রান্নার গ্যাসের তিন রকম দাম: বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ নেই

সবুজ ইউনুস:

ধরুন, আপনার বাসা রাজধানী ঢাকার কোনো একটি এলাকায়। আপনার বাসায় আগে থেকেই পাইপলাইন গ্যাস সংযোগ আছে। বর্তমানে ডাবল চুলা ব্যবহার করে মাসে গ্যাসের বিল দেন ৯৭৫ টাকা। আপনি একজন পোষ্টপেইড গ্রাহক। আপনি যদি একজন প্রিপেইড গ্রাহক হন; অর্থাৎ মোবাইল রিচার্জের মত কার্ডে টাকা ভোরে গ্যাস ব্যবহার করেন। তবে সারা মাস ইচ্ছে মত রান্না করেও ৫০০ টাকার কম খরচ হয়। আবার আপনার ছাদের উপরে নতুন ফ্লাট, যেখানে আগে থেকে কোন গ্যাস সংযোগ ছিল না। এমন বাড়ি হলে সেখানে যারা বসবাস করছেন, তারা পাইপলাইন গ্যাসের সুবিধা পাচ্ছেন না। ফলে তাদের রান্নার জন্য সিলিন্ডার গ্যাসের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। আর এজন্য মাসে খরচ করতে হচ্ছে কমপক্ষে তিন হাজার টাকা।
একই সেবা নিতে একই শহরে থেকে তিনজন তিন রকম খরচ করছেন। আর এই তিনজনই তিন রকম খরচ করছেন ইচ্ছে করে নয়, বাধ্য হয়ে।যার বাড়িতে পাইপের গ্যাস আছে তিনি তো তা ব্যবহার করছেনই। ইচ্ছে করলেই তিনি প্রিপেইড মিটার নিতে পারবেন না। কারণ সব এলাকায় এটা যায়নি। পাইপ গ্যাস থাকলেও নির্ধারিত এলাকায় বসবাস না করায় মিটার লাগানোর সৌভাগ্য তার নেই। আর নতুন ভবন হলে যে সিলিন্ডারের বিকল্প নেই তা সবার জানা। ফলে ইচ্ছে পোষণের সুযোগ নেই। বাধ্য হয়ে বৈষম্যের শিকার।
একই মহল্লায় পাশাপাশি বসবাস করে কেউ সস্তা গ্যাস দিয়ে রান্নাবান্না করছেন। আবার কেউ কেউ বেসরকারি উচ্চ মূল্যের গ্যাস ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন।
এখন প্রশ্ন- কেন এই বৈষম্য। অথচ মাটির নিচের এই প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সব জনগণের সমান অধিকার।
এ জন্য রাজধানী ঢাকাসহ গ্যাস নেটওয়ার্কিং এলাকাগুলোতে জনমনে বেশ ক্ষোভ আছে। এটা দূর করা জরুরি।
আর এই তিন গ্রাহকের জন্যই দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। তাদের এই সব দামের মধ্যে সমন্বয় করার উদ্যোগ একনও চোখে পড়েনি।
গ্রাহকদের আরও একটা নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের কথা বলি। রাজধানী ঢাকায় গ্যাসের চাপ নিত্যদিনের সমস্যা। বিশেষ করে শীতকালে গ্যাসের চাপ ব্যাপকভাবে কমে যায়। বহু বাড়িতে চুলা জ্বলেই না। ঢাকা শহরে অপরিকল্পিতভাবে আবাসন গড়ে উঠেছে। অলিগলির ভেতরে বহুস্থানে গ্যাস সরবরাহের পাইপলাইন অত্যন্ত চিকন। সেখানে অধিকাংশ সময় গ্যাসের চাপ থাকে না। ঢাকায় এ রকম শত শত বাসা আছে, যেখানে সারাবছর গ্যাসের সংকট বিদ্যমান। এদের দুর্ভোগ সীমাহীন। কারণ পাইপলাইন সংযোগ থাকার কারণে গ্যাস না পেয়েও তাদের প্রতি মাসে বিল গুনতে হয়। আবার বাজার থেকে সিলিন্ডার গ্যাস কিনে রান্নাবান্নার কাজ সারতে হয়। গ্রাহকদের জন্য এ একটা বাড়তি আর্থিক চাপ, যা মেনে নেওয়া কঠিন।

একই সেবা নিতে একই শহরে থেকে তিনজন তিন রকম খরচ করছেন। আর এই তিনজনই তিন রকম খরচ করছেন ইচ্ছে করে নয়, বাধ্য হয়ে।যার বাড়িতে পাইপের গ্যাস আছে তিনি তো তা ব্যবহার করছেনই। ইচ্ছে করলেই তিনি প্রিপেইড মিটার নিতে পারবেন না। কারণ সব এলাকায় এটা যায়নি। পাইপ গ্যাস থাকলেও নির্ধারিত এলাকায় বসবাস না করায় মিটার লাগানোর সৌভাগ্য তার নেই। আর নতুন ভবন হলে যে সিলিন্ডারের বিকল্প নেই তা সবার জানা। ফলে ইচ্ছে পোষণের সুযোগ নেই। বাধ্য হয়ে বৈষম্যের শিকার।

জ্বালানি খাত নিয়ে লেখালেখি করছি ২৫ বছরের বেশি। অন্তত ২০ বছর ধরে শুনে আসছি, বাসাবাড়িতে গ্যাসের প্রচুর অপচয় হয়। আমলারা বলে আসছেন, গ্রাহকরা শীতকালে সারাদিন চুলা জ্বালিয়ে রাখেন। অনেকে দিয়াশলাইয়ের একটি কাঠি বাঁচানোর জন্য গ্যাসের চুলা নেভান না। এভাবে গ্যাসের অপচয় হয়। একই সঙ্গে তারা বারবার বলে আসছেন, এই অপচয় বন্ধ করতে প্রতিটি বাড়িতে প্রিপেইড মিটার লাগিয়ে দিতে হবে। দিতে হবে প্রিপেইড কার্ড। কার্ডে টাকা ভরার পর গ্যাস খরচ করতে হবে। তখন সবাই গ্যাস ব্যবহারে সাশ্রয়ী হবেন। কিন্তু গত ২৫ বছরে ১০ ভাগ বাসাবাড়িতেও প্রিপেইড মিটার চালু করা সম্ভব হয়নি। কেন এই প্রিপেইড মিটার সব গ্রাহককে দেওয়া গেল না- তার কোনো সদুত্তর নেই। সরকারি ৪৩ লাখ আবাসিক গ্রাহকের মধ্যে মাত্র ৩ লাখ ৭৯ হাজার প্রিপেইড মিটার সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে।
সিলিন্ডার বা এলপিজির গ্রাহক ৪০ লাখ। ৯৯ শতাংশ এলপিজি বেসরকারি খাতে আমদানির পর সিলিন্ডারে ভরে বিক্রি করা হয়। বর্তমানে এলপিজি আমদানি করে থাকে দেশীয় ১৯-২০টি কোম্পানি। এ খাতে লাইসেন্স দেওয়া আছে ৪২টি। বড় কোম্পানির মধ্যে আছে ওমেরা, বসুন্ধরা ক্লিনহিট, যমুনা, বেক্সিমকো ইত্যাদি। এসব কোম্পানিই সারাদেশে সিলিন্ডার গ্যাস সরবরাহ করে থাকে। খুবই সামান্য পরিমাণ এলপিজি দেশে উৎপাদিত হয়। দেশীয় কয়েকটি গ্যাসফিল্ড থেকে গ্যাসের সঙ্গে সামান্য পরিমাণ কনডেনসেট পাওয়া যায়। এই কনডেনসেট চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধন করে বেশ কয়েকটি বাই প্রডাক্ট পাওয়া যায়। এর মধ্যে ২০ হাজার টন এলপিজি উৎপাদন করা হয়। এই এলপিজি সিলিন্ডারে ভরে সরকারি একটি কোম্পানির মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়। তবে এটা দেশে ব্যবহূত মোট এলপিজির মাত্র ২ শতাংশ।
সারাদেশে চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী বিভাগসহ বিভিন্ন জেলায় পাইপলাইনের মাধ্যমে বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। বরিশাল ও খুলনা বিভাগের জেলাগুলোতে সরকারিভাবে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস দেওয়া হয় না। এখানে পাইপলাইন নেটওয়ার্কও সম্পন্ন হয়নি। যেসব জেলায় নেটওয়ার্ক আছে, সেসব এলাকায়ও সব বাসাবাড়িতে গ্যাস দেওয়া হয় না।
পৃথিবীর অনেক শহরেই পাইপলাইনের মাধ্যমে বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ করা হয় না। পাইপের মাধ্যমে গ্যাস দেওয়া হয় মূলত শিল্প কারখানায়। অনেক দেশে বিদ্যুতে অথবা সিলিন্ডার গ্যাসেই রান্না করা হয় বেশি। আমাদের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগও সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারে সবাইকে উৎসাহিত করতে চায়।
কিন্তু এলপি গ্যাসের মূল্য যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে গ্রাহকদের নিরুৎসাহিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। শুধু এর মূল্য নয় নিরাপত্তাও শঙ্কীত করে রেখেছে অনেককে। অনেকের কাছে সিলিন্ডার মানে আতঙ্ক। ভয়। এজন্য পাগলের মত পাইপের গ্যাসের দিকে ঝোঁক।
এজন্য যেভাবেই হোক এই সব গ্যাসের দামের মধ্যে একটা সমন্বয় করতে হবে। এই ব্যাপক বৈষম্য দূর করতে সরকারকে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে।
আজকের আলোচনা শুধু শহর কেন্দ্রীক। গ্রামে জ্বালানি ব্যবহারে বৈষম্য আরও বেশি। অন্য সময়সে বিষয়ে আলোচনার জন্য থাকল।

সবুজ ইউনুস

সবুজ ইউনুস
সহযোগী সম্পাদক ও অনলাইন ইনচার্জ, সমকাল