রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত মাহদী
অরুণ কর্মকার:
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে তা জাতির স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নও এখন দৃশ্যমান।এর পরের ধাপই হচ্ছে স্বপ্নের এই বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা করা। সেই গুরুদায়িত্ব নিতে প্রস্তুত আলী মাহদী।
রাশিয়া থেকে নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিশেষায়িত উচ্চতর শিক্ষা সম্পন্ন করে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন মাহদী এবং তাঁর আরও ৪ সহপাঠী। তাঁরা প্রত্যেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্ব নিতে আগ্রহী বলে জানান মাহদী। ১৬ই মার্চ ঢাকায় তাঁর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
মাহদী বলেন, ‘জাতির পিতা যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে জাতির স্বপ্নে পরিণত করেছেন। আমরা যখন সেই প্রকল্পের পুরো দায়িত্ব নিতে পারব তখনই জাতির পিতার উদ্যোগ, সেই উদ্যোগ বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেপ এবং জাতির স্বপ্ন পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হবে বলে বিশ্বাস করি। সেই দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আমি এবং আমার সহপাঠীরা প্রস্তুত।’
চাপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলায় মাহদীর বাড়ি। সেখানকার বংপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করার পর ভর্তি হন ঢাকার নটরডেম কলেজে। সেখান থেকে ২০১৪ সালে এইচএসসি পাস করার পর ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট), নেভাল আর্কিটেকচারে। তবে তাঁর মনের গহীন কোনে নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটা পাকা জায়গা ছিল। কিন্তু তখন পর্যন্ত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই বিষয় পড়নো হত না।
২০১৪ সালেই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ খোলা হয়। সেই খবর পেয়ে বুয়েট ছেড়ে মাহদী এসে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। সেখানে পড়াশুনা শুরু করতে না করতেই চলে আসে রাশিয়ায় পড়তে যাওয়ার সুযোগ। পরমাণু শক্তি কমিশন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বিশেষায়িত জনবল তৈরির জন্য বৃত্তি দিয়ে রাশিয়ায় নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পাঠানোর জন্য শিক্ষার্থী খুঁজছিল। মাহদী সেখানে সুযোগ পেয়ে যান। ওই বছরই চলে যান রাশিয়ায়।
বাংলাদেশ থেকে মোট ১০ জন শিক্ষার্থী পাঠানো হয় নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিশেষায়িত বিষয়ে পড়ার জন্য। কিন্তু মূল কোর্স করতে পেরেছেন ৫ জন। অন্য ৫ জন টিকতে পারেননি। ঝরে পড়েছেন। উল্লেখ্য, বিশেষায়িত কোর্সের বাইরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে (নিউক্লিয়ার ফিজিক্স প্রভৃতি) পড়ার জন্য গত কয়েক বছরে প্রায় ৮০ জন শিক্ষার্থী রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছে। এরা সবাই বাংলাদেশ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে রাশিয়ায় গেছেন স্নাতকোত্তর ডিগি’র জন্য। এরাও সবাই দেশে ফিরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ করবেন। সেই লক্ষ্যেই তাঁদের পাঠানো হয়েছে।
রাশিয়ায় শিক্ষাগ্রহণ প্রসঙ্গে মাহদী বলেন, তাঁরা পড়াশুনা করেছেন রাশিয়ার ন্যাশনাল রিসার্চ নিউক্লিয়ার ইন্স্টিটিউটে। এছাড়া, হাতে-কলমে ব্যবহারিক শিক্ষার জন্য বিভিন্ন সময় তাঁদের নেওয়া হয়েছে অবনিস্ক এবং রোস্তভ অন ডন শহরের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এরমধ্যে অবনিস্কের কেন্দ্রটি গ্রিডে সংযুক্ত পৃথিবীর প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০০২ সালে সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তারপর থেকে সেটি বিশেষায়িত শিক্ষার জন্য ব্যবহারিক কাজে লাগানো হচ্ছে।
মাহদী বলেন, রাশিয়ায় তাঁরা এক বছরের প্রিপারেটরি কোর্স এবং সাড়ে ৫ বছরের ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স সম্পন্ন করেছ্নে। প্রিপারেটরি কোর্সে মূলতঃ রুশ ভাষা শিখানো হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সের মূল বিষয় ছিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা। সেই কারণে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের রিঅ্যাক্টর, টারবাইন, জেনারেটরসহ সব ধরণের যন্ত্রপাতির নকশা প্রণয়ন করতে হয়েছে। তারপর সেই সব যন্ত্রপাতির পরিচালনার বিষয় শিখানো হয়েছে। ফলে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতিটি যন্ত্রপাতির নির্মাণ ও ব্যবহার সম্পর্কে তাঁরা সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছেন।
মাহদী যে ব্যাচে পড়াশুনা করেছেন সেখানে ৪ দেশের (রাশিয়া, ভিয়েতনাম, তুরস্ক ও বাংলাদেশ) ৩৪ জন শিক্ষার্থী ছিলেন। এদের মধ্যে মাহদী প্রথম স্থান অধিকার করেছেন।
এখন তাঁর স্বপ্ন কি জানতে চাইলে মাহদী বলেন, তিনি ও তাঁর সহপাঠীরা স্বপ্ন দেখেন যে, বাংলাদেশ সরকার তথা পরমাণু শক্তি কমিশন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চূড়ান্তভাবে নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর তাঁরাই এটি পরিচালনার পূর্ণ দায়িত্ব নেবেন। পাশাপাশি তাঁরা কিছু ‘কম গুরুত্বপূর্ণ’ যন্ত্রপাতির নকশা প্রণয়নের কাজও শুরু করতে পারে। দেশে দ্বিতীয় যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপনের ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিয়েছেন সেটির জন্য কিছু মৌলিক কাজও তাঁরা করতে পারবেন বলে আত্মবিশ্বাসী তাঁরা।
অবশ্য একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশ সরকার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণে রুশ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেই তাঁদের কাজ শুরু করতে হবে। সেজন্যও এই ডিগ্রি নিয়ে আসাই যথেষ্ঠ নয়। দরকার হবে পারমাণবিক বিদ্যুকেন্দ্রে কাজ করার লাইসেন্স। সে লাইসেন্স পাবার জন্য একটি প্রশিক্ষণ শেষ করতে হবে সাফল্যের সঙ্গে। তারপর ক্রমে তাঁদের হাত ধরে দেশে তৈরি হবে একটি বিশেষজ্ঞ দল।
মাহদী জানান, রাশিয়ায় যাওয়ার সময় পরমাণু শক্তি কমিশন ও তাঁদের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল যে, পরমাণু শক্তি কমিশন উপযুক্ত মনে করলে তাঁরা দেশে ফিরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে চাকরিতে যোগ দিতে বাধ্য থাকবেন। সেই চুক্তি অনুযায়ী তাঁরা ৫ জনই দেশে ফিরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজে যোগ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে পরমাণু শক্তি কমিশনে আবেদন করেছেন।