মহেশখালীর আর্থ-সামাজিক প্রভাব

বঙ্গোপসাগরের গভীরতর স্থানের নিকটবর্তী হওয়ায় বৃহদাকার জাহাজের পোতাশ্রয় ও বন্দর নির্মাণের জন্য মহেশখালী একটি উপযুক্ত স্থান। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে জাতীয় ও স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের প্রস্তাব এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের। বিগত ২০০৮ সালের নির্বাচনে দেশের দুই বৃহত্ দলের নির্বাচনী ইশতাহারে এই সম্ভাবনা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দ্বীপের জনগণের মনে গভীর আশার সঞ্চার করেছিল। নির্বাচন পরবর্তি সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আভ্যন্তরীণ স্বার্থ জড়িত থাকায় বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় অগ্রগতি আশানুরূপ না হলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তা ও আগ্রহের কারণে এই প্রকল্প বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০১১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার স্বপ্ন বাস্তবায়নের স্বার্থে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত্ সরবরাহ নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি। এই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ প্রশংসার দাবি রাখে।

এই লক্ষ্যে সম্প্রতি মহেশখালীতে ১০০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য কয়লা ও তরলায়িত প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছে। এই বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছাড়াও প্রায় ১০০০০ একর কিংবা আরো বেশি ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে। একটিমাত্র উপজেলায় এতবড় আয়তনের ভূমি অধিগ্রহণ বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম। এটি সর্বজনবিদিত যে, বাংলাদেশের ভূমির অধিগ্রহণ আইন ১৯৮২ একমাত্র আইন যার মাধ্যমে সরকার জনস্বার্থে ভূমি অধিগ্রহণ করে থাকেন।

দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই আইনের আওতায় শুধু ভূমি রেকর্ডে উল্লেখিত জমির মালিকরাই ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকা পাওয়ার অধিকার রাখেন। ভূমি উপর নির্ভরশীল শ্রমিক কিংবা অন্যান্য স্বার্থ সংশ্লিষ্ট জনগণের ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিধান এই আইনে নেই। বর্তমানে ভূমি অধিগ্রহণের কারণে স্থানীয় জনগণের একটি বড় অংশ তাদের জমি ও জমির উপর নির্ভরশীল জীবিকা হারানোর ভয়ে আতংকগ্রস্ত। অধিকন্তু বিদ্যুত্ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাবৃন্দ অধিগ্রহণের ভূমিকে (Wasteland) বা পতিত জমি উল্লেখ করায় জনমনে আরো ক্ষোভের সঞ্চার করে। বিশেষ করে যে প্রক্রিয়ায় ভূমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে তাতে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ ন্যায়ভিত্তিক ক্ষতিপূরণ কিংবা জীবিকা পুনর্বাসন থেকে বঞ্চিত হবে।

মহেশখালী উপজেলার আয়তন প্রায় ১৪০ বর্গমাইল এবং জনসংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। এই দ্বীপের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ উঁচু পাহাড় বনাঞ্চল। বাংলাদেশের একমাত্র মহেশখালী দ্বীপেই পাহাড়ী বনাঞ্চল অবস্থিত। আবাদযোগ্য ভূমির দুই- তৃতীয়াংশ (প্রায় ১৩ হাজার একর) জমিতে বর্ষাকালে চিংড়ি চাষ ও শুষ্ক মৌসুমে লবণ উত্পাদন করা হয়। এটি দেশের লবণ উত্পাদনের ব্যবহূত মোট জমির এক-চতুর্থাংশ। কেবল শতকরা ১০-১৫% লবণ উত্পাদনকারী নিজ জমিতে লবণ উত্পাদন করেন। বাকি ৮৫-৯০ ভাগ উত্পাদনকারী অন্যের জমিতে লবণ উত্পাদন করে কিংবা পরিবহন ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজে শ্রমিক হিসাবে কাজ করে। এই হিসাবে প্রস্তাবিত ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় ৫০-৬০ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যার নির্ভরশীল জনসংখ্যা প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ। এছাড়াও দেশের লবণ উত্পাদন ১/৬ অংশ ও চিংড়ির জাতীয় উত্পাদনে বড় রকমের ঘাটতি দেখা দেবে। বর্তমানে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ভূমি অধিগ্রহণ আইনের আওতায় ক্ষতিপূরণ প্রদানের যে তালিকা প্রণয়ন করেছেন তাতে শুধু ১০-১৫% ভূমির মালিকরা কিছু নগদ অর্থ পেতে পারেন। ৮০-৮৫ ভাগ ভূমিহীন ক্ষতিগ্রস্ত লবণ উত্পাদনকারী কিংবা সংশ্লিষ্ট শ্রমিক তাদের কোনপ্রকার ক্ষতিপূরণ পাবেন না বা তাদের জীবিকা পুনর্বাসনের কোন সুযোগ পাবে না। এই প্রক্রিয়ায় মহেশখালী অধিবাসীদের একটি বৃহত্ অংশ তাদের জীবিকা অর্জনের উত্স হারিয়ে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্রে নিপতিত হবে। জীবিকা অর্জনের জন্য উদবাস্তু হয়ে তারা অন্যত্র যেতে বাধ্য হবে। তাছাড়াও অধিক হতাশায় অনেকে বর্তমানে মহেশখালী পাহাড়ে অবস্থিত অবৈধ অস্ত্র কারখানায় শ্রমিক হয়ে আরো ভয়ংকর সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

অনেকে মনে করে থাকেন, এই প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়িত হলে অনেক নতুন কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্রে প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনে মাত্র ১.১ জনের নতুন কর্মসংস্থান হয়। যার মধ্যে দক্ষ ও শিক্ষিতের সংখ্যাই বেশি। সেক্ষেত্রে প্রকল্পের কারণে কর্মচ্যুত অদক্ষ প্রায় ৫০ হাজার স্থানীয় শ্রমিকের কর্মসংস্থান এর সম্ভাবনা নেই।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রকার ভৌত কাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ অপরিহার্য। উন্নয়নশীল দেশে বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতের মত ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এই বিষয়টি অত্যন্ত জটিল এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ ভূমি অধিগ্রহণের ফলে শুধু আবাদী জমি নয় জমির উপরস্থিত ঘরবাড়ি ও জমির সাথে সম্পৃক্ত জীবিকা অর্জনের সুযোগও হারায়। অতিবৃহত্ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ন্যায়ভিত্তিক ক্ষতিপূরণ এবং জীবিকা পুনর্বাসন ও পরিবেশের ঝুঁকিসহ ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার বিষয়টি বিশ্বে উন্নয়ন সহযোগীদের মাঝে বহুল আলোচিত বিষয়।

বিভিন্ন দেশের ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ভূমি মালিক এবং সকল ক্ষতিগ্রস্ত শ্রেণির লোকজনকে ক্ষতিপূরণ বাবদ নগদ অর্থ সহায়তা ছাড়াও প্রকল্পের লভ্যাংশের মালিকানাসহ বিভিন্ন প্রকার পুনর্বাসন পরিকল্পনার বিধান প্রচলিত আছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সুস্পষ্ট নীতিমালা রয়েছে। এটা সর্বজনবিদিত যে, বাংলাদেশে ১৯৮২ সনের অধিগ্রহণ আইন অতি দুর্বল। এটি অসম্পূর্ণ এবং শাসনতন্ত্রে প্রদত্ত জীবন-জীবিকার অধিকারের পরিপন্থী। যার কারণে অতীতে দেশের বৃহত্ প্রকল্প যথা বঙ্গবন্ধু সেতু প্রকল্প, পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রচলিত ১৯৮২ সনের আইনের পরিবর্তে বিশেষ আইনের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদিও গৃহীত পদক্ষেপসমূহ সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের অধিগ্রহণ পূর্ববর্তী অবস্থা ফিরানো যায়নি, তবুও গৃহীত পদক্ষেপসমূহ মন্দের ভাল বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু মহেশখালীতে প্রস্তাবিত ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে এই ধরনের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ভূমির মালিক ছাড়া ভূমির উপর নির্ভরশীল ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিহীন শ্রমিক ও অন্য জনগোষ্ঠীকে কিভাবে ক্ষতিপূরণ দেয়া যাবে তারও কোন নির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে মহেশখালীর একটি বিরাট জনগোষ্ঠী সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা হারাবে।

জনগণের কল্যাণে ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে নির্বিচারে জমি অধিগ্রহণ বন্ধ করে একটি সমম্বিত জরিপের মাধ্যমে প্রস্তাবিত বিভিন্ন প্রকল্পের ক্রম পুঞ্জিভূত আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব নির্ণয় করে, ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায়ভিত্তিক ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন একান্ত জরুরি। অন্যথায় প্রস্তাবিত প্রকল্পসমূহের কারণে এই এলাকায় একটি মানবিক বিপর্যয় ঘটার আশংকা রয়েছে।