বিশেষ আইনে বিদ্যুৎ: দুর্নীতিতে দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ বলল জাতীয় কমিটি
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা (রোববার, ২রা নভেম্বর ২০২৫):
দুর্নীতির কারণে দেশে বিদ্যুতের দাম প্রতিযোগীদের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি হয়ে গেছে। ভর্তুকি সরিয়ে দিলে এটা ৪০ শতাংশ হবে।
বিশেষ বিধান আইনে করা চুক্তি পর্যালোচনায় গঠিত জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে একথা বলা হয়েছে।
রোববার সচিবালয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের কাছে মধ্যমেয়াদের প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন জাতীয় কমিটির প্রধান হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী।
আগামী বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। ভবিষ্যতে চুক্তিতে অনিয়ম রোধে স্বাধীন সংস্থা করার সুপারিশ করেছে কমিটি।
মঈনুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, পর্যালোচনায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের অধীনে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তিতে দুর্নীতি, যোগসাজশ, জালিয়াতি, অনিয়ম পাওয়া গেছে। দুর্নীতির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়েছে। বিদ্যুতের এই দামে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো টিকতে পারবে না।
কমিটির প্রধান বলেন, বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি পর্যালোচনা করা জটিল ও কষ্টকর কাজ। এজন্য প্রতিবেদন দিতে বেশি সময় লেগেছে। এটি গোপনীয়।
কমিটির সদস্য ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন-এর ফ্যাকাল্টি অব ল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক (অর্থনীতি) মোশতাক হোসেন খান বলেন, যে চুক্তিগুলো হয়েছে সেগুলো সার্বভৌম। একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে একটি কোম্পানির চুক্তি হয়েছে। সার্বভৌম চুক্তি আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। যদি মনে হয় এখানে কোনো কারচুপি হয়েছে, ইচ্ছামত এটাকে বাতিল করতে পারবেন না। এটা বাতিল করলে আন্তর্জাতিক আদালত থেকে অনেক বড় জরিমানা আসবে। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখা হয়েছে প্রক্রিয়াগুলো কী ছিল, সেখানে কোথায় ব্যতিক্রম হয়েছে। কোথায় কোথায় ভুল করা হয়েছে, হস্তক্ষেপ করা হয়েছে, ওপর থেকে হুকুম এসেছে। প্রশাসন যে সবসময় নির্দোষ ছিল তাও না; সেটারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মাশুলটা দিচ্ছে সাধারণ ভোক্তা, ক্রেতা ও করদাতাদের।
আদানি এবং আদানির সঙ্গে আরও কয়েকটি বড় বড় কোম্পানি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত—তাদের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে আইনি প্রক্রিয়া চালু করা হবে, বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
কমিটির অন্য সদস্য বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট ও অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ২০১১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বিদ্যুতের উৎপাদন চার গুণ বেড়েছে। কিন্তু অর্থ পরিশোধ বেড়েছে ১১ গুণ। এটি কোনো টেকনিক্যাল ফ্যাক্ট দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
২০১১ সালে বিদ্যুতের জন্য ৬৩৮ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে, সেটা ২০২৪-এ এসে বেড়ে ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। কাদের টাকা পরিশোধ করেছে, এর বিপরীতে কি পরিমাণ বিদ্যুৎ পাচ্ছি—সেই হিসাব মেলানো যায় না। সেটাই অনুসন্ধানের মূল ফলাফল।
তিনি বলেন, যোগসাজশ শুধু সরকারের মধ্যে হয়েছে তা নয়; আমলা, সরকারি উচ্চ পদে, রাজনীতিবিদ যারা ছিলেন—সব মিলিয়ে যোগসাজশের মাধ্যমে হিসাবের গরমিলটা হয়েছে।
এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আদানির চুক্তি সরকার বাতিল করতে যাচ্ছে কিনা—জানতে চাইলে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, মুখের কথায় বললেই চুক্তি বাতিল করা যাবে না। কারণ এটা আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে হবে। কোনো কারণ ছাড়া চুক্তি বাতিল করলে বড় ধরনের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
তিনি বলেন, ‘চুক্তি বাতিল করার শর্ত চুক্তির মধ্যেই থাকে। জাতীয় কমিটির সঙ্গে কাজ করছি। চুক্তি অনুযায়ী যদি বাতিল করার কোনো কারণ থাকে, তবে আমরা এটি বাতিল করতে দ্বিধা করব না। শুধু দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তিতে কিছু করা যাবে না।
তিনি বলেন, হঠাৎ চুক্তি বাতিল করে সরকারকে আরও বড় দায়ের মধ্যে ফেলতে চাই না।