপারিশ করেছিল। এরমধ্যে অন্যতম ছিল ৩৩ কেভি এর পাশাপাশি ১৩২ কেভি ফিডারেও আন্ডার ফ্রিকোয়েন্সি রিলে স্থাপন করা যেতে পারে। খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে গেলে গ্রিড বিকল হয়ে যায়। এজন্য যৌক্তিক পরিমান বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ সয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রন করতে হবে। বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দ্রু সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য জাতীয় লোডডেসপাচ সেন্টারে (এলএনডিসি) সার্বক্ষণিক একজন নির্বাহী প্রকৌশলী থাকতে হবে। এলএনডিসি’র জনবলকে দক্ষ করতে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এলএনডিসিকে সার্বক্ষনিক তদারকির জন্য সিসি ক্যামের দিতে হবে। গ্রিড ব্যবস্থাকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করতে হবে। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ, আরপিসিএল (ময়মনসিংহ), শাহজীবাজার, সিলেট, বাঘাবাড়ি, রংপুর, সৈয়দপুর, ভেড়ামারা ও বরিশাল গ্যাস টারবাইন মেশিনগুলোতে গ্রিড বিপর্যয় হলেও পরে সয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়। কিন্তু বিপর্যয়ের দিন তা হয়নি। এভাবে যেন সকল কেন্দ্র চালু হয় সে ব্যবস্থা রাখতে হবে।  উপকেন্দ্রগুলো মেরামত করতে হবে। ভাড়ায় আনা কেন্দ্রগুলোর গ্রিড উপকেন্দ্রের সংযোগকারি ফিডারগুলোর রিলে ব্যবস্থা সমন্বয় করতে হবে। গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) এরমধ্যে উপকেন্দ্রের সাথে সুক্ষভাবে সমন্বয় করতে হবে। ভেড়ামারা গ্রিডের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরও পর্যালোচনার জন্য যৌথ কমিটি করে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ভেড়ামারা উপকেন্দ্রের সমস্যা দ্রুত চিহ্নিত করতে আরও পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং তা সমাধান করতে হবে। পাওয়ার ফ্যাক্টর নিয়ন্ত্রনের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যাপাসিটর ব্যাংক স্থাপন করতে হবে। গ্রিডকে আরও আধুুনিক করতে উপদেষ্টা নিয়োগ দিতে হবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জরুরী বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার জন্য জরুরী ডিজেল জেনারেটর থাকতে হবে। বিভিন্ন ত্রুটি চিহ্নিত করার জন্য সমস্যা চিহ্নিত করণ দল গঠন করতে হবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং উপকেন্দ্রে এলার্ম পদ্ধতি চালু করতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করে সময়ভিত্তিক নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়িত্ব দিতে হবে।
স্বল্প মেয়াদে এসব সুপারিশের বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। যে সুপারিশগুলো মৌখিকভাবে পালন করা সম্ভব সেগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে। কিন্তু যে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে সংস্কার প্রয়োজন তা করা হয়নি। কোন পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়নি। ত্রুটি চিহ্নিত করার জন্য বিশেষ কমিটি করা হয়নি। গ্যাস টারবাইন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ চলে গেলেও সয়ংক্রিয়ভাবে চালুর ব্যবস্থা করা হয়নি। উপকেন্দ্রগুলো মেরামত করা হয়নি। নিয়মিত পরীক্ষা করাও হচ্ছে না। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় ক্যাপাসিটর ব্যাংক লাগানো হয়নি। প্রত্যেক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জরুরী ডিজেল জেনারেটর নেই। ভেড়ামার নিয়ে আরও পর্যবেক্ষণ করা হয়নি। প্রত্যেক কেন্দ্রে এলার্ম ব্যবস্থাও লাগানো হয়নি। বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোতে জিপিএস সময় অনুযায়ি চালু করা হয়নি। এরফলে দেখা যায় একটির ঘড়ি অন্যটির থেকে সেকেন্ডের পার্থক্য রয়েছে। যেখানে মিলি সেকেন্ডে (এক সেকেন্ডের এক হাজার ভাগের এক ভাগ) ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশে পুরো সঞ্চালন ব্যবস্থায় কারিগরি পদ্ধতি আধুনিক না হওয়াতে সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। হাতে হাতে কিংবা ফোনে ফোনে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এতে করে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে সময় চলে যায়।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে জাতীয় গ্রিড বিপর্যয় পরবর্তী করণীয় এবং তদন্ত কমিটির সুপারিশ নিয়ে দুএকবার বৈঠক করা হয়েছে। দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মৌখিক নির্দেশে যা করা সম্ভব তা তা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি ও বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সূত্র জানায়, সোমবার সন্ধ্যা ছয়টায় আশুগঞ্জ সঞ্চালন লাইন বিকল হয়ে পড়ে এতে এক সাথে আশুগঞ্জ ও ময়মনসিংহ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। এক সাথে প্রায় ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে ব্যবস্থা নেয়া এবং উৎপাদন বেশি হওয়াতে সেদিন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা সম্ভব হয়েছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে কয়েকটি জেলায় সাথে সাথে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এতে সাথে সাথে চাহিদা কমে যায়। আর চাহিদা কমে যাওয়াতে উৎপাদন ও চাহিদার সাথে সমন্বয় হয়ে যায়। ঘটনাটি সন্ধ্যায় না হয়ে সকালে হলে কিংবা এলএনডিসিতে কর্তব্যে অবহেলা হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারত বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।