সমুদ্রের সম্পদ শিগগিরই ব্যবহার করতে সক্ষম হব
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সমুদ্রের সকল সম্পদ শিগগিরই দেশের জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করতে সক্ষম হব।
তিনি বলেন, বিশাল সমুদ্র অঞ্চলে মৎস্য আহরণ, তেল-গ্যাসসহ খনিজ সম্পদ আহরণ, সমুদ্রসীমা রক্ষাসহ সকল অধিকার সুরক্ষায় কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী আজ সংসদে তাঁর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে সরকারি দলের বেগম ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি’র এক প্রশ্নের জবাবে এ সব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ২০১৪ সালের ৭ জুলাই দ্য হেগের সালিশী ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্র সীমানা নির্ধারণী মামলার রায় ঘোষণা করে। এই রায়ের ফলে বাংলাদেশ মোট ১ লক্ষ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটারের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল (৬৬৭ কি. মি.) পর্যন্ত মহীসোপানে অবস্থিত সকল ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের উপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্থায়ী সালিশ আদালত ন্যায্যতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বিরোধপূর্ণ আনুমানিক ২৫ হাজার ৬০২ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র এলাকার মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বাংলাদেশকে প্রদান করেছে। বাংলাদেশ সমুদ্রে যে এলাকার সম্পদের নিরঙ্কুশ অধিকার অর্জন করেছে তা বাংলাদেশের মোট ভূ-আয়তনের প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ।
শেখ হাসিনা বলেন, সুনির্দিষ্ট সমুদ্রসীমানা না থাকায় বঙ্গোপসাগরে প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলন, গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণসহ সামগ্রিক কর্মকান্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছি। প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সুনির্দিষ্ট সমুদ্রসীমা না থাকায় ২০০৮ সালে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে দাবিকৃত এলাকায় ২৮টি গ্যাস ব্লকের মধ্যে মায়ানমার ১৭টি এবং ভারত ১০টি গ্যাস ব্লক দাবি করে। আমাদের জেলেরা বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে নানামুখী বাধার সম্মুখীন হতো। অন্যদিকে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী এবং কোস্টগার্ডের সদস্যরা তাদের দায়িত্ব পালনে এবং বিদেশী ট্রলার কর্তৃক অবৈধভাবে মৎস্য আহরণ প্রতিরোধের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিল।
তিনি বলেন, স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম বঙ্গোপসাগর ও এর সম্পদসমূহের গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন। ফলশ্রুতিতে, স্বাধীনতার মাত্র তিন বছর পর ১৯৭৪ সালে সমুদ্র ও এর সম্পদসমূহের উপর দেশের জনগণের আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশের মহান জাতীয় সংসদে ‘দি টেরিটরিয়াল ওয়াটারস এন্ড মেরিটাইম জোন এ্যাক্ট’ শীর্ষক একটি পূর্ণাঙ্গ আইন পাস করেছিলেন, যা দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের কোন দেশের সমুদ্র ও তার সম্পদ বিষয়ক প্রথম পূর্ণাঙ্গ আইন। এই আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ১২ নটিক্যাল মাইল রাষ্ট্রাধীন অঞ্চল এবং ২০০ নটিক্যাল মাইল অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা করে যা পৃথিবীর বেশিরভাগ উপকূলীয় দেশের কাছে অপরিচিত ছিল। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারণী সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটান এবং এর ফলে ১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে মিয়ানমারের সাথে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত ‘টেরিটরিয়াল সি’-এর সীমানা নির্ধারণী সংক্রান্ত বিরোধের নিষ্পত্তি হয়।
পরবর্তীতে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ মেয়াদী আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বশেষ মন্ত্রিসভা বৈঠকে ‘ইউনাইটেড ন্যাশন্স কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য সি (ইউএনসিএলওএস) অনুস্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয় এবং অনুস্বাক্ষরের মাধ্যমে বাংলাদেশ ইউএনসিএলওএস-এর সদস্যপদ লাভ করে। ২০০১ সালে ইউএনসিএলওএস অনুস্বাক্ষরের পর ১০ বছরের মধ্যেই অর্থাৎ ২০১১ সালের ২৬ জুলাই নাগাদ বাংলাদেশের মহীসোপানের দাবি জাতিসংঘে পেশ করার কথা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য যে সকল সিসমিক ও ব্যাথেমেট্রিক উপাত্ত সংগ্রহ করা প্রয়োজন ছিল সেগুলো সংগ্রহের বিষয়ে বিগত সরকারগুলো কোন উদ্যোগ নেয়নি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০১০ সালের মার্চ মাসে ডাচ, জার্মান ও নরওয়ের সরকারের সহায়তায় বঙ্গোপসাগরে প্রথমবারের মত নিজস্ব অর্থায়নে একটি সিসমিক জরিপ সম্পন্ন করে। ২০১০ সালের মধ্যে এই সিসমিক জরিপ সম্পন্ন করা না হলে আমরা সময়মত আমাদের দাবি উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হতাম। অতঃপর কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েটের সহায়তায় সময়সীমার ৫ মাস আগেই ২০১১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি উপকূল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে মহীসোপানে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের কাছে এ বিষয়ে অবস্থানপত্র পেশ করা হয়। শুধু তাই নয়, সে বছরের আগস্ট মাসে ২১ সদস্য বিশিষ্ট ‘জাতিসংঘে মহীসোপানের সীমানা নির্ধারক কমিশনে” মহীসোপানে বাংলাদেশের দাবি উপস্থাপন করা হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, রেডক্লিফের ম্যাপ অনুযায়ী দক্ষিণ তালপট্টি ভারতের সীমানা পড়ে। ৮০’র দশকে তালপট্টি দ্বীপটি বাংলাদেশ দাবি করলেও কোন বাউন্ডারী ম্যাপেই এর অবস্থান বাংলাদেশে দেখানো হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আদালতে বাংলাদেশের দাবি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ বাংলাদেশের সীমানায় অন্তর্ভুক্ত করে আমাদের সকল ম্যাপ সংশোধন করা হয়েছিল। দাবি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৮২ সালের হেগ আন্তর্জাতিক আদালতের আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত একটি ম্যাপ আদালতে ব্যবহার করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, ১৯৬৯ সালে নেদারল্যান্ডস ও ডেনমার্কের বিরুদ্ধে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত একটি মামলায় জার্মানী বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য আদালতের কাছে দাবি উপস্থাপন করে। আদালত উক্ত মামলায় বাংলাদেশের দৃষ্টান্ত আমলে নিয়ে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমুদ্র নির্ধারণ করে। সঙ্গতকারণেই জার্মানি বনাম নেদারল্যান্ডস এবং ডেনমার্ক মামলার ‘প্রেসিডেন্স’ দেখিয়ে বাংলাদেশ ন্যায্যতার ভিত্তিতে মামলার রায় প্রদানের জন্য ট্রাইব্যুনালে জোরালো দাবি জানায়। দাবির স্বপক্ষে ১৯৩১ সালের একটি এডমিরালটি চার্টও আদালতে পেশ করা হয়।
তিনি বলেন, ১৯৫০ সালের ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে আরবিট্রেশনের একটি কপিও আদালতে উপস্থাপন করা হয়। সরকার বাংলাদেশের পক্ষে বৈদেশিক কৌসুলী হিসেবে প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দেয়। মোট কথা, সমুদ্রে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল ফলে আমাদের এ ঐতিহাসিক সমুদ্রও বিজয় সম্ভব হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু’র এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে বলেন, গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণের অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।