মহেশখালী-মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী একাধিক দেশ
কক্সবাজারের মহেশখালী ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া। আগ্রহ দেখাচ্ছে ভারতের বেসরকারি খাতের বড় কোম্পানি রিলায়েন্স। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষস্থানীয় একজন কর্মকর্তা বলেছেন, আগ্রহীদের তালিকায় দক্ষিণ কোরিয়াও যুক্ত হতে পারে।
মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, মহেশখালী-মাতারবাড়ীতে সরকারের প্রায় ১০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিনিয়োগকারী হিসেবে প্রথমেই আগ্রহ দেখায় জাপান। সরকার তখন নবগঠিত কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির প্রস্তাবিত এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে জাপানকে সহায়তার প্রস্তাব দেয়। বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে আলোচনায় জাপান সেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশাপাশি সে দেশের কাশিমো বন্দরের আদলে কয়লা আমদানির জন্য একটি বন্দর স্থাপন ও একটি রপ্তানিমুখী শিল্প এলাকা গড়ে তোলার প্রস্তাব দেয়।
সরকারও এতে সাড়া দেয়। এরপর প্রাথমিকভাবে মাতারবাড়ীতে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র, কয়লা আমদানির জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্র-সংলগ্ন একটি টার্মিনাল স্থাপন এবং এ জন্য প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ একটি নদী খননের সমন্বিত প্রকল্প নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ৩৬ হাজার কোটি টাকা (৪৮০ কোটি মার্কিন ডলার)। এর মধ্যে ৩৮০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে জাপান। এ প্রকল্পের জন্য কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির পক্ষে ১ হাজার ৪১৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে কয়লাভিত্তিক আরও তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
এরপর মাতারবাড়ীতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ দেখায় মালয়েশিয়া। তারপর সিঙ্গাপুর। এই দুই দেশের সঙ্গেই সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। সর্বশেষ গত ১৫ এপ্রিল সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে। এ দুটি দেশ স্বতন্ত্রভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করবে বলে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ও কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা জানান।
জানতে চাইলে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম লেন, মাতারবাড়ীতে প্রথম কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হতে পারে ২০২১ সালে। কয়লা আমদানির জন্য সেখানে যে বন্দর ও টার্মিনাল স্থাপন করা হচ্ছে তার মাধ্যমে ১০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহ করা যাবে।
মাতারবাড়ীর পাশাপাশি মহেশখালীতেও বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এ জন্য সেখানে পাঁচ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মহেশখালীতে আপাতত কোনো জমি কেনা-বেচা করা যাবে না বলে সরকার স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়েছে।
পিডিবির একটি বিদ্যুৎ প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ প্রায় চূড়ান্ত। এ ছাড়া জাপানের মিৎসুই, মালয়েশিয়ার আইএমবিডি এনার্জি গ্রুপসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি মহেশখালীতে বিনিয়োগের ব্যাপারে আলোচনা চালাচ্ছে পিডিবির সঙ্গে। ভারতের বেসরকারি কোম্পানি রিলায়েন্স মহেশখালীতে ৭৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এলএনজি-ভিত্তিক (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র করার প্রস্তাব দিয়েছে। পরে অবশ্য রিলায়েন্স মহেশখালীর পরিবর্তে মেঘনাঘাটে ওই একই ক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র করার আগ্রহ দেখায়। কিন্তু মেঘনাঘাটে তাদের গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে না বলে পেট্রোবাংলা জানিয়ে দিয়েছে। এরপর রিলায়েন্স আবার মহেশখালীর দিকেই মনোনিবেশ করে।
এ অবস্থায় সরকার মহেশখালী-মাতারবাড়ীতে পিডিবি ও কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির নির্ধারিত জায়গায় প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলো সমন্বিতভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব আবুল কালাম আজাদের তত্ত্বাবধানে এই সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলছে। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, এই সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্য হলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো স্থাপন, কয়লা আমদানির জন্য বন্দর প্রতিষ্ঠা, শিল্প এলাকা গড়ে তোলার কাজগুলো যেন এলোমেলোভাবে না হয়ে সুপরিকল্পিতভাবে সম্পন্ন হয়। আগ্রহী সব বিদেশি কোম্পানির বিনিয়োগ যেন সেখানে ব্যবহার করা যায়।
সমন্বিত পরিকল্পনার আরেকটি লক্ষ্য হলো, সেখানে স্থাপিত বন্দরের মাধ্যমেই যেন দেশের সব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহ করা যায় তেমন একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি। সরকারের একটি সূত্র জানায়, বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রেও প্রাথমিকভাবে কয়লা সরবরাহের জন্য মহেশখালী-মাতারবাড়ীর বন্দর ব্যবহার করা যায় কি না, তা সরকারের সক্রিয় ভাবনায় রয়েছে। পরে অবশ্য পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরকেও রামপালে কয়লা সরবরাহের জন্য ব্যবহার করা যাবে।
এদিকে সরকার এলএনজি আমদানির জন্য যে টার্মিনাল করার কার্যক্রম চালাচ্ছে তারও স্থান নির্ধারিত হয়ে আছে মহেশখালীতে। অবশ্য ওই এলএনজি আবার গ্যাসে রূপান্তর করে পাইপলাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রামের শিল্প-কারখানায় দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার।