ভর্তুকি নয় লক্ষ্য মুনাফা
রফিকুল বাসার:
বিদ্যুৎ জ্বালানিখাত থেকে মুনাফা করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। ২০৪১ সালে যখন উচ্চ আয়ের দেশ হবে তখন এই খাত নির্ভরশীলতা কমিয়ে নিজস্ব আয় থেকে পরিচালিত হবে। আর এজন্য বেসরকারি অংশগ্রহণ বাড়ানোসহ বিভিন্ন কৌশল ঠিক করা হয়েছে।
উচ্চ আয়ের দেশের সাথে তাল মিলিয়ে সাজানো হচ্ছে বিদ্যুৎ জ¦ালানি খাত। একার্যক্রম শুরু হয়েছে এখনই।
২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের দেশ হবে বাংলাদেশ। সেই লক্ষ্যপূরণে জ¦ালানি চাহিদা বাড়বে। বিদ্যুৎ খাতকে আর্থিকভাবে টেকসই করাসহ এর সম্পদের ওপর একটি গ্রহণযোগ্য হারে মুনাফা অর্জনের জন্য সক্ষম করে তোলা হবে।
‘বাংলাদেশ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-৪১’ এ এই কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের করা এই পরিকল্পনায় শতভাগ বিদ্যুতায়নের পর ন্যায্য দাম এবং মানসম্মত বিদ্যুৎ পৌছানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উচ্চ আয়ের দেশে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে জ¦ালানি চাহিদা বাড়বে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। এই চাহিদা মেটাতে প্রাথমিক জ্বালানির প্রধান অবলম্বন রাখা হয়েছে আমদানি।
লাভজনক করতে উৎপাদন খরচ কমানো, বিপণনে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো, আমদানি খরচ কমানো, প্রাথমিক জ¦ালানি নিশ্চিত করা, জ্বালানির দক্ষ ব্যবহার, উৎপাদন সঞ্চালন ও বিতরণে সুষম বিনিয়োগসহ নানা কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে প্রেক্ষিত পরিকল্পনায়।
উচ্চ-মধ্য-আয় এবং উচ্চ-আয় অর্থনীতির জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সক্ষম বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত করতে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সাথে সঙ্গতি রেখে মূল্য ও দক্ষতা বাড়ানো হবে। প্রতিযোগিতামূলক দরে বিদ্যুৎ আমদানির সাথে অভ্যন্তরীণ দক্ষ সরবরাহের সুষম সমন্বয় এবং শতভাগ জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
লাভজনক করা: চলতি বছর থেকে পর্যায়ক্রমে ভর্তুকি তুলে বিদ্যুৎ জ্বালানিকে লাভজনক করা হবে। ২০৩১ সালে এই খাত থেকে ৬ শতাংশ আর ২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের দেশে বিদ্যুৎ জ্বালানির সম্পদ থেকে ৮ শতাংশ লাভ করা হবে। উচ্চ আয়ের সাথে সঙ্গতি রাখতে লাভজনক করাই মূলনীতিই ঠিক করা হয়েছে। আগামী ২০ বছর এই খাতে সরকারি বেসরকারি প্রচুর বিনিয়োগ হবে। এই বিনিয়োগের সম্পদের ওপর গ্রহণযোগ্য হারে মুনাফা অর্জনের জন্য সক্ষম করা হবে। সরকারি বেসরকারি উভয় বিনিয়োগকারি যেন তার বিনিয়োগের মুনাফা তুলে নিতে পারে। তাই বিদ্যুতের মূল্য এমনভাবে নির্ধারণ করা হবে যাতে উদ্যোক্তা তা থেকে উৎপাদন ব্যয় তুলে নিতে পারে। আবার সম্পদের ওপর যুক্তিযুক্ত হারে মুনাফা আদায় করতে পারে।
বাজেটীয় অর্থায়ন: বাজেট থেকে এই খাতে বরাদ্দ পর্যায়ক্রমে কমানো হবে। বাজেটে অর্থায়ন অংশ থাকবে অল্প। সরকারি কোম্পানিগুলো নিজস্ব অর্থেই বিনিয়োগ করবে।
নীতি শিথিল : ক্রমান্বয়ে বিদ্যুৎ বিতরণ ও তেল বিপণনে সরকারি নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা হবে। অর্থাৎ বিপণন ও বিতরণে বেসরকারি বিনিয়োগ ও মুনাফার সুযোগ রাখা হবে।
বিপণনে বেসরকারি বিনিয়োগ: বিদ্যুৎ জ¦ালানিখাতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো হবে। বিশেষ করে বিপণন পর্যায়ে। মূল্য সংস্কার ও নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে বেসরকারি অংশ বাড়ানো হবে। অর্থাৎ সরকারি নিয়ন্ত্রণ কমানো হবে। এখন তেল, গ্যাস বা বিদ্যুৎ সব সরকারি কোম্পানি সরবরাহ ও বিতরণ করে। এখানেও বেসরকারি বিনিয়োগ আনা হবে। এবং তাদের যথাযথ লাভ করার সুযোগ দেয়া হবে। বর্তমানে আমদানিসহ বেসরকারিখাতের প্রায় অর্ধেক বিনিয়োগ আছে। ২০৩১ সালে এই অংশ হবে ৫৫ শতাংশ এবং ২০৪১ সালে ৬০ শতাংশ।
সরকারি প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন: বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মত সরকারি প্রতিষ্ঠানকেও মুনাফাভিত্তিক করা হবে। এজন্য মূল্য নির্ধারণে বিইআরসি’র ক্ষমতা বাড়ানো হবে।
জ্বালানি বাণিজ্য: আন্তঃদেশীয় জ্বালানি বাণিজ্য বাড়ানো হবে। ২০৩১ সালে বিদ্যুৎ আমদানি বাড়ানো হবে ৫ হাজার মেগাওয়াটে। আর ২০৪১ সালে ৯ হাজার মেগাওয়াট।
পেট্রোলিয়াম সরবরাহে পাইপলাইন: তরল জ্বালানি সরবরাহের জন্য দেশজুড়ে ১ হাজার ১৭৭ কিলোমিটার পেট্রোলিয়ামের পাইপলাইন স্থাপন করা হবে।
রিফাইনারি: জ্বালানি তেল শোধনাগারের ক্ষমতা বাড়ানো হবে। বছরে এক কোটি ৯৫ লাখ টন শোধন করতে সক্ষম করা হবে।
স্বল্পব্যয়ী পন্থা: বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমানোর সাথে প্রাথমিক জ্বালানি খরচও কমানো হবে। বলা হচ্ছে, কয়লা ও গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এই খরচ কমানো হবে। কিন্তু আমদানি নির্ভর থেকে তা কীভাবে সম্ভব হবে তার ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। তেলের পরিবর্তে ব্যবহার হবে এলএনজি। জলবিদ্যুৎ, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা এবং পরমাণু এগুলোইকেই ভবিষ্যৎ অল্প খরচের জ¦ালানি হিসেবে নির্ভর করা হচ্ছে।
প্রাথমিক জ্বালানির জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন:এলএনজি ও আমদানি করা কয়লা দুটোই অবকাঠামো নির্ভর জ্বালানি। আমদানি করা এই জ্বালানি বিদ্যুৎকেন্দ্রে সংযুক্ত করতে বন্দরে, মজুদ সুবিধা এবং রেল ও সড়ক অবকাঠামোতে প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন। এজন্য তেল শোধনাগারের সক্ষমতা বাড়ানো এবং মজুদ বেশি রাখার ব্যবস্থা করা হবে। পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করে এসব করা হবে।
উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের মধ্যে সুষম বিনিয়োগ: উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণে বিনিয়োগ বাড়ানো হবে। জেলা পর্যায়ে বিদ্যুৎ বিভ্রাট কমাতে নেয়া হবে বিশেষ উদ্যোগ। পল্লী বিদ্যুতায়ন কর্মসূচি প্রাধান্য পাবে।
স্থাপিত সক্ষমতার দক্ষতা বাড়ানো: বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। এতে অপচয় বেশি হচ্ছে। অর্থব্যয়ও বেশি। পর্যায়ক্রমে এই পার্থক্য কমিয়ে আনা হবে। দক্ষতার সাথে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সক্ষমতা প্রায় ২০ শতাংশ হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে এটি ৩৩ শতাংশ।
বিদ্যুৎ বাণিজ্য: বলা হচ্ছে, বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেয়ে আমদানিতে খরচ কম। তাই প্রতিবেশি দেশ থেকে আমদানি বাড়ানো হবে।
পরিবেশগত সুরক্ষা: জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে কার্বন নিঃসরণ করার জন্য কার্বন কর প্রথা প্রবর্তন করা হতে পারে।
জ্বালানি মিশ্রণ: নিম্ন কার্বন উপাদানসহ স্বল্পব্যয়ে জ্বালানির ব্যবহার করতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখী করা হবে।
সরকারি প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করা: বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বিভিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানি, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন এবং পেট্রোবাংলা ও সংশ্লিষ্ট কোম্পানিসগুলোকে শক্তিশালী করা হবে। ভোক্তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা, গবেষণা ও নীতি নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি), টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে (বিপিসি) শক্তিশালী করা হবে।
গ্রিডভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চাহিদা: ২০৪১ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে প্রায় ৫৭ হাজার মেগাওয়াট। এসময় সর্বোচ্চ চাহিদা ধরা হয়েছে ৫১ হাজার মেগাওয়াট। আর ২০৩১ সালে ৩৩ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন হবে, চাহিদা হবে ২৯ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট।
পদ্ধতিগত লোকসান: পদ্ধতিগত লোকসান বা সিস্টেম লস একক সংখ্যায় আনা হবে। তবে লোকসান থেকেই যাবে। বলা হচ্ছে, ২০৩১ সালে ৮ শতাংশ এবং ২০৪১ সালে ৬ শতাংশ লোকসান হবে। যা এখন আছে ১১ শতাংশ।
২০৪১ সালে গ্যাস থেকে ৩৫ শতাংশ, কয়লা থেকে ৩৫ শতাংশ, পারমানু থেকে ১২ শতাংশ, আমদানি থেকে ১৬ শতাংশ এবং পানি ও অন্যান্য থেকে বাকী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। আর ২০৩১ সালের মধ্যে গ্যাস থেকে ২৯ শতাংশ, কয়লা থেকে ৩০ শতাংশ, পরমানু থেকে ১৪ শতাংশ, আমদানি থেকে ১৭ এবং পানি থেকে ১ শতাংশ বিদ্যুৎ হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম এনার্জি বাংলাকে বলেন, প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি কৌশলের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে নতুন চাহিদা পূরণ করা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি চাহিদা পূরণে প্রয়োজন বিপুল বিনিয়োগ। যার উদ্দেশ্য হবে বেশি খরচের তরল জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেয়া। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যথাসম্ভব স্বল্প ব্যয়ে প্রাথমিক জ্বালানির ব্যবস্থা করা। এছাড়া কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া। তিনি বলেন, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১-এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যমাত্রা বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে একটি উচ্চ-আয় অর্থনীতির কাক্সিক্ষত ধারায় প্রতিস্থাপন করবে।
=
=
‘চলতি বছর থেকে পর্যায়ক্রমে ভর্তুকি তুলে বিদ্যুৎ জ্বালানিকে লাভজনক করা হবে। ২০৩১ সালে এই খাত থেকে ৬ শতাংশ আর ২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের দেশে বিদ্যুৎ জ্বালানির সম্পদ থেকে ৮ শতাংশ লাভ করা হবে।’
‘সরকারি বেসরকারি উভয় বিনিয়োগকারি যেন তার বিনিয়োগের মুনাফা তুলে নিতে পারে। তাই বিদ্যুতের মূল্য এমনভাবে নির্ধারণ করা হবে যাতে উদ্যোক্তা তা থেকে উৎপাদন ব্যয় তুলে নিতে পারে। আবার সম্পদের ওপর যুক্তিযুক্ত হারে মুনাফা আদায় করতে পারে।’
‘মূল্য সংস্কার ও নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে বেসরকারি অংশ বাড়ানো হবে। অর্থাৎ সরকারি নিয়ন্ত্রণ কমানো হবে। বেসরকারি বিনিয়োগ আনা হবে এবং তাদের যথাযথ লাভ করার সুযোগ দেয়া হবে।’