বেড়েছে গ্যাস সংকট: খোলা বাজার থেকে দ্রুত এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত
রফিক সোবহান:
হঠাৎ গ্যাস সংকট বেড়েছে। সংকট থাকায় ছোট ছোট ২১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ আছে। বন্ধ আছে ৪টি সার কারখানাও। সংকট নিয়ন্ত্রণে সিএনজি স্টেশন প্রতিদিন চারঘণ্টা করে বন্ধ রাখা হচ্ছে। চাপ কম থাকায় শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কয়েকদিন ধরেই এই সংকট চলছে।
আন্তর্জাতিক খোলা বাজার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ১০ কোটি ঘনফুট সমপরিমান গ্যাস আমদানি করা হবে। সংকট মোকাবেলায় জরুরিভিত্তিতে এই গ্যাস কেনা হচ্ছে।
বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বাড়ছে। তাই আন্তর্জাতিক খোলা বাজার থেকে এলএনজি আমদানি আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছিল। ডিসেম্বর পর্যন্ত কেনা হবে না এমনই সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
২০১৮ সালে এলএনজি আমদানি শুরুর আগের মতই গ্যাস ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তাই সংকট মেটাতে জরুরি আবার আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
জ্বালানি বিভাগের জৈষ্ঠ সচিব আনিছুর রহমান এনার্জি বাংলাকে বলেন, সংকট মোকাবেলায় জরুরিভিত্তিতে আন্তর্জাতিক খোলা বাজার থেকে গ্যাস আমদানি করা হচ্ছে। একমাসের মধ্যে এই গ্যাস দেশে আসবে আশা করি।
ছোট ছোট ২১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ
বন্ধ ৪টি সার কারখানাও
তিনি বলেন, তিনটি কার্গোতে এলএনজি আনা হবে। প্রতি কার্গোতে প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ ঘনফুট সমপরিমাণ গ্যাস আমদানি করা হবে।
সরকারি সংস্থা পেট্রোবাংলা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সামিটের দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট করে মোট ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা আছে। কিন্তু এখন আমদানি হচ্ছে ৬০ কোটি ঘনফুট।
দেশীয় গ্যাস উৎপাদন কমে গেছে। মজুদ ফুরিয়ে যাচ্ছে। তাই দিন দিন দেশীয় গ্যাস উৎপাদন কমছেই। কয়েক বছর আগেও দেশের ক্ষেত্রগুলোতে দৈনিক ২৭০ কোটি ঘনফুট উৎপাদন হতো। বর্তমানে তা ২৪০ থেকে ২৪৫ কোটি ঘনফুটে নেমে এসেছে।
জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমান জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানি আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় দ্বিগুণ দামে গ্যাস কিনতে হচ্ছে। দেশীয় কূপগুলো থেকে কম গ্যাস মিলছে। চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম হওয়ায় সংকট হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ কমানোর কথা গতমাসেই বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে জানিয়েছিল পেট্রোবাংলা।
বিশ্ববাজারে যখন দাম বেশি থাকে, তখন চুক্তিবদ্ধ কোম্পানির কাছ থেকে এলএনজি আমদানি করা অপেক্ষাকৃত ভাল। মূলত এমন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যই দীর্ঘ মেয়াদে চুক্তি করা হয়। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে যখন দাম কমে যায়, তখন খোলাবাজার থেকে আমদানি করলে খরচ কম হয়। দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিবদ্ধ দুই কোম্পানি কাতারের রাসগ্যাস এবং ওমানের ওমান ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনালের (ওটিআই) কাছ থেকেই এখন এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে।
এলএনজি আমদানি বাড়ালে খরচও বাড়ে। গত অর্থবছর এলএনজি আমদানিতে ২ হাজার ৮১২ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। চলতি বছর আরও বেশি লাগবে। তাই যতটা সম্ভব কম আমদানির কথা ভাবা হচ্ছে। গত অর্থবছর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার এলএনজি আমদানি করা হয়েছে। চলতি বছর এর পরিমাণ আরও বাড়বে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, গ্যাস সংযোগের জন্য ২৫০টি শিল্প কারখানার আবেদন পড়ে আছে। কিন্তু পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় সেগুলোতে এখন সংযোগ দেওয়া যাচ্ছে না। চাহিদার চেয়ে সরবরাহ এখন কম। ঘাটতি দূর করতে এলএনজি আমদানি আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশীয় উৎস থেকেও সংগ্রহ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। ব্যয়বহুল এলএনজি থেকে শিল্পে গ্যাস সরবরাহ করা হলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, খরচ বেশি হলেও ব্যবসায়ীরা এখন গ্যাস চান। সেই সক্ষমতা উদ্যোক্তাদের আছে।
দেশে গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদন যত বাড়বে, গ্যাসের চাহিদাও তত বাড়বে। অথচ দেশে গ্যাসের প্রমাণিত মজুত ফুরিয়ে আসছে। জ্বালানি অনুসন্ধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না থাকায় দেশীয় উৎস থেকে চাহিদা পুরোপুরি মেটানো অসম্ভব হয়ে গেছে।
শিল্প উৎপাদনের চাকা সচল রাখতে আপাতত সমাধান এই ব্যয়বহুল জ্বালানি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সেই ব্যয় বহন করতে হিমশিম খাচ্ছে জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলা। অর্থের সংস্থান না থাকায় পুরো সক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। অথচ লক্ষ অনুযায়ী, ২০৪১ নাগাদ শুধু বিদ্যুকেন্দ্রের জন্যই দৈনিক ৩০০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন হবে।
শিল্প উদ্যোক্তারা জানান, ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে মার্চ থেকেই গ্যাসের সংকট বাড়তে শুরু করে। মে ও জুন মাসে তা কিছুটা কমলেও জুলাইয়ের শেষ দিক থেকে বেড়েছে। চলতি মাসে সংকট তীব্র হয়েছে।
তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (তিতাস গ্যাস) আওতাধীন এলাকায় দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ১৯০ কোটি ঘনফুট। বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৭০ কোটি ঘনফুট। ঘাটতি ২০ কোটি ঘনফুট। এতে শিল্প কারখানা যেমন চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছে না, তেমনি গ্যাসের নিশ্চয়তা না পাওয়ায় অনেক শিল্প কারখানা যাত্রা শুরু করতে পারছে না।
জানা গেছে, রাজধানীর আশপাশে সাভার, জয়দেবপুর, আশুলিয়া, ময়মনসিংহ নারায়ণগঞ্জে শিল্প প্রতিষ্ঠানে দিনের কোনো কোনো সময়ে গ্যাসের নির্ধারিত চাপ তিন ভাগের এক ভাগে নেমে আসে। এতে শিল্প উৎপাদন, রপ্তানি কার্যক্রম ও অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, কাতার কিংবা ওমানের অন্য আরেকটি কোম্পানির কাছ থেকে দীর্ঘ মেয়াদে এলএনজি আমদানি করার চুক্তির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিন মাসের মধ্যে এই চুক্তি করার চেষ্টা চলছে। ১০টির বেশি কোম্পানি এই এলএনজি সরবরাহ করার প্রস্তাব দিয়েছে। মহেশখালীতে আরেকটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনাও করা হয়েছে।
বর্তমানে দেশে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ৪৩০ কোটি ঘনফুট। ১৬ই সেপ্টেম্বর সরবরাহ করে ২৯০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। ঘাটতি ছিল ১৪০ কোটি ঘনফুট। ২০১৮ সালে যখন এলএনজি আমদানি করা হয়, তখন দেশে দৈনিক ৩৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ ছিল ২৭৫ ঘনফুট। ঘাটতি ছিল ৮৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস। এলএনজি আমদানি শুরুর পর ঘাটতি অনেকখানি কমে গেলেও এখন তা আগের চেয়ে বেড়েছে। এর বড় কারণ দেশীয় উৎস থেকে জোগান কম থাকা।
প্রণোদনা নয় গ্যাস চাই
সাংবাদিক সম্মেলন করে সম্প্রতি বস্ত্রকল উদ্যোক্তারা সংকট সমাধানে দ্রুত এলএনজি আমদানি বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, আমরা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস চাই, প্রণোদনা চাই না। সমাধান না হলে বস্ত্র খাতে বিপর্যয় নেমে আসবে। শিল্প শ্রমিক ও দেশের স্বার্থে এলএনজি সরবরাহ বাড়ানো দরকার। কারখানাগুলোতে গ্যাসের চাপ থাকার কথা প্রতি বর্গইঞ্চিতে (পিএসআই) ১৫ পাউন্ড। কিন্তু কোনো কোনো কারখানায় এই চাপ মাত্র এক দশমিক পাঁচ পিএসআই। কোনো কোনো কারখানায় শূন্য। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, ধামরাই, সাটুরিয়া, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে অবস্থিত টেক্সটাইল মিলগুলোয় গ্যাসের চাপ সবচেয়ে কম।