যানজট-জলজটে অচল ঢাকা

চারদিকে পানি আর পানি। পিচঢালা পাকা রাস্তায় খালের ঢেউ। রিকশাগুলোই যেন ছোট ছোট নৌকা। রিকশার পা দানিতেও আছড়ে পড়ছে ঢেউয়ের পানি। অনিশ্চিত সময়ের মন ভার করা যানজটে বসে, এই দৃশ্যই দেখতে হয়েছে রাজধানিবাসীর। যান থেকে নামলে পানি অথবা ম্যানহোলে ডুবে মরার ভয়। আর সামনে অনিশ্চিত ট্রাফিক। যেন জলে কুমির, ডাঙায় জ্যাম। তাই ঝিম ধরে বসে থাকার বিকল্প ছিল না অনেকের হাতে।
ভোর থেকেই শুরু বৃষ্টি। সকালের দিকে পরিমাণ ছিল কম। ১২টার দিকে হঠাৎ শুরু হল ভারী বৃষ্টি। যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। কিন্তু বেশিক্ষণের না। অল্প সময়। সেই অল্প সময়েই ডুবে গেল রাস্তা। রাস্তা থেকে উঠে গেল ট্রাফিক। ফলে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে মুখোমুখি দাড়িয়ে গেল গাড়িগুলো। যেন পানির সমাবেশে যোগ দিতে এসেছে গাড়িগুলো। এজন্য কেউ কাউকে যেতে না দিয়ে নিজেরাই দাঁড়িয়ে পড়েছে। এ ঘটনা সেখানে যেখানে ট্র্যাফিক ছিল না। তবে যেখানে ট্র্যাফিক পুলিশ ছিল সেখানেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। যানজটে স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানীর বড় বড় সড়ক এমনকি অলিগলিও। স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী, বিকেলে অফিস ফেরত মানুয়ের ভোগান্তির শেষ ছিল না। ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় সময় পার করতে হয়েছে।
সকালে বের হবো, বৃষ্টির জন্য পারছিলাম না। অবশেষে মোটর সাইকেল রেখে রিকশায় প্রেসক্লাবের উদ্দেশ্য সাড়ে ১২টায় বের হই। রিকশায় ফার্মগেইট আসতে নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ের সামনে জ্যামে আটকা পড়লাম। প্রায় ঘন্টাখানেক বসে থেকে ৫৫ টাকা ভাড়া দিয়ে গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে জিয়ার মাজারের মোড়ে এসে ২০০ টাকায় সিএনজি নিলাম প্রেসক্লাব পর্যন্ত। সিএনজি খামারবাড়ি মোড়ে আবার জ্যামে আটকা পড়ল সিগন্যালে। সেখানে প্রায় পৌনে তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে অবশেষে সিএনজি ছেড়ে হেঁটে ফার্মগেট মোড় পার হলাম। প্রেসক্লাব আর যাওয়া হল না।এই অভিজ্ঞতার কথা ফেসবুকে লিখেছেন একজন ভূক্তভোগী। মিরপুরের বাসিন্দা নাজনিন রহমান জানান, মিরপুর থেকে আসাদগেটের কাছের একটি স্কুলে আসতে তার প্রায় চার ঘণ্টা সময় লেগেছে। একই রকম ঘটনার বর্ননা দেন আতিকুর রহমান। দুপুর ১২টা। তার অফিস পল্টনে। ছেলের স্কুল ছুটি দুপুর ১টায়। অফিস থেকে বের হয়েই পানি। পানির মধ্যে কোনো যানবাহনও নাই। শেষ পর্যন্ত দ্বিগুণ ভাড়ায় তিনি রিকশা ঠিক করেন। ইস্কাটনে ছেলের স্কুলে পৌঁছান দুপুর দেড়টায়। আর বাসায় ফেরেন বেলা সাড়ে তিনটায়। এরইমধ্যে তাকে রিকশা ভাড়া গুনতে হয় ২০০ টাক। দৈনিক বাংলা থেকে খিলগাও আসতে পৌনে দুই ঘন্টা সময় লেগেছে আসিকের। তিনি জানান, মোটরসাইকেল করে আসতে ১০ মিনিট সময় লাগে। সেখানে পৌনে দুই ঘন্টা যানজটে বসেছিলাম। গুলজার বেগম শান্তিনগর থেকে সকাল আটটায় রওনা দিয়ে বেলা ১১টায় মিরপুরে অবস্থিত ডেলটা হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছান। চিকিৎসাশেষে তিনি দুপুর একটায় বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য তিনি বাসায় পৌছান বিকেল সাড়ে ৪টায়। রোজিনা ইসলাম ফেসবুকে লিখেছেন, মেয়র যাবেন, প্রশাসক আসবেন। প্রশাসক যাবেন, মেয়ার আসবেন। বর্তমানে ঢাকায় দুইজন মেয়র। কিন্তু রাজধানীর চিত্র বদলাবে না। জল আ জটে আমরা এভাবেই অচল হয়ে থাকবো। আর শুনে যাবে দিন বদলানোর কথা। এভাবে আর কতদিন? এক জায়গায় তিনঘন্টা ধরে বসে আছি। আমাদের সময়েরও দাম নেই, জীবনের নয়।
যানজট আর জলযটে নগরবাসীর অবস্থা ছিল এমনই। কেউ কেউ এক থেকে দুই ঘন্টা, কেউ কেউ আবার চার থেকে পাঁচ ঘন্টাও রাস্তায় যানজটে বসেছিলেন গতকাল।
গতকাল ঢাকার রাস্তায় বের হয়েই নগরবাসীর মনে হয়েছে এটা কি রাস্তা না নদী। অন্যদিকে দুপরের পর যানবাহন কমে যাওয়ার কারণে চরম ভোগান্তির শিকার হয় সবাই। পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন সড়ক, কাকরাইল, মৎস্য ভবন মোড়, শান্তিনগর, মিন্টো রোড, মগবাজার, রামপুরা শাহবাগ চত্বর, সায়েন্সল্যাব, বাংলা মোটর, ফার্মগেইট, মহাখালী, মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা ও উত্তরার পথে যানবাহন প্রায় থমকে যায়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনের সড়ক, সংসদ ভবনের দক্ষিণের প্রবেশ মুখ, মানিক মিয়া এভিনিউসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সড়কে হাটু সমান পানি জমে গেছে। অন্যদিকে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর, মিরপুরের কালশি, ১০ নম্বর থেকে শেওরাপাড়া, নয়াপল্টন, শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, রাজারবাগ এলাকা জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। রায়ের বাজার থেকে মহাখালী আসার পথে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর সড়কের মাঝামাঝি থেকে মিরপুর রোডের সংযোগস্থল পর্যন্ত রাস্তায় (রাপা প্লাজার সামনে) কোমর পানি পানি জমে যায়। ফার্মগেইট থেকে সার্ক ফোয়ারা পর্যন্ত সড়কটির দুই পাশে হাঁটুপানি দেখা গেছে। কোথাও কোথাও সিএনজিচালিত যানবাহন বন্ধ হয়ে যায় এতে যানজট আরো বেড়ে যায়।
ধানমন্ডির শংকর, জাফরাবাদ, কালিমন্দির, রাজারবাগ খেলার মাঠের পাশের এলাকা, ১৫ নম্বরসহ এই এলাকার কোন কোন জায়গায় হাটু থেকে কোমড় পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে যায়। হঠাৎ করে জমে যাওয়া পানিতে অবর্ননিয় দূর্ভোগে পড়ে স্কুল-কলেজ ফেরত শিক্ষার্থীরা। কোন কোন এলাকায় ভ্যানে করে পানি পারাপার করতে দেখা গেছে। আবার কেউ কেউ অগত্যা ময়লা পানি হেটেই পার হয়েছেন।
ডিএনসিসি ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবু তাহের খান মানবকণ্ঠকে জানান, ড্রেন দিয়ে পানি অপসারিত না হওয়া এবং এলাকায় অল্প বৃষ্টিতেই পানি জমে যাওয়া নিয়ে এলাকাবাসী আগে থেকেই অভিযোগ করেছেন। আমি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র মেয়রের দপ্তরে প্রেরণ করেছি। সদ্য নির্বাচিত মেয়র আমাদেরকে আশ্বাষ দিয়েছেন। আশা করছি কিছুদিনের মধ্যেই পানি অপসারনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারব।
পুলিশের ট্রাফিক কন্ট্রোল রুম থেকে বলা হয়, বৃষ্টির কারণে রাজধানী জুড়ে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে মহাখালী, বিজয় সরণি, মোহম্মদপুরের নুরজাহান রোড ও এর আশেপাশের এলাকা, মিন্টো রোড বাংলামোটর, ফার্মগেইট, শাহবাগ, মগবাজার এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সমস্যা হচ্ছে।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, টানা বর্ষণ ও সামুদ্রিক জোয়ারে বন্দর নগরীর পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ, চাকতাইসহ নিম্মাঞ্চল হাটু থেকে বুক পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে কয়েক শ’ কোটি টাকার নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। চরম দুর্ভোগে পানি বন্দি হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। বন্ধ রয়েছে স্কুল-কলেজ, দোকানপাট ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। পানিতে পড়ে থাকা বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে চকবাজার মিয়া মুন্সী লেইনে নুরুনাহার (২০) নামে এক পোশাক শ্রমিক কর্মস্থলে যাওয়ার পথে বিদ্যুাৎতায়িত হয়েছে মারা গেছেন। মঙ্গলবার রাত থেকে চট্টগ্রামে বিরতিহীন বৃষ্টি শুরু হয়। নগরীর বেশীর ভাগ সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে যানচলাচল।  মোড়ে মোড়ে সৃষ্টি হয়েছে যানজট। জমে থাকা পানি  ও বৃষ্টিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে দাঁড়িয়েও গাড়ির দেখা পায়নি সাধারণ মানুষ।
সিলেট ব্যুরো জানায়, গত দু’দিন বিরামহীন বৃষ্টি ছিল সিলেটে। এই বৃষ্টির বিড়ম্বনায় চরম ভোগান্তিতে পড়েন সিলেটবাসী। গতকাল মঙ্গলবার বছরের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে সিলেটে। গত সোমবার সকাল ৬টা থেকে গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ৩০৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। টানা বৃষ্টিতে সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর ও কানাইঘাট উপজেলার নিুাঞ্চল প¬াবিত হয়েছে। এছাড়া সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্টে বিপদ সীমার ৪৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রাজধানীতে ৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। এই সময়ে গতকাল দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে টেকনাফে ১৪১ মিলিমিটার। এছাড়া চট্টগ্রামে ৭৮, সিলেটে ১০২ এবং রাজশাহীতে ২৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। অদ্ভুত হলেও সত্যি এই অল্প বৃষ্টিতেই ঢাকা প্রায় ডুবতে বসেছে। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর সুয়ারেজ লাইনের অব্যবস্থাপনা এবং ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দূর্বল হওয়ার কারণেই অল্প বৃষ্টিতেই ঢাকা তলিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় বর্ষকালেই সড়ক নির্মাণ, সড়ক মেরামতের কাজ করায় বৃষ্টি হলেই কাদা পানিতে একাকার ঢাকাবাসী।
আবহাওয়াবিদরা জানান, ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি এসেও মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় দেশের সর্বত্র মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের এক সতর্কবাতায় বলা হয়, গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৪টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘন্টার মধ্যে, ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে। এই বৃষ্টিও কারণে চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধ্বসেরও আশংকা রয়েছে। অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে বলা হয়, বুধবারও এই ভারী বৃষ্টি হওয়া সম্ভাবনা রয়েছে। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে রাজশাহী, রংপুর, খুলনা বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ মাঝারি ধরণের বৃষ্টি হতে পারে। একই সঙ্গে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেট বিভারে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে।
ঝড়ো হাওয়ার শঙ্কায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে অধিদপ্তর। এছাড়া উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারগুলোকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।