অব্যবস্থাপনা ও ভুল নীতির কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়ছে
অপচয়, অব্যবস্থপনা ও সরকারের ভুল নীতির কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। আর এই পরিস্থিতির দায়ভার গ্রাহকের ওপর চাপানো হচ্ছে। এটা অযৌক্তিক। বিদ্যুতের দাম বাড়ালে বিরূপ প্রভাব পড়বে সবক্ষেত্রেই।
মঙ্গলবার রাজধানীর কাওরান বাজারে টিসিবি মিলনায়তনে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর আয়োজিত গণশুনানির দ্বিতীয় দিনে পিডিবির খুচরা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর আলোচনা হয়। সেখানে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে এই মন্তব্য করা হয়। একই সাথে পিডিবি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর যুক্তি উপস্থাপন করে। আর পিডিবির প্রস্তাব পর্যালোচনা করে সুপারিশ দেয় বিইআরসির মূল্যায়ন কমিটি।
পিডিবির গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ইউনিট প্রতি ১০ দশমিক ৬৫ ভাগ বা ৭২ পয়সা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের মূল্যায়ন কমিটি।
বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলামের সভাপতিত্বে শুনানিতে কমিশন সদস্য রহমান মুরশেদ, মাহমুদউল হক ভুইয়া, আব্দুল আজিজ খান ও মিজানুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। স্ব স্ব অবস্থান থেকে বক্তব্য রাখেন মূল্যায়ন কমিটির আহবায়ক এ কে মাহমুদ, সদস্য কামারুজ্জামান, সিপিবির সদস্য রুহিন হোসেন প্রিন্সসহ অন্যরা।
শুনানীতে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, পিডিবির কম দামের বিদ্যুতের উৎপাদন বন্ধ রেখে বেসরকারি কেন্দ্রগুলো থেকে বেশি দামের বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে। রেন্টাল কুইক রেন্টাল কেন্দ্র বন্ধ হচ্ছে না। এভাবে অপচয়, অব্যবস্থপনা ও সরকারের ভুল নীতির কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। আর ঘাটতি মেটানোর দায়ভার গ্রাহকের ওপর চাপানো হচ্ছে। এটা যৌক্তিক হতে পারে না।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালেদ মাহমুদ গণশুনানিতে অংশ নিয়ে বলেন, বর্তমানে বিদ্যুৎ কেনা-বেচার মধ্যে ঘাটতি থাকায় প্রতি ইউনিটে ৩ শতাংশ হারে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। এ কারণে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়লে চলতি বছর লোকসান আরো বাড়বে। তাই গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
পিডিবি গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এছাড়া ডিমান্ড ও সার্ভিস চার্জসহ নিরাপত্তা জামানত বাড়ানোর আবেদন করে সংস্থাটি।
এবার প্রথমবারের মতো পিডিবি তার প্রস্তাবে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, অবকাঠামো নির্মাণের অস্থায়ী সংযোগ ও বহুতল ভবনের ফ্ল্যাটের গ্রাহকদের জন্য আলাদা দাম নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে। এরমধ্যে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার জন্য প্রতি ইউনিট সাত টাকা ২৫ পয়সা, বহুতল ভবনের ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে সাত টাকা ৮০ পয়সা, অবকাঠামো নির্মাণের অস্থায়ী সংযোগে ১০ টাকা ৩০ পয়সা দাম নির্ধারণের প্রস্তাব দেয়া হয়। এছাড়া সব শ্রেণির গ্রাহকের ডিমান্ড ও সার্ভিস চার্জ এবং নিরাপত্তা জামানত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
পিডিবির পরিচলন ব্যয় ও জ্বালানি খরচ হিসাব করে মূল্যায়ন কমিটি জানায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য পিডিবির রাজস্ব চাহিদা সাত হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। যা বিদ্যুৎ বিক্রি করে আয় করতে হবে। এজন্য সংস্থাটি এখন যে দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করছে তা আরো ৭২ পয়সা বাড়ানো প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রি পেইড মিটার ব্যবহারকারীদের এক শতাংশ রিবেট দেয়ারও প্রস্তাব করেছে।
ভোক্তা প্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো দাম বাড়ানোর বিরোধীতা করে বলেছে, বিদ্যুতের দাম বাড়ালে ছোট বড় সব ধরনের শিল্প, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ জনগণের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবন যাপনের ব্যয় বাড়বে।
শুনাননিতে অংশ নিয়ে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, এমসিসিআই, ডিসিসিআই প্রতিনিধিরা বলেন, দেশের রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশ আসে পোশাক খাত থেকে। দিন দিন বিশ্ব বাজারে এ খাতে প্রতিযোগিতা বাড়ছে। ভারত, কম্বোডিয়া, মিয়ানমারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে উৎপাদন ব্যয় কম রাখা জরুরি। কিন্তু বিদ্যুতের দাম বাড়লে উৎপান খরচ বেড়ে যাবে। এতে পোশাক রপ্তানি হুমকির মুখে পড়বে। বন্ধ হয়ে যাবে অনেক শিল্প কারখানা।
স্টিল রি রোলিং মিল অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জহির চৌধুরী বলেন, স্টিল রি রোলিং মিলগুলো প্রতিদিন এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। বর্তমানে এ খাতে মন্দা চলছে। এই খাতের উৎপাদন ব্যয়ের ৮ শতাংশ এনার্জি খাতে খরচ হয়। তাই দাম বাড়লে তারাও বিপদে পড়বেন।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকি বলেন, পিডিবি যেসব ব্যয় বিবেচনা করে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে, তার কারণে ভোক্তাদের ওপর আলাদা চাপের সৃষ্টি হবে। একেতো বন্যা তার ওপর নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে দিন দিন। এভাবে প্রতি বছরই বিদ্যুতের দাম বাড়তে থাকলে সাধারণ মানুষের ওপর আলাদা চাপ তৈরি হয়। এক্ষেত্রে দাম বাড়ানো অযৌক্তিক।