ভূমিকম্পে কাঁপল বাংলাদেশ

ভোররাতে কেঁপে উঠল বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল। শীতের ভোরে কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী এই ভূমিকম্পে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে বাসাবাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। হুড়াহুড়ি করে নামতে গিয়ে এ রিপোর্ট লিখা পর্যন্ত বাংলাদেশে ৫ জন মারা গেছে। এছাড়া আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভবন হেলে পড়ার ও ফাটল ধরার খবর পাওয়া গেছে।
ভারতে মারা গেছে ৮জন। এছাড়া ভুটান, নেপাল ও মিয়ানমারেও কম্পন অনুভূত হয়। তবে এসব অঞ্চলে ক্ষয়ক্ষতির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
উৎপত্তিস্থল: যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ (ইউএসজিএস) দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ৭। কেন্দ্র ছিল মনিপুরের ইম্ফল থেকে ২৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি। উৎপত্তিস্থল ছিল ভূপৃষ্ঠের ৫৫ কিলোমিটার গভীরে।
তবে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র জানায়, বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টা ৫ মিনিট ২১ সেকেন্ডে এই কম্পন অনুভূত হয়। মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৬। এটা তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প। উৎপত্তি স্থল ছিল ঢাকার সিসমিক সেন্টার থেকে ৩৫৩ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে। সিলেটের কাছে হওয়ায় সেখানে দুই দফা ভূমিকম্প অনুভূত।
হতাহত: সোমবার ভোরে ভূমিকম্পের সময় দেশের বেশিরভাগ মানুষ ঘুমিয়ে ছিল। ঘুমের মধ্যেই অনেকে কম্পন অনুভব করেন। প্রচণ্ড ঝাকুনিতে আতঙ্কে জেগে ওঠে মানুষ। আতঙ্কিত হয়ে ঢাকা, জামালপুর, রাজশাহী, পঞ্চগড় ও লালমনিরহাটে পাঁচজন মারা গেছেন। এ ঘটনায় আহত হয়ে ২৯ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং ৩২ জন সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা রোকসানা মার্জিয়া বলেন, প্রথমে মনে হচ্ছিল আমার মাথা ঘুরছে, পড়ে দেখি খাট নড়ছে, সিলিং ফ্যান নড়ছে। ঘরের সবকিছু দুলছে। বাচ্চাকে কোলে তুলে নিয়ে দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছিলাম। পুরান ঢাকার মামুন জানান, পুরো ভবন কাঁপছিল। জানালার থাইগ্লাসগুলো ঝনঝন আওয়াজ করছিল। এই পরিস্থিতিতে অন্য অনেকের মতো তিনিও বাসা থেকে নিচে নেমে আসেন। মানিকনগরের বাসিন্দা মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, বাসায় জানালার কাঁচগুলোতে অনেক জোরে জোরে ঝনঝন শব্দ হচ্ছিল। তিনি ভেবেছিলেন চোর এসেছে। পরে ভূমিকম্পের বিষয়টি তিনি বুঝতে পারেন। কিন্তু তার বাসা ৭ তলায় হওয়া তিনি নামার চেষ্টা করেননি। সিড়ির কাছে দাঁড়িয়েছিলেন। কম্পন শেষ হলে তিনি আফটার শক হতে পারে চিন্তা করে বাসার নিচে নেমে আসেন।
ঢাকা মেডিকেল ফাঁড়ি পুলিশের পরিদর্শক মোজাম্মেল হক জানান, রাজধানীর পূর্ব জুরাইনের এক বাসা থেকে দৌঁড়ে নামতে গিয়ে আতিকুর রহমান নামে ২৩ বছর বয়সী এক তরুন মারা যান। জামালপুর প্রতিনিধি জানান, ভূমিকম্পের সময় মেলান্দহ উপজেলার দুরমুঠ জাঙ্গলিয়া গ্রামের দর্জি সোনা মিয়া আতঙ্কে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। রাজশাহী ব্যুরো জানায়, আতঙ্কিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের প্রধান বাবুর্চি খলিলুর রহমান মারা যান। ভুমিকম্পের পরপরই ফায়ার সার্ভিসের দুটি টিম নগরজুড়ে টহল দেয়। লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা পাটগ্রাম উপজেলার ঘোনাবাড়ি গ্রামের মুদি ব্যবসায়ী নুর ইসলাম কন্দু আতংকে দ্রুত ঘরের বাহিরে বের হওয়ার সময় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে বাড়িতে মারা যান তিনি। পঞ্চগড় শহরে তাহমিনা বেগমকে চিকিৎসা দেয়া চিকিৎসক জানান, শরীরে কোনো জখমের চিহ্ন ছিল না। আতঙ্কে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা গেছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের একজন দায়িত্বরত কর্মী জানান, সকাল থেকে যারা চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী রয়েছেন। এদের মধ্যে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের এক শিক্ষার্থী পাঁচতলা ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন। এছাড়া মহসিন ও কবি জসিম উদ্দীন হলের দোতলা থেকেও পাঁচজনের লাফিয়ে পড়ে আহত হওয়ার খবর দিয়েছে কয়েকটি সংবাদমাধ্যম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আমজাদ আলী ১৬ জনকে ঢাকা মেডিকেলে নেয়ার কথা জানিয়েছেন। জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আহতদের মধ্যে তিনজন ভর্তি আছেন। তাদের অবস্থা গুরুতর। সিলেট ব্যুরো জানায়, সিলেটে ভোর ৫টা ৫ মিনিটে রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ৬ মাত্রার ও সকাল ৯টা ৫৭ মিনিটে আবারো ৩ দশমিক ৬ মাত্রার ভ‚মিকম্প হয়। ভোরে ভূমিকম্পে সিলেট নগরীতে নির্মাণাধীন মার্কেটের ১০ তলা ভবনের একটি দেয়াল ধসে পার্শ্ববর্তী বাসায় পড়লে একই পরিবারের ৪ জন আহত হন। আহতরা সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

ছবি: বিডি নিউজ
ছবি: বিডি নিউজ

ক্ষয়ক্ষতি: ভূমিকম্পের কারনে ঢাকার বংশাল থানার একটি ছয় তলা ভবন হেলে পড়েছে, ফাটল দেখা দিয়েছে শাঁখারীবাজারের একটি বাসায়। ফায়ার সার্ভিসের সহকারী উপ-পরিচালক আবদুল হালিম জানান,  বংশালে দুই ভবনের মাঝে চার ইঞ্চির মতো ফাঁকা ছিল। ভূমিকম্পের ফলে একটি অংশ পাশের ভবনে লেগে গেছে। তবে আমরা বড় কোনো ঝুঁকি দেখছি না। ঝুঁকির আশঙ্কা না থাকায় ওই ভবনের বাসিন্দারা এখনো অবস্থান করছেন। কুমিল­া প্রতিনিধি জানান, ভুমিকম্পে কুমিল­া নগরীর ঠাকুরপাড়ার মদিনা মসজিদ রোডের রৌশন ভিলা নামের চারতলা বাড়ির ডান দিক ডেবে গেছে। এর  ছাদের কার্নিশ পূর্ব দিকের একটি পাঁচতলা বাড়ির  সঙ্গে লেগে গেছে। রূপগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ভুমিকম্পে পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা তাড়াহুড়ো করে ভবন থেকে নামতে গিয়ে বহু শ্রমিক আহত হয়। এছাড়াও শক্তিশালী ভ‚মিকম্পে উপজেলার ভুলতা, মর্তুজাবাদ, মাহনা, তারাব, নোয়াপাড়া, মুড়াপাড়া এলাকার বেশ কয়েকটি ভবনে ফাঁটল দেখা দেয়। গফরগাঁও প্রতিনিধি জানান, পৌর এলাকাসহ উপজেলা বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন ও অসংখ্য দালান কোটায় ফাটল দেখা দিয়েছে।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, ভ‚মিকম্পে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাওল হলের সামনের অংশে ৪৮টি পিলারে বড় ধরণের ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। এরআগে ভূমিকম্পে বেশ কয়েকটি ফাটল ধরা পিলারে আবারো নতুন করে ফাটল ধরায় শিক্ষার্থীদের মাঝে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-বেরুনী হলের সম্প্রসারিত ভবনের বিভিন্ন অংশে অš—ত ৩৫-৪০টির মতো ফাটল দেখা দিয়েছে। সাভারে গ্যাসের পাইপ ফেটে বাইপাইল-আবদুল­াহপুর ও নবীনগর-কালিয়াকৈর মহাসড়কের বাইপাইল মোড়ে অগুন ধরে যায়।
এছাড়া ভুমিকম্প অনুভ‚ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে বরিশাল, গাইবান্ধা,  নাটোরের গুর“দাসপুর, ঠাকুরগাঁও। এসব এলাকা থেকে ক্ষয়ক্ষতির কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
মতামত: ভূমিকম্পের পর সকালে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, বড় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত ধর্মভীরু। এদেশে আল­াহর রহমত আছে।