রান্নার গ্যাসের সমাধান এলপিজি
ষাটের দশকের শেষে বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণ তেলনির্ভর ছিল। গ্যাসের বিশেষ কোনো বাণিজ্যিক মূল্য ছিল না। এর বাণিজ্যিক ব্যবহার বাড়ানোর জন্য তিতাস সঞ্চালন এবং বিতরণ কোম্পানি প্রথমে সরকারি বরাদ্দকৃত বাড়িঘরে, পরে ব্যক্তিমালিকানায় রান্নার জন্য পাইপড ন্যাচারাল গ্যাস (পিএনজি) সরবরাহ শুরু করে। ইতিমধ্যে গ্যাস একটি অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক জ্বালানি হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়। দেশে প্রায় ২০ লাখ গৃহস্থালি গ্রাহক আছেন। পাঁচজনের গড় পরিবার সদস্য হিসাবে প্রায় এক কোটি জনগণ পাইপলাইনের মাধ্যমে রান্নার জন্য গ্যাসের সুবিধা পাচ্ছে, যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৭ শতাংশ। গ্যাস একটি জাতীয় সম্পদ হওয়া সত্ত্বেও ৯৩ শতাংশ জনগোষ্ঠী এর সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এটি সমতা ও ন্যায্যতার পরিপন্থী এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
গ্যাসের অর্থনীতি মূল্য ও বিকল্প জ্বালানি
যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবস্থাটি গড়ে উঠেছে, এটাকে রাতারাতি বদলে দেওয়া যাবে না, কিন্তু বর্তমানের দুই চুলার জন্য ৪৫০ টাকায় বলতে গেলে বিনা পয়সায় সবচেয়ে সম্পদশালী জনগোষ্ঠীকে (শহরের) গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এর থেকে উত্তরণের জন্য সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে ধীরে ধীরে এর দাম বাজারমূল্যের কাছে নিয়ে যাওয়া। ভারতে সরবরাহকৃত পিএনজি প্রতি ঘনমিটার দাম ধরলে (৪০ টাকা/৬০ টাকা) বর্তমানে বাংলাদেশের দুই চুলার মাসিক হিসাবের ভিত্তি ৮৮ ঘনমিটারের দাম আসে চার হাজার টাকা, অর্থাৎ বর্তমান দামের প্রায় ১০ গুণ। পাকিস্তানেও এর মূল্য আসে মাসিক তিন হাজার টাকা। আমদানিকৃত তরলীকৃত গ্যাস (এলএনজি) দিয়ে বর্তমানের দুই চুলার গ্যাস সরবরাহ দিতে গেলে শুধু গ্যাসের দাম আসবে ৩৭৩০ (প্রতি হাজার কিউবিক ফিট ১৫ ডলার দরে) থেকে ৪৯৭১ টাকা (প্রতি হাজার কিউবিক ফিট ২০ ডলার দরে)। মিটার ব্যবস্থার মাধ্যমে অবশ্য গ্রাহকেরা এই মূল্য তাদের ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারে।
গ্যাসের সমতুল্য রান্নার জ্বালানি হচ্ছে এলপিজি। বর্তমানে ১২ দশমিক ৮ কেজি একটি বোতল এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকায় বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে। পাঁচজনের একটি পরিবার মাসে ১ দশমিক ৫ থেকে ২ দশমিক শূন্যটি বোতল ব্যবহার করে শুধু রান্নার জন্য। অর্থাৎ পাইপ গ্যাসবঞ্চিত বিপুল জনগোষ্ঠী যদি গ্যাসের সুবিধা পেতে চায়, তাহলে তাদের মাসে দুই থেকে তিন হাজার টাকা খরচ করতে হয়।
পাইপ গ্যাস সরবরাহের সীমাবদ্ধতা
এটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে সবাইকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করা অসম্ভব। গ্যাস সরবরাহের স্বল্পতা, সঞ্চালন ও বিতরণ পাইপলাইন স্থাপনে বিপুল ব্যয় এবং গৃহস্থালির চেয়ে শিল্প/বিদ্যুতে গ্যাসের অর্থনৈতিক লাভ কয়েক শ গুণ বিধায় অবিলম্বে সব ধরনের গৃহস্থালি গ্যাসের সংযোজন ও সম্প্রসারণ বন্ধ করা প্রয়োজন। বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিচে উল্লেখ করছি।
১) দেশের বর্তমান গ্যাস মজুত ১০-১২ টিসিএফ। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে বর্তমান ব্যবহারের হারে আগামী এক দশকের মধ্যেই গ্যাস সরবরাহ সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে যাবে। এই অবস্থায় নতুন করে বাড়িতে বাড়িতে গ্যাস-সংযোগের প্রশ্নই ওঠে না বরং রান্নার গ্যাসের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ দ্রুততম সময়ে করা প্রয়োজন।
২) প্রতি কিলোমিটার-ইঞ্চি সঞ্চালন লাইনের জন্য বাংলাদেশে জমি অধিগ্রহণসহ খরচ পড়ে শূন্য দশমিক ৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ একটি ১০৴৴ ব্যাসের ৪০ কিলোমিটার লাইনের জন্য খরচ পড়ে ২০০ কোটি টাকা। বিতরণ লাইনের জন্য প্রতি কিলোমিটার সাত লাখ (১৴৴) থেকে এক কোটি (১২৴৴) টাকা খরচ হয়। ৪০ কিমি সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে ৪০ হাজার বাড়িতে গ্যাস সংযোজন দিতে গেলে রাইজার ও মিটারিং স্টেশন নির্মাণসহ খরচ পড়বে প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা। ৪০ হাজার বাড়ি থেকে মাসিক ৪৫০ টাকায় বছরে মোট রাজস্ব আসবে ২১ কোটি টাকা। ১০ শতাংশ করে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার বাৎসরিক ব্যাংক সুদই আসবে ৩৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ কোনো অবস্থাতেই নতুন সংযোগ লাভজনক নয়।
৩) ১ গিগা ওয়াট আওয়ার বিদ্যুৎ শিল্প খাতে ব্যবহারে ৬ দশমিক ৪ কোটি টাকা জিডিপিতে যোগ হয়। এই হিসাবে এক হাজার মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র সারা বছর চললে জিডিপিতে শিল্প খাতে বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলার (৪০ হাজার কোটি টাকা) যুক্ত হয়। বর্তমানে গৃহস্থালি খাতে ব্যবহৃত গ্যাস দিয়ে অন্তত দুই হাজার মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু জনগণকে বিকল্প ব্যবস্থা না দিলে গৃহস্থালির রান্নার জন্য চরম ভোগান্তি পোহাতে হবে।
এলপিজির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান
এলপিজি বোতলে ভর্তুকি দেওয়ার মাধ্যমে দেশের গ্যাসসম্পদের সীমিত ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে যথার্থ অর্থনৈতিক মূল্য নিয়ে এলপিজি ব্যবহারকারীদের মধ্যে বিতরণ করলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এর সুবিধা ভোগ করতে পারবে। প্রথম ধাপেই ৪৫০ টাকার দুই চুলার জন্য ট্যারিফ এক হাজার টাকায় বৃদ্ধি করে প্রতিটি এলপিজি সিলিন্ডারে ৫০০ টাকা হারে মাসে ২০ লাখ বোতলে এই ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব। এতে সরকার গ্যাসের সুবিধা সুষম বণ্টনে একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ভারতে প্রতিটি রেজিস্টার্ড ব্যবহারকারী পরিবার ভর্তুকিসহ বছরে ১২টি এলপিজি বোতল কিনতে পারে। বর্তমানে ভারতে ১৪ দশমিক ২ কেজির একটি বোতলের বাজারমূল্য এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ রুপি। আন্তর্জাতিক দামের ওপর নির্ভর করে প্রতি বোতলে সরকারি ভর্তুকির পরিমাণ ৪৫০ থেকে ৭০০ রুপি। এটি বাংলাদেশি টাকায় ৮০০ টাকা। থাইল্যান্ডে রান্নার জন্য বিক্রীত এলপিজির দাম ১৯ বাথ/কেজি অর্থাৎ টাকা ৫০/কেজি। ১২ দশমিক ৮ কেজি বোতলের দাম বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ৬৪০ টাকা। থাইল্যান্ড সরকারও রান্নার এলপিজিতে বড় ধরনের ভর্তুকি দিয়ে থাকে। এখানে সরকারি ভর্তুকি এক হাজার টাকা। বাংলাদেশ শুরুতে ৫০ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি বোতলে ৮০০ টাকা ভর্তুকি দিয়ে শুরু করতে পারে। পরবর্তী সময়ে পিএনজির (বাসায় পাইপের মাধ্যমে রান্নার গ্যাস) দাম ধীরে ধীরে আরও বাড়িয়ে বাণিজ্যিক দামের কাছে নিয়ে গেলে, এলপিজির ভর্তুকি ক্রমান্বয়ে উঠিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
যেসব দেশে অনেক আগে গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে এবং গ্যাসের বাণিজ্যিক দাম না থাকায় (১৯৭৩ সালের আগে) সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই পাইপড ন্যাচারাল গ্যাস (পিএনজি) সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এগুলোকে লিগ্যাসি কানেকশন বলা হয়। কিন্তু এর বাইরে বলতে গেলে সব দেশেই রান্নার জন্য এলপিজি ব্যবহৃত হয়।
কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, সৌদি আরবসহ উন্নত বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই রান্নার জন্য এলপিজি ব্যবহৃত হয়। নানাভাবে ব্যবহারের সুযোগ থাকায় এটি একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় জ্বালানি। বর্তমানে বাংলাদেশে বছরে ১০০ হাজার টন এলপিজি ব্যবহৃত হয়। সঠিক সরকারি পরিকল্পনা, নীতিমালা ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে এর ব্যবহার আগামী পাঁচ বছরে ৩০০ হাজার টনে উন্নীত হবে। এলপিজি ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকার পাইপলাইন সংযোগের রাজনৈতিক চাপমুক্ত থাকতে পারবে এবং গৃহস্থালি গ্যাস থেকে সঠিক অর্থনৈতিক ভাড়া আদায় করে এলপিজি বোতলে ভর্তুকি দিয়ে তা গ্যাসের সুবিধা সব জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিতে পারবে।
ম. তামিম: অধ্যাপক, পেট্রোলিয়াম প্রকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী।